তাজিয়াকাটা চরের রাজকাঁকড়া
বিশেষ কিছু বিরল পরিযায়ী পাখির খোঁজে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। কিন্তু কুমিল্লায় এসে হাইওয়ে রেঁস্তোরায় বিরতির পর গাড়ি মহাযানজটে পড়ল। রাত প্রায় আড়াইটা বাজে। এত রাতে কেন এত যানজট তা বোধগম্য হলো না। অনেক চেষ্টার পর জানা গেল কিছুক্ষণ আগে একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি রাস্তায় উল্টে পড়ে থাকার কারণে জানজটের সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এগুলো না সরানো পর্যন্ত যানজট বাড়তেই থাকবে। অতএব, কোনো দুঃশ্চিন্তা না করে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। বাস জার্নিতে ঘুম দেয়া আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। ভালোই ঘুম হলো। আর সেই ঘুম ভাঙ্গল চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর শাহ আমানত সেতু পার হওয়ার পর বাস যখন জ্বালানি নিতে পেট্রোল পাম্পে থামল তখন। কিন্তু আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সকাল নয়টা বাজে। অথচ সকাল আটটায় কক্সবাজার পৌঁছার কথা ছিল। এর ফিশারি ঘাটে গিয়ে স্পিড বোটে ওঠার কথা। অথচ এখনও আমরা মাত্র চট্টগ্রাম পার হয়েছি।
যা হোক, শেষমেষ বাস কক্সবাজার পৌঁছল দুপুর ঠিক একটায়। ফলে সোনাদিয়া যাওয়া হলো না। কাজেই বিরল পরিযায়ী সৈকত পাখি দেখার পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। হোটেলে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে সোজা ফিশারি ঘাটে চলে গেলাম। হাতে মাত্র দু’ ঘন্টা সময়। গাইড গিয়াস উদ্দিনকে ফোন দিয়ে তার পরামর্শে বেলা তিনটায় মহেশখালীর তাজিয়াকাটা চরের দিকে স্পিডবোট ছোটালাম। পথে বদরকৈতর (Brown-headed Gull), ছোট পানকৌড়ি (Little Cormorant) ও গোতরা (Common Green Shank) দেখে আধ ঘন্টা পর তাজিয়াকাটা চরে পৌঁছুলাম।
তাজিয়াকাটা চরে নেমেই গোতরা, লাল-পা পিউ (Common Redshank), বড় ও ছোট টিটি জিরিয়া (Greater & Lesser Sandplover) ইত্যাদি সৈকত পাখির ছবি তুলে যে যার মতো চরের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লাম নতুন পাখির সন্ধানে। প্রায় ঘন্টাখানেক পাখি খোঁজার ও ছবি তোলার পর আমাদের সঙ্গে আসা অপু নামে একজনের মোবাইল ফোনের মেসেজ পেয়ে ওর দিকে ছুটলাম।
অপুর কাছাকাছি আসতেই সে বলল- ‘স্যার, কচ্ছপের মতো দেখতে এটা কী?’ কাদা পানিতে পড়ে থাকা প্রাণীটিকে পরীক্ষা করেই আনন্দে ফেটে পড়লাম! আরে, এ যে দেখছি এক জীবিত জীবাশ্ম! নতুন পাখি খুঁজতে এসে এমন এক প্রাণীর দেখা পাব ভাবতেই পারিনি! জীবিত জীবাশ্মটির ছবি তুলে ও ভিডিও করে সূর্য ডোবার আগে বাকি সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানেও পেলাম আরেকটি জীবিত জীবাশ্ম। সেটির ছবি তুলতে তুলতে আলো পড়ে এলো। এরপর আমরা সবাই স্পিড বোটের দিকে এগিয়ে গেলাম।
তাজিয়াকাটা চরে দেখা জীবিত জীবাশ্মটি আর কেউ নয়, এদেশের এক সংকটাপন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী রাজকাঁকড়া। সাগর কাঁকড়া বা অশ্বক্ষুরাকার কাঁকড়া নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Mangrove Horse-shoe Crab, Round-tail Horse-shoe Crab বা Sunderban Mangrove Horse-shoe Crab। নামে যদিও কাঁকড়া, আদতে এটি কাঁকড়ার চেয়ে বরং কাঁকড়াবিছা (Scorpion) ও মাকড়সার (Spider) নিকটাত্মীয়।
সন্ধিপদী (Arthropods) পর্বের ম্যালাকোস্ট্রাকা (Malacostraca) শ্রেণীর জিফোসুরা (Xiphosura) বর্গের লিমুলিডি (Limulidae) গোত্রের প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Carcinoscorpius rotundicauda। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে প্রাণীটির দেখা মেলে।
রাজকাঁকড়ার দেহ মূলত তিন ভাগে বিভক্ত, যেমন- প্রোসোমা বা মাথা (ঘোড়ার ক্ষুরাকারের সামনের অংশ যাতে মস্তিষ্ক, মুখ, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র ও গ্রন্থিতন্ত্র সুরক্ষিত থাকে; এছাড়াও মাথায় রয়েছে দুটি যৌগিক চোখসহ মোট নয়টি চোখ এবং আরও কিছু লাইট রিসিপটর), অফিস্তোসোমা বা উদর (প্রোসোমার পিছনের কাঁটাযুক্ত ত্রিকোনাকার অংশ যা প্রাণীটির চলাফেরা, নিরাপত্তা ও শ্বাসপ্রশাসের কাজ চালায়) ও টেলসন বা লেজ (লম্বা, চোখা ও গোলাকার লেজটি দেখতে যতই ভয়ংকর হোক না কেন, আদতে এটি না বিপদজনক, বিষাক্ত বা কাঁটা ফুটানোর জন্য ব্যবহার করা হয়; বরং লেজের মাধ্যমে এরা পিঠে চাপ দিয়ে উল্টে যাওয়া দেহকে সোজা করে থাকে)।
যুগ যুগ ধরে জীববিজ্ঞানীদের কাছে এটি জীবিত জীবাশ্ম হিসেবে পরিচিত। কারণ, এর শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তিত হলেও শারীরস্থানিক গঠন অর্থাৎ বহিঃকংকালের তিনটি অংশ প্রোসোমা, অফিস্তোসোমা ও টেলসন প্রায় ৪০০ মিলিয়ন সময় ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। রাজকাঁকড়ার ৪০০ মিলিয়ন বছরের পুরনো জীবাশ্ম দেখতে হুবহু বর্তমানকালের রাজকাঁকড়ার মতোই।
পৃথিবীতে রাজকাঁকড়ার যে চারটি প্রজাতি রয়েছে তাদের মধ্যে আমাদের দেশেরটি ক্ষুদ্রতম। অন্যান্য প্রজাতির মতো এটিরও স্ত্রী পুরুষের চেয়ে আকারে বড় হয়। স্ত্রী ও পুরুষের প্রোসোমা যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ সেন্টিমিটার (সেমি) চওড়া হয়ে থাকে। আর গোলাকার লেজটিও প্রায় ১২ থেকে ১৪ সেমি হতে পারে। এদের ছয় জোড়া পা রয়েছে। সামনের একজোড়া পা খাবার ধরার কাজে ও বাকি পাঁচ জোড়া পা চলাফেরার কাজে ব্যবহার করে। দেহের উপরের রং জলপাই-বাদামি ও নিচের অংশের রং খয়েরি।
রাজকাঁকড়া দেশের পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল, যেমন- কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সোনাদিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া দ্বীপপুঞ্জ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল, যেমন- সুন্দরবনে দেখা যায়। এরা জীবনের বেশিরভাগ সময় সাগর বা নোলাজলের তলদেশে কাটায়। নিশাচর এই প্রাণীটি উপকূলীয় অগভীর জলের পলিময় নরম ও বেলে মাটিতে বাস করে। সচরাচর জলজ কীটপতঙ্গের শূককীট, ছোট মাছ, ক্ষুদে কাঁকড়া, পাতলা খোসার ঝিনুক, শ্যাওলা ইত্যাদি খায়। এদের কোনো চোয়াল বা দাঁত না থাকায় পিছনের পায়ের মাধ্যমে খাবার ভেঙে সামনের পা দু’টি দিয়ে মুখে পুরে।
বসন্তের শেষ থেকে গ্রীষ্মের শুরু এদের প্রজননকাল। এরা পূর্ণিমার রাতে ভরা জোয়ারের সময় প্রজনন করে। এ সময় এরা নিজেদেরকে জড়িয়ে ধরে সমুদ্র সৈকতে আসে। স্ত্রী নরম বালি খুড়ে বাসা তৈরি করে তাতে ডিম পাড়ে। আর পুরুষ সেই ডিমের উপর শুক্রাণু ছড়িয়ে দিয়ে সেগুলো নিষিক্ত করে। এভাবে স্ত্রীটি কয়েকবারে প্রায় ১০ হাজার ডিম পাড়ে। এদের ডিম সরীসৃপ, পাখি ও মাছের প্রিয় খাবার হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খুব কম ডিমই ফোটার সুযোগ পায়। যাহোক, ডিমগুলো এসব শিকারি প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেলে ডিম ফুটে শূককীট বের হতে প্রায় দু’সপ্তাহ সময় লাগে।
শূককীটগুলো দেখতে হুবহু বয়স্ক রাজকাঁকড়ার মতো, শুধু আকারেই ছোট এবং এদের লেজ থাকে না। এরপর এই শূককীটগুলো সমুদ্রে চলে যায় ও সমুদ্রের বালুময় তলায় টাইডালে ফ্ল্যাটে অবস্থান করে এবং এভাবে প্রায় বছরখানেক থাকে। এরপর খোলস পাল্টিয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে আকারে বড় হয় ও সমুদ্রের আরও গভীরে চলে যায়। প্রায় দশ বছরে ১৬ থেকে ১৭ বার খোলস পাল্টে এরা প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীতে পরিণত হয়। এদের আয়ুষ্কাল প্রায় ২০ বছর।
যদিও এদেশে রাজকাঁকড়ার সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই, তথাপি বিজ্ঞানীর মনে করেন নানা কারণে, যেমন- অতিরিক্ত শিকার, পরিবেশ দুষণ, আবাস ধ্বংস ইত্যাদি কারণে গত ২৫ বছরে দেশের ৩০% রাজকাঁকড়া বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। আর একারণেই এরা বর্তমানে সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। কাজেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের এই জীবিত জীবাশ্মটিকে রক্ষায় আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত।