‘বন্যায় সব ভিজে গেছে, ঘুমাতে পারি না’

  বন্যা পরিস্থিতি
  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম,লক্ষ্মীপুর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বন্যায় ঘরে কোমর সমান পানি, ছবি: বার্তা২৪.কম

বন্যায় ঘরে কোমর সমান পানি, ছবি: বার্তা২৪.কম

"শুইবার খাটের এক অংশ ভাঙা, আরেক অংশে কোনমতে চেপে বসে আছি। খাটের সামান্য একটু জায়গায় কষ্ট করে ঘুমাই। তোষক ভিজা, বালিশ ভিজা। অবস্থা খুবই খারাপ। এভাবে কি ঘুম আসে ভাই?" এই আর্তনাদ লক্ষ্মীপুরের পানিবন্দী ষাটোর্ধ্ব ফিরোজা বেগমের। স্ত্রীর পাশাপাশি আর্তনাদ আছে স্বামী আলী আকবরেরও। থাকার ঘর, রান্নার, টয়লেট সবকিছু পানির নিচে থাকায় কোনোরকম সেই ঘরে দিনযাপন করছেন তারা।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের পশ্চিম জামিরতলী গ্রামে এই বৃদ্ধ দম্পতির বসবাস। মান্দারী-দিঘলী আঞ্চলিক সড়ক থেকে তাদের বাড়িটা কিছুটা দূরে। বন্যা কবলিত এ দম্পতি এখন চরম দুর্দশাগ্রস্ত। সড়ক থেকে বাড়ি পর্যন্ত কোমর সমান পানি। আর বসতঘরে আছে হাটু পানি।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (২৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় বৃদ্ধ এ দম্পতির বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে এই করুণ চিত্র। ফিরোজার সত্তর উর্ধ্ব স্বামী আলী আকবর পেশায় একজন কৃষক৷ কৃষি কাজ করে যে আয় করতো তা দিয়েই তাদের সংসার চলতো। দীর্ঘ সময় পানিবন্দী থাকায় চলাফেরা, রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া, পয়ঃনিষ্কাশন, সুপেয় পানির অভাব, রোগবালাই এবং চরম অর্থকষ্টে এখন তাদের পরিবার। তাদের আশেপাশের লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে উঠলেও বাড়িতেই রয়ে গেছেন এই বৃদ্ধ দম্পতি।

সরেজমিনে দেখা যায়, পানির মধ্যে থাকা একটি চৌকিতে অসহায় অবস্থায় বসে আছেন ফিরোজা বেগম। ঘরের ভেতরে এবং আশপাশের অথৈ পানি।

বিজ্ঞাপন

বন্যার কারণে তাদের পারিবারিক পরিস্থিতি নিয়ে ফিরোজা বেগম বলেন, খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অনেক কষ্টে আছি আমরা। রান্নার কাজ কিভাবে হয় জানতে চাইলে পাশেই থাকা টেবিলের উপর একটি গ্যাসের চুলো দেখিয়ে বলেন, এ চুলোতে কোন রকমে একটু রান্না করি। এখন জান বাঁচানো ব্যাপার। চিড়ামুড়ি খেয়ে কাটাই। ত্রাণ হিসেবে মানুষে দিয়েছে, একটু খেয়ে জান বাঁচাই।

আরেকটি চৌকিতে বসে আছেন ফিরোজা বেগমের স্বামী আলী আকবর। আলী আকবরের চৌকিতে বন্যার পানি ছুঁই ছুঁই অবস্থায়। আরেকটা পানি বাড়লে চৌকির কোনো অংশেই বসা যাবেনা।

এই দুর্দিনে কীভাবে তারা এই অর্ধ ডুবে যাওয়া ঘরে থাকছেন তা বর্ণনা করেছেন আকবর আলী নিজেই। জানান, ঘরে তিনটি চৌকি আছে। তার মধ্যে দুটি চৌকি পানির নিচে। এই একটি ইট দিয়ে উচু করে নিয়েছি। এই চৌকিরও একটা অংশ কিছুটা ভাঙা। তবে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভিজা থাকায় ঠিকমত ঘুমাতেও পারছিনা।

খাবার পানির সংকট নিয়ে ফিরোজা বেগম বলেন, খাবার পানি কেউ হয়তো এক বোতল দেয়। অল্প অল্প করে পান করি। দোকান থেকেও বোতল কিনে আনে। পানিতে হাঁটতে হাঁটতে ঠান্ডা এবং কাঁশি লেগে গেছে। এছাড়া চাহিদা অনুসারে ত্রাণ সামগ্রীও পাননি বলে জানিয়েছেন তিনি।

নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে ফিরোজা বেগম আরো বলেন, অনেক হাঁস-মুরগি ছিল, হঠাৎ পানি এসে ডুবিয়ে মেরে ফেলেছে। মরা মুরগি ভেসে উঠে। কয়েকটা হাঁস আছে। কলা গাছের ভেলাতে কোনরকমে তাদের আশ্রয় দিতে পেরেছি। খাবার ঠিকমতো দিতে পারি না। নিজেদের খাবারই জুটে না আবার হাঁস-মুরগির খাবার! নিজের পেট নিয়েই টানাটানি। তিনটা গরু আছে, কম পানির সময় পাশের বাড়িতে রেখেছি। পানি বেশি হওয়ার সড়কের পাশের একটি জায়গায় রেখে দিই। এ মূহুর্তে গরুর খাবার, হাঁস-মুরগির খাবার, মানুষের খাবার- সবি জটিল হয়ে গেছে।

ফিরোজার স্বামী বৃদ্ধ আলী আকবর বলেন, ঘরে আমার বৃদ্ধা স্ত্রী আর ছেলে থাকে। রাস্তার পাশে গরু রাখা আছে, রাতে গরু পাহারা দিতে হয়। তাই আমি গরুর পাশেই থাকি। দিনে-রাতে মিলিয়ে বেশ কয়েকবার কোমর পানি মাড়িয়ে বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে হয়। খুবই কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার তো নাই। আয়-ইনকামও নাই। গরু বাছুর আছে, দুধ বিক্রি করে কিছু টাকা পেতাম। কিন্তু এখন তো গরুকেই খাওয়াতে পারি না, দুধ দিবে কীভাবে?

লক্ষ্মীপুরে চলমান বন্যা পরিস্থিতির এখনো চরম অবনতি। এতে পানিবন্দী লোকজনের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠলেও বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠতে অনাগ্রহী। চরম দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বসবাস করছে এ জেলার ৫ টি উপজেলার বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা। জেলার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি এলাকা এখনও পানিতে তলিয়ে আছে।