মানব সেবা আলেম-উলামাদের ঐতিহ্য: মাওলানা গাজী ইয়াকুব
‘কোনো সেলফি নয়, আমরা পারতপক্ষে কোনো সাহায্যপ্রার্থীর মুখোমুখি হই না। মধ্যবিত্ত পরিবারের দরজায় এভাবেই রেখে আসি সাহায্য সামগ্রী। কেউ দেখুক বা না দেখুক আল্লাহতায়ালা তো দেখছেন।’
ওপরের ছবিটির মতো এভাবেই নিরবে-নিভৃতে করোনার কারণে ঘোষিত ছুটির মাঝে নিম্নবিত্ত কিংবা হঠাৎ কাজ হারানো অভাবী-অসহায় মানুষের দরোজায় প্রয়োজনীয় খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন মাওলানা গাজী ইয়াকুব ও তার দলের সদস্যরা।
শুধু খাবার নয়, রাজধানীতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তার জানাজা ও দাফন সঠিক ইসলামি নিয়মে সম্পন্ন করার কাজটিও করছেন তারা। মাওলানা গাজী ইয়াকুবের নেতৃত্বে কয়েকজন আলেম এ কাজ করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- এইচ এম লুৎফর রহমান, হিফজুর রহমান, সালমান বিন সাজিদ, নুরুন নবী নুর, কারী ওসামা বিন নিজাম ও মোহাম্মদ রাফী।
ব্যক্তিগতভাবে এ উদ্যোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়ার পর পরে দেশের বিভিন্ন জেলায় আরও শতাধিক আলেম আলেম এ কাজে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে গাজী ইয়াকুবের প্রতিষ্ঠিত ‘তাকওয়া ফাউন্ডেশন’ তাদের প্রয়োজনীয় পিপিই সরবরাহ করেছেন।
এ ব্যাপারে মাওলানা গাজী ইয়াকুব বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত কোনো রোগী মারা গেলে তাদের জানাজা-দাফনের প্রয়োজন হলে আমাদের মোবাইলে ০১৯২০৭৮১৭৯২ ফোন করলে আমরা সেখানে পৌঁছে যাবো। তার নামাজে জানাজা ও দাফন কার্যক্রম সম্পন্ন করবো। কারও যদি কাফনের কাপড় প্রয়োজন হয়, আমরা তারও ব্যবস্থা করবো।
এ কাজে কেন এলেন জানতে চাইলে মাওলানা ইয়াকুব বলেন, বিভিন্ন দেশে আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের জানাজা-দাফন নিয়ে সঙ্কটের কথা শুনেছি। এজন্য আমরা চাচ্ছি আমাদের দেশে যেনো সে রকম না ঘটে। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক যেনো একজন মুসলমানের জানাজা-দাফন হয় সেজন্য আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি- করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর তিন-চার ঘণ্টা পর তার শরীরে আর জীবাণু থাকে না। এজন্য আমরা কেউ কল করলে তিন-চার ঘণ্টা পর তার জানাজা-দাফনের ব্যবস্থা করবো। এ পর্যন্ত গাজী ইয়াকুব ও তার দল ৬টি লাশ দাফন করেছেন।
৪২ বছর বয়সী গাজী ইয়াকুব আরও জানান, করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর থেকেই তারা জনগণকে সচেতন করতে কাজ শুরু করেছেন। মসজিদে মসজিদে লিফলেট বিতরণ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও প্যাকেট খাবার বিতরণ করা শুরু করেন। সেই সঙ্গে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় রুটিন করে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে।
দলমত ও ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অসহায়দের মাঝে প্রতিদিন দুইশ’ প্যাকেট ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছেন। এসব প্যাকেটে রয়েছে, চাল, ডাল, আটা, আলু, সাবান, তেল ও বিস্কুটসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস।
লালবাগ মাদরাসা থেকে ১৯৯৯ সালে দাওরায়ে হাদিস পাস করেছেন ৩ সন্তানের জনক মাওলানা গাজী ইয়াকুব। তিনি মানব সেবাকে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম মনে করেন। ব্যক্তিগত জীবনে মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসা করে জীবন নির্বাহ করেন তিনি। এসব কাজের মাঝেই নিজেকে জড়িয়েছেন আর্ত মানবতার সেবায়।
ত্রাণ কার্যক্রমের অর্থায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদেরকে সমাজের দ্বীনদার ভাই-বোনেরা জিনিসপত্র কিনে দেন। আমরা শুধু সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করি আমাদের ব্যবস্থাপনায়। এই শহরের প্রচুর নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা তাদের আমানতটুকু অসহায় মানুষের কাছে শুধু পৌঁছে দিচ্ছি।
তিনি মনে করেন, ইসলাম মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অনুপ্রেরণা দেয়। মানুষের সেবা করতে এবং তাদের কষ্ট-অসুবিধা দূর করার জন্যে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন। একজন মুসলমান হিসেবে আমি শুধু দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি- যোগ করেন মাওলানা ইয়াকুব।
তিনি সাধ্যমতো সবাইকে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মানুষের সেবা করা, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো একটি উত্তম ইবাদত। যুগে যুগে মনীষীরা মানব সেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে, কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।’
আলাপচারিতায় তরুণ এই মাওলানা আরও বলেন, মানব সেবা, সৃষ্টির সেবা আলেম-উলামাদের ঐতিহ্য। ইসলামের শুরু থেকেই আলেমরা বিভিন্নভাবে মানুষের সেবা করে এসেছেন, এখনও করচেন। তবে এর পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু আলেমরা প্রচারবিমুখ হওয়ায় আলেম সমাজের সেবা মানুষের কাছে সেভাবে প্রচার করা হয় না।