ভাঙনে ঘর হারাচ্ছেন চরবাসী
মাত্র আট বছর আগেও ২৪ বর্গকিলোমিটারের একটি চর ছিলো রাজশাহীর পদ্মার ওপারে। এখন আছে দেড় বর্গকিলোমিটারের মত। এটির নাম চরখিদিরপুর। এ বছর পদ্মায় পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে চরটি আবার ভাঙতে শুরু করেছে। গত ১৫-২০ দিনে ঘর ভেঙে নিতে হয়েছে অন্তত ৫০টি পরিবারকে।
গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মার পাড় ঘেঁষা বাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিতে মানুষের ব্যস্ততা যাচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এবারই প্রথমবারের মত ঘর ভাঙছেন না তাঁরা। আগেই কয়েকদফা ঘর ভেঙে এখানে ছিলেন। এখন সেখানেও এসেছে পদ্মা। তাঁদের দূরে সরতে হচ্ছে। চরখিদিরপুরে ভাঙা ঘরের উঠানে বসে সকালের খাবার খাচ্ছিলেন নূরুল হুদা শেখের স্ত্রী রমেনা বেগম (৬১)।
তিনি বললেন, পদ্মা নদীর ভাঙনের কারণে চারবার বাড়ি ভাঙার পরে তাঁরা এই ভিটায় বাড়ি করেছিলেন। গত তিন দিনের ভাঙনের এই ভিটাও এখন ভেঙে যাচ্ছে। সরকারি কোনো লোক এসেছে ভেবে দূর থেকে ছুটে এলেন সুবেদা বেওয়া (৫৫)। বললেন, তাঁর চারটা মেয়ে। কাজের কোনো মানুষ নেই। আয়-রোজগারেরও কোনো লোক নাই। মেয়েদের নিয়ে তিনি কোনোরকমে বেঁচে আছেন। ঘর ভেঙে আরেক জায়গায় তোলার টাকা পয়সাও নেই। কোথায় তুলবেন সেই মাটিও নেই। তার আকুল আবেদন, সরকার যেন তাঁর মতো মানুষের পুর্নবাসনের একটা ব্যবস্থা করে দেয়।
গ্রামের পশ্চিম পাশে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে বাড়ি ছিল সাইফুল ইসলামের। সেই বাড়ির অর্ধেক ভাঙা হয়ে গেছে। বেড়া ভাঙা একটি চৌকির ওপরের বাড়ির মেয়েরা মুখ মলিন করে বসে রয়েছেন। একইভাবে চেনু বেগম (৬০) তাঁর ঘর ভেঙে বসে আছেন। কোথায় ঘর করবেন তা ঠিক করতে পারেননি। ভীষণ হতাশা নিয়ে চেনু বললেন, ‘ভাঙনের কারণে দশবার বাড়ি ভাঙতে হয়েছে। উপরদেশে (চরের বাইরে) আমহার কোনো জায়গা নাই। কোথায় যাব?’
গ্রামের লোকজন জানালেন, আগে এই গ্রামে ৬০০ পরিবার ছিল। এখন ১৫০টি হবে। সেটিও এবার কমে যাবে। পদ্মা যত কাছে আসছে, মানুষগুলো তত সীমান্তের দিকে আশ্রয় নিচ্ছেন। কিন্তু বিএসএফ আবার সীমান্তের খুব কাছে ঘর তুলতে দেয় না। এবার তাঁরা পড়েছেন বেকায়দায়।
চরখিদিরপুর গ্রামটি পড়েছে পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নে। পুরোটাই নয় নম্বর ওয়ার্ড। ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য এরশাদুল হক বলেন, ‘ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় করোনা ছড়িয়ে পড়লেও এই গ্রামের কোনো মানুষের মধ্যে করোনার কোনো উপসর্গ পর্যন্ত নেই। এত সুন্দর এই গ্রামটা আমরা নদী ভাঙন থেকে বাঁচাতে পারলাম না। ভাবলে খুব কষ্ট হচ্ছে।’
হরিয়ান ইউপি চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, নদীর ওপারে ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড। সাত-আট বছর আগে আট নম্বর ওয়ার্ড ছিলো। এখন একটুও নেই। ৯ নম্বর ওয়ার্ডটি ছিলো প্রায় ২৪ বর্গ কিলোমিটারের। এখন দেড় বর্গ কিলোমিটার হতে পারে। ১৫-২০ দিন ধরে সেটুকুও ভাঙছে। আগে গ্রামে দুটি স্কুল ছিল। একটি এপারে নিয়ে আসা হয়েছে। আরেকটা একেবারেই সীমান্তের পাশে রয়েছে। একটা মসজিদ কাম মাদ্রাসা ছিল। গ্রামের লোকেরা চাঁদা তুলে শহর থেকে ইট নিয়ে গিয়ে নির্মাণ করেছিলেন। এবার সেটিকেও ভেঙে নিতে হয়েছে।
তিনি জানান, গত ১৫-২০ দিনে প্রায় ৫০টি পরিবারকে ঘর ভেঙে নিতে হয়েছে। দু’একজন এপারে আসতে পেরেছেন। বাকিরা চরে যেটুকু জায়গা পাচ্ছেন, সেখানেই থাকছেন। তিনি বলেন, পদ্মায় পাশেই একটা চর জেগেছে। প্রশাসন যদি চায় তাহলে ঘরভাঙা মানুষগুলোকে সেখানে পুনর্বাসন করতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা নদীর ওপারে বাঘা ও গোদাগাড়ী উপজেলার চরেও ভাঙন শুরু হয়েছে। অনেকে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। হুমকির মুখে পড়েছে বাঘার পলাশী ফতেপুর গ্রামের একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। পদ্মায় পানি যত বাড়ছে তত আতঙ্ক বাড়ছে এপারের মানুষের মধ্যেও।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার (১৪ জুলাই) দুপুরে রাজশাহী নগরীর বড়কুঠি পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিলো ১৫ দশমিক ৩৩ মিটার। গত ২০ জুন ছিলো ১২ দশমিক ৫৬ মিটার। আর ১ জুন ছিলো ১১ দশমিক ২১ মিটার। গত মে মাস থেকে পদ্মায় পানি বাড়ছে। রাজশাহীতে পদ্মার পানির বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। তবে তার আগেই চরাঞ্চলে শুরু হয় ভাঙন।