হজ স্থগিত নাকি সীমিত পরিসরে?
প্রথমেই বলে রাখি, এখন শাবান মাস, এরপর রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ মা। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ১০ জিলহজ অর্থাৎ ৩০ জুলাই হজের সম্ভাব্য তারিখ মনে করা হচ্ছে।
সে হিসেবে হজের আরও চার মাস সময় বাকি। তবে হজপালনের জন্য বিভিন্ন দেশে থেকে মুসল্লিরা সাধারণত জিলকদ মাসের শুরু থেকেই সৌদি আরব আসতে শুরু করেন। কিন্তু হজের প্রস্তুতি নিতে হয় আরও আগে থেকেই। প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে ২০ লাখের বেশি মুসলমান হজপালন করতে সৌদি আরব যান।
করোনা পরিস্থিতির কারণে এবারের হজ কী হবে- এটা নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনার মাঝে সৌদি আরবের হজ ও উমরা বিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ সালেহ বিন তাহের বেনতেন বুধবার (১ মার্চ) বলেছেন, ‘পরিস্থিতি স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত হজের বিষয়ে কোনো চুক্তিতে না যেতে আমরা সব দেশের মুসলিম ভাইদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
সৌদি মন্ত্রীর দেওয়া এমন বক্তব্য পর্যালোচনা করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান বলছে, বাতিল হতে পারে এ বছরের হজ। কারণ, করোনা পরিস্থিতির কারণে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে উমরা স্থগিত করা হয়। পরে পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনা লকডাউন ঘোষণার পাশাপাশি কারফিউ জারি করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের কারণে এ বছরের হজ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বকে তটস্থ করে ফেলা করোনা খুব সহসা দূর হবে এমন আভাস দিতে পারছে না কেউ। সব মিলিয়ে একটি গুমোট পরিবেশ বিরাজমান।
হজ ফরজ ইবাদত
হজ ফরজ ইবাদত, অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম। মুসলমানমাত্রই বায়তুল্লাহ তথা আল্লাহর ঘর কাবা নিজ চোখে দেখা এবং সেই ঘর তাওয়াফের তীব্র বাসনা পোষণ করেন, হজপালনের আকাঙ্খা লালন করেন। ইসলামি বিধানমতে, হজ ফরজ হওয়ার জন্য পাঁচটি শর্ত রয়েছে। এক. মুসলিম হওয়া, দুই. বিবেকবান হওয়া, তিন. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, চার. স্বাধীন হওয়া ও পাঁচ. হজ আদায় করার সামর্থ্য থাকা।
ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, এ সামর্থ্য তিনটি শর্তযুক্ত, এক দৈহিক সামর্থ্য অর্থাৎ কাবা শরিফ পর্যন্ত সফর করার শারিরীক যোগ্যতা, চলাফেরায় অক্ষম লোকের ওপর হজ ফরজ নয়। এমন ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্য থাকলে বদলি হজ করানো ওয়াজিব। দুই, আর্থিক সামর্থ্য অর্থাৎ পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ নিশ্চিত করে কোনো ব্যক্তির নিকট হজে যাওয়া-আসা ও পাথেয় খরচ থাকলে তার ওপর হজ ফরজ হবে। তিন, নিরাপত্তা অর্থাৎ যাতায়াতের পথ নিরাপদ থাকা এবং রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা না থাকা। কোনো ব্যক্তির জীবনের কোনো একটি বছরে উপরোক্ত শর্তগুলোর সমন্বয় ঘটলে তার ওপর পবিত্র হজ ফরজ।
মহামারির মতো পরিস্থিতিতে হজপালন প্রসঙ্গে ইসলামের বিধান
হজ ফরজের শেষ অংশ নিরাপত্তা অর্থাৎ যাতায়াতের পথ নিরাপদ থাকা এবং রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা না থাকার কথা উল্লেখ করে অনেকে বলতে চাচ্ছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সৌদি আরব এবারের হজ স্থগিত রাখতে পারে। কিংবা যাবতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সীমিত পরিসরে শুধুমাত্র সৌদি আরবের নাগরিকদের জন্য হজপালনের অনুমতি দিতে পারে।
আমাদের প্রত্যাশা হলো- হজের আগেই করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাক। এখনও যেহেতু সময় আছে, হজ স্থগিত হবে এমন কথা না বলাই ভালো। হজের প্রস্তুতি চলতে থাকুক। তবে মহামারি আক্রান্ত এলাকা থেকে অন্য এলাকায় এবং আক্রান্ত এলাকায় না যাওয়ার ব্যাপারে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে স্পষ্টভাবে বলেছেন। এই হাদিসের আলোকে করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারির কারণে সৌদি সরকার হজযাত্রীদের সৌদিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন। এমন অবকাশ আছে। তাছাড়া হজ জীবনে একবার ফরজ। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়ার পর ব্যক্তির ওপর ফরজ হয়। এবার যদি কেউ ফরজ ইবাদতটি পালন করতে না পারেন, পরের বছর আদায় করবেন। এর মধ্যে কারও মৃত্যু হয়ে গেলে- তিনি উত্তরাধিকারীদের কাছে হজের জন্য অসিয়ত করে যাবেন এবং সে অনুযায়ী পরবর্তীতে সেটি পালন করলে আদায় হয়ে যাবে। ইসলামি শরিয়ত এর অনুমোদন দেয়।
অন্যদিকে হজপালনের পথ ও স্থান নিরাপদ না হলে, জীবনহানি, রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কিংবা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকলে হজ বিলম্বিত করায় কেউ গোনাহগার হবেন না।
অতীতে হজ স্থগিতের নজির রয়েছে
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ইতোমধ্যে সৌদি সরকার তাদের গ্র্যান্ড ফতোয়াবোর্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন ফতোয়াবোর্ড ও ইসলামি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছে। কারণ মহামারি, যুদ্ধ পরিস্থিত ও সংঘাতে কারণে হজ স্থগিত রাখা কিংবা সীমিত আকারে পালনের নজির রয়েছে। লন্ডনের কিংস কলেজের ওয়ার স্টাডিজের লেকচারার সিরাজ মাহের গার্ডিয়ানকে বলেছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- সৌদি কর্তৃপক্ষ মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করছে যে এবারের হজ বাতিল হতে পারে। চলতি মহামারির কারণ তো আরও প্রকট।
সম্প্রতি ‘দ্য নিউ আরব’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবে উমরা বন্ধ করা এবং করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে হজের সময় কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমার কোনো লক্ষণ এখনও নেই। ফলে অনেকে হজ বাতিলের আশঙ্কা করছেন।
সৌদি কিং আবদুল আজিজ ফাউন্ডেশন ফর রিসার্চ অ্যান্ড আর্কাইভস ইতিহাসে ৪০ বার হজ বাতিল করা হয়েছিল বা হজযাত্রীর সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল উল্লেখ করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে সংবাদমাধ্যমটির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইসলামের ইতিহাসে এর আগেও বহুবার রোগ, যুদ্ধ, সংঘাত, দস্যু ও আক্রমণকারীদের তৎপরতাসহ নানাবিধ কারণে হজ বাতিল করা হয়েছে। সে হিসেবে চলমান পরিস্থিতিতে মানুষের আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়।
হিজরতের নবম বছরে হজ পালন ফরজ ইবাদত হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর থেকে এ যাবৎ আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ৪০ বার হজ স্থগিত হয়েছিল। তন্মধ্যে ১২ বার স্থগিত করা হয়েছিল সম্পূর্ণরূপে। তবে ১৯৩২ সালের পর পুরোপুরি হজ বন্ধ থাকার কোনো নজীর নেই।
সীমিত পরিসরে হজ আয়োজন হতে পারে
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ইতোমধ্যে সৌদি সরকার তাদের গ্র্যান্ড মুফতি, ফতোয়াবোর্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন ফতোয়াবোর্ড ও ইসলামি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছেন। প্রয়োজনে তারা ওআইসিসহ প্রভাবশালী মুসলিম দেশ ও সংগঠনগুলোর কাছে পরামর্শ চাইতে পারে। মহামারি, যুদ্ধ পরিস্থিত ও সংঘাতের কারণে হজ স্থগিত রাখা কিংবা সীমিত আকারে পালনের নজির থাকলেও সৌদি আরব একক সিদ্ধান্তে হজ স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে সমালোচনার শিকার হতে চায় না। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতির বিষয়।
এ ছাড়া হজ বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার আগে সৌদি আরব চিন্তা করতে তাদের অর্থনৈতিক আয়ের বিষয়টিও। অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে সৌদি আরবের যা রোজগার হয়, তার থেকেও বেশি আয় করে তারা হজ থেকে। সৌদি সরকারের ভিশন-২০৩০ এর অন্যতম লক্ষ্য হলো- বছরে ১ কোটি উমরা ভিসা ও হজযাত্রীর সংখ্যা ৫০ লাখে উন্নীত করা। এ পথেই হাঁটছে দেশটি। যে কারণে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর উমরা ভিসা চালুর প্রথম চার মাসে দেশটি ২২ লাখ উমরা ভিসা ইস্যু করে। এমনিতে ১ মাসের বেশি সময় ধরে উমরা বন্ধ, কবে চালু হবে সেটা অনিশ্চিত। এমতবস্থায় হুট করে তারা হজ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয় না। সব কিছুই অস্পষ্ট।
এই পরিস্থিতিতে সৌদি হজ মন্ত্রীর ‘হজ পালনেচ্ছুকদের করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা’ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর সৌদি হজ ও উমরা মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে পরবর্তী ঘোষণার আগ পর্যন্ত হজের অত্যাবশ্যকীয় সকল কাজ বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করেছে। এই চিঠি হজে অংশগ্রহণকারী সব দেশকেই দেওয়া হয়েছে।
তাই অনেকে মনে করছেন, হজের আগে সৌদি আরবের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও বিশ্ব পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলে সীমিত আকারে অভ্যন্তরীণভাবে হজ কার্যক্রম চালু রাখা হতে পারে। আর সৌদিতে করোনা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হলে উমরার মতো এ বছরের হজকার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। তবে একথা এখনও জোর দিয়ে বলার সময় হয়নি।
বেশ কয়েকজন প্রবাসীর অভিমত- সৌদি সরকার এখন ভাইরাসে বিস্তার রোধে বেশি নজর দিচ্ছেন। সৌদিতে কারফিউ জারি, লকডাউন, মসজিদের জামাত, অফিস-আদালত, গাড়ি চলাচল ও উমরা বন্ধ করে দেওয়া তারই অংশ।
তাদের মতে, সময়ের হিসেবে এবার হজ মৌসুমে সৌদি আরবের তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। প্রচণ্ড গরমের কারণে তখন করোনা বিস্তারের আশঙ্কা কম। ততদিন পর্যন্ত পরিস্থিতি সৌদি আরবে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে বহির্বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে বাইরের লোকদের সৌদি আরবে প্রবেশের অনুমতি সৌদি সরকার কোনোভাবেই দেবে না। সেক্ষেত্রে বাইরের লোকদের জন্য হজ বন্ধ রেখে সৌদি আরবের বাসিন্দাদের জন্য সীমিত আকারে হজের অনুমতি দেওয়া হতে পারে।
তবে এটা বলা যায়, সৌদিতে করোনা যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে আসন্ন রমজানে মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে ইতেকাফসহ উমরার অনুমতি দেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর তারাবি জামাতও সীমিত করা হতে পারে।