দেশের দরিদ্রতম উপজেলা রাজীবপুর
বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলা কুড়িগ্রাম। আর উপজেলা ভিত্তিতে কুড়িগ্রামের রাজীবপুর এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যছড়ি এবং আলীকদম দেশের সবচেয়ে দরিদ্রপ্রবণ উপজেলা।
সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর করা এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ‘এক্সট্রিম পোভার্টি দ্য চ্যালেঞ্জেস অব ইনক্লুশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের হিসেব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএসের) ২০১৬ সালের জরিপে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল একই। পরবর্তী বছর গুলোতে দারিদ্র্যের হার কমতে থাকলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ এর ফলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে আগের অবস্থানে ফিরেছে।
প্রতিবেদনে প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, অতি দরিদ্র মানুষের হার সবচেয়ে বেশি কুড়িগ্রাম জেলায়। এই জেলার ৫৩ দশমিক ৯ বা প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ অতি দরিদ্র। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বান্দরবান জেলা এখানকার ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ অতি দরিদ্র।
রংপুর অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস বার্তা২৪.কমের কাছে বর্ণনা করছিলেন কলামিস্ট নাহিদ হাসান নলেজ।
তিনি বলেন, মোগল আমলে উত্তরবঙ্গ ছিল দেশের অর্থনীতির মূল মেরুদণ্ড। সারা বাংলা থেকে যা খাজনা আদায় করা হতো তার প্রায় অর্ধেকের বেশি আয় হতো রংপুর অঞ্চল থেকে।হিমালয় পাহাড়ের পাদদেশে এবং সবচেয়ে সমতলভূমি হওয়ায় এই এলাকার মাটি ছিল খুব উর্বর। পাট, ধান এবং তামাকের চাষে এ অঞ্চলের মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বছরের খোরাক জোগাড় করতো। কিছু উদ্বৃত্ত থাকতো। কিন্তু দেশে যখন কৃষি থেকে শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়েছে তখন থেকে গুরুত্ব হারাতে শুরু করে এ অঞ্চল। পরবর্তীতে আর গুরুত্ব পায়নি কখনোই। দেশের সব অঞ্চলের জন্য সমানভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা হয়নি। এখনও এসব অঞ্চলে শিল্পায়নের বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই তাই দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত এখানকার জনজীবন।
বাংলাদশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০.৮ শতাংশ। জেলার ৯ টি উপজেলা ভিত্তিক দারিদ্র্যের হার ছিল রাজীবপুরে ৭৯.৮, রৌমারী ৭৬.৪,চিলমারী ৭৩.৫,উলিপুর ৭০.৮, রাজারহাট ৭০.১, কুড়িগ্রাম সদর ৭২.৬, ফুলবাড়ি ৬৯.০, নাগেশ্বরী ৭২.৭ এবং ভূরুঙ্গামারীতে ৭১.৯ শতাংশ।
একই জরিপে বান্দরবানের থানচি উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ছিলো ৭৭.৮, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৬৫.৮ এবং আলীকদম উপজেলায় ৬৯.১ শতাংশ।
এক্সট্রিম পোভার্টি দ্য চ্যালেঞ্জেস অব ইনক্লুশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে আরও জানা গেছে, নদ নদীময় কুড়িগ্রাম জেলায় গুরুতর অসুস্থায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় সংখ্যা ৫৭ শতাংশ। ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ৬০ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ে মাত্র ৮ শতাংশ। দিনমজুর শ্রমিক সংখ্যা এই জেলায় ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যুক্ত রয়েছেন জেলার ১৩ শতাংশ মানুষ, যা জাতীয় পর্যায়ে ৩৫ শতাংশ। নারীপ্রধান পরিবার গুলোতে অতি দরিদ্রের হার ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ, যা জাতীয় পর্যায়ে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ।
এই জেলায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম স্থায়ী কারণ নদী ভাঙন। প্রতিবছর প্রায় ৫৫ হাজার পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে দারিদ্রতার কবলে পড়েন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কুড়িগ্রাম জেলা পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থানের অভাব। দারিদ্র্যপ্রবণ এ জেলায় বছরের সব সময় মানুষের হাতে কাজ থাকে না। আর যেসময় কাজ থাকে, তখন ন্যায্য মজুরিও পান না অনেক সময়। সরকার যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে সেখানেও অনিয়ম হয়।প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যগত সমস্যাও তাদের এই জনপদের মানুষের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
কর্মসংস্থানের অভাব এবং স্থানীয় চাহিদা ও সম্ভাবনা বিবেচনায় কার্যকরী উদ্যোগ না নেওয়ায় দারিদ্র্যের কবল থেকে বের হতে পারছে না বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৬ সালে বিবিএস এর খানা আয়-ব্যয় জরিপ প্রথমবারের মতো জেলাওয়ারি দারিদ্র্যের জরিপ করা হয়। জরিপে দেখা যায়, দেশের মোট দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। কিন্তু কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, মাগুরা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন।
ওই জরিপ করার দীর্ঘ ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এই জেলায় জরিপে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সমস্যা দূর করার লক্ষে দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করায় হতাশা প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, সরকারি জরিপ করা তথ্য নিয়ে যদি কোন কর্ম পরিকল্পনা তৈরি না করে তাহলে এই জরিপের কার্যকারীতা কি।
সংশ্লিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের বেশ কিছু কর্মসূচি আছে। কিন্তু এ কর্মসূচির লক্ষ্য নির্ধারণে কিছুটা সমস্যা আছে। অনেক জায়গায় এলাকা চিহ্নিত করার কাজটি ঠিকভাবে হয়নি। অতিদরিদ্র এলাকাগুলোতে যে পরিমাণে সামাজিক সহায়তা পৌঁছানোর কথা ছিল তাও পৌঁছায়নি। আবার দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় যে পরিমাণ সহায়তা যাচ্ছে তা গরিব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে না। নগদ টাকা ও খাদ্য সহায়তা বিতরণে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম রয়েছে। শুধু সামাজিক সুরক্ষার ওপর ভিত্তি করে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন হবে না। স্থানীয় পর্যায়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে শ্রম এবং আয় বাড়াতে হবে।
রাজীবপুর উপজেলার রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সদস্য সচিব শিপন আহমেদ বলেন, কুড়িগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান এই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, সোনাভরি, জিঞ্জিরাম সহ ১৬টি নদী এ জেলার উপর দিয়ে চারপাশে জুড়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা ও নদীভাঙন এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে বড় বাধা। এ থেকে জনগণকে রক্ষার বিশেষ বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা দরিদ্র মানুষগুলোকে শুধু ভোটের সময়ই মনে করে! স্থায়ী ভাবে নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে কার্যকরি পদক্ষেপ এবং শিল্পকারখানা অথবা ইপিজেড নির্মাণ করে স্থায়ী কর্মসংস্থানের উদ্যোগ না নিলে এই অঞ্চলের দারিদ্রতা দূর করা সম্ভব হবে না।