শ্রমের হাটে ‘অবিক্রিত শ্রমিক’!
তখন সকাল আটটা, চারিদিকে গ্রীষ্মের সূর্যের খরতাপ ছাড়ানো শুরু হয়েছে বেশ আগেই। তখনও দোকানপাটগুলো সেভাবে খোলেনি। সূর্যের তাপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সাঁটারবন্ধ দোকানে সামনে বসে আছেন বেশ কয়েকজন শ্রমজীবী মানুষ। কারো হাতে ব্যাগ, কারো হাতে কোদাল, কেউবা আছেন বালতি নিয়ে! অন্য দিনগুলোতে তাদের মধ্যে ‘স্যার কাজে লাগবে নাকি?’- এমন হাঁক-ডাকের ব্যতিব্যস্ত দেখা গেলেও আজকে সবার মধ্যে কেমন জানি নির্লিপ্ততা! অসহায় চাহনি!
এ চিত্র রাজধানীর আজিমপুর, নাখালপাড়ার অলিখিত শ্রমের হাটের! লকডাউনের আগে এখানেই চলতো জমজমাট শ্রম বিকিকিনি! কিন্তু লকডাউন-বিধি নিষেধের খপ্পরে পড়ে শ্রমের হাটে অবিক্রিত থেকে যাচ্ছেন ‘শ্রমজীবী মানুষ’।
দেশে করোনার প্রকোপ রোধে বাড়ছে দফায় দফায় লকডাউন। সব কিছুতে থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি! আর এতে সবচে অসহায় হয়ে পড়েছেন নগরীর দিনমজুর পেশার মানুষ। লকডাউনের প্রভাব পড়েছে তাদের দৈনন্দিন জীবনে। এক সময়ের স্বল্প আয়ের সুখী পরিবারগুলো এখন অনিশ্চয়তা-অসচ্ছলতায় দিন কাটাচ্ছেন। পড়েছেন মহা আর্থিক সংকটে। এমন ভয়ঙ্কর সংকট স্বাভাবিক হতে কতদিন লাগবে সেটাও অনিশ্চিত!
দিন যত যাচ্ছে কর্মহীন খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা যেন তত বাড়ছেই। যারা আগে অন্য কোন পেশায় জীবন ধারণ করতেন। করোনা তাদের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। কর্ম হারিয়ে কেউ কেউ তার পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে খুঁজে বেরাচ্ছেন কাজ।
রাজধানীর মিরপুর ১ ও ১০ নম্বর ওভারব্রিজের নিচে, ১৪ নম্বরের রাস্তার পাশে, মহাখালী ফ্লাই ওভারের নিচে, রেললাইনের ওপর, নাখালপাড়া রেলগেটে বড় মসজিদের সামনে, রেললাইনের পাশে, সাতরাস্তার মোড়ে, মগবাজার ফ্লাই ওভারের নিচে, হাতিরপুল মোড়ে, পান্থপথ সিগন্যালে, আজিমপুর, সেকশন বিডিআর গেটসহ অনেক জায়গায় সকালের সূর্য ওঠার আগেই নানা বয়সী নারী, পুরুষ আসেন কাজের খোঁজে। কারো হাতে কোদাল, কারো হাতে রং করার বালতি, কারো হাতে রাজমিস্ত্রীর যন্ত্রপাতি, আবার কেউ আসেন খালি হাতেই। এইসব স্থানে কাজের আশায় ভিড় করেন তারা। যারা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বিনিময়ে সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শ্রম বিক্রি করেন।
লকডাউনে রাজধানীতে সরজিমনে ঘুরে খেটে খাওয়া এসব মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের করুন পরিস্থিতির কথা। এমন দিন মজুর শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তাদের কর্মক্ষেত্র।
রাজধানীর পান্থপথ সিগনালে কাজের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন রাজমিস্ত্রী আবদুল হাকিম। তার সাথে আছেন তার হেলপার মজনুও। তাদের জানালেন, করোনায় সব বন্ধ হওয়ার পরে তাদের নির্মাণাধীন ভবনের কাজ আর ধরা হয়নি। ফলে তারা হারিয়েছে কাজ। রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে যদি কারও প্রয়োজনে পড়ে। যদি কাজের বিনিময়ে কিছু টাকা পাওয়া যায়-এই আশায়।
তারা জানান, আগে এমন সব স্থানে দাঁড়ালে ঠিকাদাররা তাদেকে দিন চুক্তিতে ৭০০-১০০০ টাকায় নিত। কিন্তু এখন করোনার কারণে কোন ঠিকাদার কাজ শুরু করছেন না। ফলে তাদের মতো অনেক রাজমিস্ত্রী আর হেলপার কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
মগবাজার ফ্লাই ওভারের নিচে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে বসে আছেন রং মিস্ত্রী লিটন ও তার সহকারী বাবর। রং মিস্ত্রী পেশায় তিনি ঢাকা শহরে ২৫ বছর। করোনা শুরুর আগে তিনি মাসে প্রায় ২২- ২৩ দিন কাজ পেয়েছেন, আর এখন করোনা আর লকডাউন মিলিয়ে মাসে কাজ পেয়েছেন ৮ থেকে ১০ দিন। এমনকি শেষ এক সপ্তাহ তিনি কোন কাজেই জোটাতে পারেননি।
তিনি বলেন, করোনায় কেউ বাইরের লোক বাসায় নিতে চান না। লোকজন কাজ বন্ধ করে দেয়, অতি প্রয়োজনীয় না হলে কেউই এই সময়ে কাজ করান না।
লকডাউনের দিনগুলোতে সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছেন নারী শ্রমিকরা। কাজের কমে যাওয়ার কারণে পুরুষ শ্রমিকরা কম পারিশ্রমিকে কাজ করায় কাজ পাছেন না নারী শ্রমিকরা।
কড়াইল বস্তির বাসিন্দা বিধবা রাহেলা বেগম মহাখালী ফ্লাই ওভারের নিচে রেললাইনের ওপর বসে অপেক্ষা করছেন। বড় মেয়ের বিয়ে দিলেও বাকি এক মেয়ে আর প্রতিবন্ধী ছেলের মুখে খাবার তুলে দিতে টাইলস মিস্ত্রীর সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করেন তিনি।
বিধবা রাহেলা জানান, করোনা আর লকডাউনের কারণে কাজ কম। আর কাজ কম থাকায় পুরুষ শ্রমিকরা অল্প হাজিরায়ও কাজ করছেন। যে কারণে তার মতো অনেক নারী শ্রমিকরাই কাজ পাচ্ছেন না।
আব্দুল হাকিম, লিটন, বাবর কিংবা রাহেলা বেগমের মত অসংখ্য নারী পুরুষের সংসার চলে এই শ্রমের হাটে এসে শ্রম বিক্রির অর্থ দিয়েই। তবে চলমান করোনা সংকট ও লকডাউনের কারণে চিন্তিত এই সকল অসহায় দিনমজুর মানুষগুলো। সামনে আবার কঠোর লকডাউন দিলে কিভাবে কাটবে তাদের জীবন? এখন করোনা ও লকডাউনের মাঝে বেঁচে থাকাটাই যেন তাদের মূল ভাবনা!