জীবাণু দ্বারা প্রভাবিত হয় আমাদের আবেগ ও আচরণ!

  • ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইফস্টাইল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জীবাণু।

জীবাণু।

কোন ধারনা আছে কি, আপনার শরীরে কতগুলো জীবাণুর বসবাস? একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে ১০ হাজার ভিন্ন প্রজাতির ১০০ ট্রিলিয়নের অধিক জীবাণু (মাইক্রোব) থাকে। উত্তরটা কিন্তু আঁতকে ওঠার মতোই।

মানবদেহে বসবাসকারী জীবাণুদের মোট ওজন ২-৬ পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। যা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মগজের ওজনের দ্বিগুণ। যে কারণে বলা হয়ে থাকে, মানুষের শরীরের ৯০ শতাংশই হচ্ছে জীবাণু, বাকি ১০ শতাংশ মানবদেহ!

বিজ্ঞাপন

এতক্ষণ ধরে শরীরে বসবাসকারী জীবাণুদের সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো। মূল বিষয়টা জানানো হবে এখন। শরীরের বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী এই সকল জীবাণুই কিন্তু মানুষের আবেগ ও আচরণের উপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করে।

গবেষণা থেকে দেখা গেছে ডিপ্রেসেন্ট প্রভাব তৈরি হয় ল্যাকটোব্যাসিলাস (Lactobacillus) ও বিফিডোব্যাকটেরিয়াম (Bifidobacterium) নামক দুইটি পাকস্থলিস্থ ব্যাকটেরিয়ার সাহয্যে। উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও হতাশার মতো আচরণগুলো তৈরির জন্যেও দায়ী থাকে ভিন্ন ধরণের জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া।

বিজ্ঞাপন

ব্যাপারটা কেমন যেন পুতুলখেলার মতো মনে হচ্ছে, তাই না? যেন জীবাণুগুলো আমাদের আচরণ ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করছে নিজেদের মতো করে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজি বিভাগের গবেষক ক্যাটেরিনা জনসন জানান, মাইক্রোব সমূহ আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে না। বরং স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী তারা পাকস্থলীতে জন্ম নেয় ও বৃদ্ধি পায় এবং প্রাকৃতিকভাবে আমাদের আচরণের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করে।

এবার জেনে নেওয়া যাক দারুণ একটি গবেষণা সম্পর্কে। এই গবেষণাটি বুঝতে সাহায্য করবে আসলেও জীবাণু আমাদের আবেগ ও আচরণের উপরে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

২০১১ সালে ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির এক দল গবেষক দুইটি ইঁদুরের উপর গবেষণা চালায়। প্রথম ইঁদুরটি ছিল ভয়ার্ত ও চুপচাপ (ইনট্রোভার্ট)। যেখানে দ্বিতীয় ইঁদুরটি ছিল খুবই চঞ্চল ও সামাজিক (এক্সট্রোভার্ট)।

গবেষকেরা ইঁদুর দুইটিকে একটি উঁচু স্থানে ছেড়ে দেন। তারা দেখতে চেয়েছিলেন, ইঁদুর দুইটি উঁচু স্থান থেকে নিচে নামতে কতক্ষণ সময় নেয়। সময় হিসেব করে দেখা গেলো, ইন্ট্রোভার্ট ইঁদুরটি উঁচু স্থানে বেশ অনেকক্ষণ এদিকে-সেদিক ঘোরাফেরা করে প্রায় সাড়ে চার মিনিট পর খুব ধীরে ও ভয়ের সাথে নিচে নেমে আসে। ওদিকে এক্সট্রোভার্ট ইঁদুরটিকে উঁচু স্থানে রাখার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লাফ দিয়ে নিচে নেমে যায়।

এই পরীক্ষাটির পর গবেষকেরা ইঁদুর দুইটির মাইক্রোবায়োটা একে-অন্যের শরীরে প্রবেশ করায়। এরপর পুনরায় একই পরীক্ষা চালায়। ফলাফলে দেখা গেলো, ইন্ট্রোভার্ট ইঁদুরটি আগের চাইতে এক মিনিট আগে নিচে নেমে আসে, অর্থাৎ সাড়ে তিন মিনিটের মাথায় ইঁদুরটি উঁচু স্থান থেকে নামে। ওদিকে এক্সট্রোভার্ট ইঁদুরটি এক মিনিট সময় পর নিচে নামে, যেখানে আগের পরীক্ষায় ইঁদুরটি কয়েক সেকেন্ডের মাথায় নিচে নেমে এসেছিল!

একইভাবে একজন মানুষের আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করে তার শরীরে বসবাসরত মাইক্রোব সমূহ। বিশেষত পাকস্থলিস্থ ব্যাকটেরিয়া শুধুই যে আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাই নয়, ব্রেইন ক্যামিস্ট্রিতেও তারতম্য আনে, তৈরি করে সেরোটোনিন। সেরোটোনিন তৈরিকারী মাইক্রোব সমূহ হলো- ক্যান্ডিডা, স্ট্রেপটোকোক্কাস, ইশেরিকিয়া ও এন্ট্রোকোক্কাস। আনন্দ বোধ ত্বরান্বিত করার জন্য সেরোটোনিন বিশেষভাবে পরিচিত।

পাকস্থলীতে থাকা এই জীবাণু কিংবা ব্যাকটেরিয়া কীভাবে অনুভূতিগুলো আমাদের মগজে পৌছায়- খুব স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিবে। সেক্ষেত্রে জেনে রাখুন, আমাদের পাকস্থলী ও অন্ত্র থেকে সরাসরি মগজে এই অনুভূতিগুলো পৌছাতে সাহায্য করে ‘ভেগাস’ নামক নার্ভ। এই নার্ভ অন্ত্র থেকে একদম মগজ পর্যন্ত বিস্তৃত। যা অনুভুতিগুলোকে পৌছে দিতে সাহায্য করে। শুধু এই পদ্ধতিই নয়, এছাড়াও আরো বেশ কিছু পদ্ধতির সাহায্যে অনুভূতি মগজ পর্যন্ত পৌছে থাকে।

কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, কেন জীবাণু আমাদের আবেগ ও আচরণের উপর এই প্রভাব বিস্তার করে? উত্তরটাও খুব সহজ, নিজেদের বংশ বিস্তার ও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। এই ব্যাপারটি সহজভাবে বোঝানোর জন্য একটি মজার চক্র তুলে ধরা হলো।

এই চক্রটি আবর্তিত হয় বিড়াল থেকে ইঁদুরের মধ্যে। বিড়ালদের জন্য বিশেষ ধরণের একটি জীবাণু আছে, যার নাম টোক্সোপ্লাজমা গন্ডি। এই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত বিড়াল খোলা স্থানে জীবাণুর ডিমসহ মল ত্যাগ করার মাধ্যমে চক্রটি শুরু হয়। আমরা সকলেই জানি ইঁদুর সবকিছু খায়। যার ফলে টোক্সোপ্লাজমার প্রভাবে ইঁদুর গর্ত থেকে বের হয়ে বিড়ালের মল খেতে উদ্যত হয়। এই সুযোগে বিড়াল ইঁদুরকে সহজেই শিকার করে খেতে পারে। টোক্সোপ্লাজমা শুধু বিড়ালের পাকস্থলিতেই পুনরায় বংশবিস্তার করতে পারে। যে কারণে এই চক্রের মাধ্যমে টোক্সো তার বংশ বিস্তার করতে পারে।

ঠিক একই ঘটনা ঘটে থাকে মানুষের সাথেও। তাদের বিভিন্ন ধরণের আবেগ ও আচরণের প্রকাশের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হয় জীবাণুদের বংশবিস্তার। কিছু জীবাণু আমাদের সামাজিক হতে সাহায্য করে ও আমাদের মন ভালো রাখে। যার ফলে আমরা বাইরে ঘুরতে বের হই, পরিচিতদের সাথে সাক্ষাৎ করি। এই সকল ক্রিয়ার মাধ্যমে খুব সন্তর্পনে জীবাণু তাদের বংশ বিস্তার করে থাকে।

তাইতো যে অনুভূতিকে আমরা মন খারাপ কিংবা মন ভালো থাকা বলছি, সেটা অনেকটাই আমাদের শরীরে বীরদর্পে বাস করা জীবাণুদের ষড়যন্ত্র!