করোনা মোকাবিলায় যুব ইউনিয়নের উদ্যোগ
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসযে কোনো দুর্যোগে, বিপর্যয়ে নিজেদের জায়গা থেকে সব সময় এগিয়ে এসেছেন এদেশের তরুণরা। এবারও করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ আশা জাগিয়েছে।
‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’-এ আপ্তবাক্যটিতে ১৯৭৬ সালের ২৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন প্রেরণা পায়।
আজ বিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে আক্রান্ত, তখন সেই মধ্যবিত্ত অকর্মারা কভিড-১৯ ভলান্টিয়ার গ্রুপ করে নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে মেহনতি নিম্নবিত্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। মানুষের দ্বারস্থ হচ্ছে সাহায্যের জন্য। আর সেই সাহায্যের অর্থ দিয়ে খাবার কিনে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে প্রান্তিক মানুষের দ্বারে।
পেছনের কথা
১৯৮৭ ও ৮৮ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যা হলো। সে সময় বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন থেকে সেগুনবাগিচা অফিসে কেন্দ্রীয়ভাবে খাবার স্যালাইন তৈরি করার কাজ শুরু হয়। দলে দলে ছাত্র-তরুণরা এ কাজে অংশগ্রহণ করেন। সবাই স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে। যুব আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠল। যুবকরা ছাড়াও সেই সময়ের বিভিন্ন রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এ কাজে সরাসরি জড়িত হন। মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা টনের পর টন চিনি সরবরাহ করেন। ১০ লক্ষাধিক স্যালাইন উৎপাদন করা হয়। সারাদেশে তা বিতরণ করা হয়। সেই সময়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত মোহাম্মদ ফরহাদ চিকিৎসার জন্য মস্কোতে। হঠাৎ একদিন তিনি যুব ইউনিয়নের সবার উদ্দেশে লিখলেন, ‘আপনারা এতদিন পর বোধ হয় পথ খুঁজে পেয়েছেন। আপনাদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। এ ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মানুষের মধ্যে আত্মনির্ভরতার চিন্তা আসবে এ ধরনের কাজ থেকে, আপনাদের ওপরও আস্থা বাড়বে।’ এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, কমরেড ফরহাদের সেদিনের সেই চিরকুটটি বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের আগামী দিনের কাজে প্রাণ সঞ্চার করেছে।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক উৎপাদন
সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সচেতনতার পাশাপাশি চলতি মাসের ২০ তারিখ সকালে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানী পুরানা পল্টনস্থ প্রগতি সম্মেলন কক্ষে একটি ল্যাব স্থাপন করে স্যানিটাইজার উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। সেদিন উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সঙ্গে ছিলেন সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ।
হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কাঁচামাল সংগ্রহ করে টানা কর্মযজ্ঞ শুরু করে সংগঠনের হাফিজ আদনান রিয়াদ, খান আসাদুজ্জামান মাসুম, ডা. সাজেদুল হক রুবেল, তসলিম সাখাওয়াত, শিশির চক্রবর্তী, অভিনেত্রী সুমনা সোমা, ত্রিদিব সাহা, শরিফ-উল আনোয়ার সজ্জন, আশিকুল ইসলাম জুয়েল, হাবীব ইমন, রাসেল ইসলাম সুজন, আসাদুজ্জামান আজিম, গোলাম রাব্বী খান, আনোয়ার হোসেন, জাহিদ নগর, রামীমসহ আরো অনেকে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এ কর্মসূচি চালানো হচ্ছে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম জানান, যুব ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা আশা করছেন, ১০ লাখ মানুষের কাছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক পৌঁছাতে সক্ষম হবেন। ঢাকা ছাড়া এরই মধ্যে চট্টগ্রামেও স্যানিটাইজার উৎপাদন শুরু করেছে। তাছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে মাস্ক উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা অনুযায়ী ৭০ শতাংশ আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল, গ্লিসারিন, লেমন ওয়েল ও ডিস্টিলড ওয়াটার ব্যবহার করে এ স্যানিটাইজার তৈরি করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও কাঁচামালের সংকট
সংগঠনের সভাপতি হাফিজ আদনান রিয়াদ জানান, তারা আট-১০ জন নেতাকর্মী মিলে কাজ শুরু করেন। তাদের আর্থিক সংকট ছাড়াও কাঁচামাল সংকটে পড়তে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঁচামাল সংকট। দেশে করোনা পরিস্থিতিকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা কাঁচামালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন। বোতলও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ও বিতরণের জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রস্তুত থাকলেও কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে বড় পরিসরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক উৎপাদন করতে পারছি না। হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিংবা মাস্ক তৈরির পেছনে আমাদের কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই। বরং আমরা উৎপাদিত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক ঢাকাসহ দেশের নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। এছাড়া আমরা ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের কাছেও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেছি। আমরা মনে করি, এটা আমাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান
সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষদের কথা বিবেচনায় নিয়ে কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
অসাধু ব্যবসায়ীদের রুখে দিতে ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বলে জানান যুব ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই উপকরণগুলো কিনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু বোতল ও কেমিক্যাল সংকট বাধার সৃষ্টি করছে। সবার সহযোগিতা পেলে যুব ইউনিয়ন ১০ লাখ বোতল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি ও বিতরণ করবে। যারা সহযোগিতা করতে চান, তারা ০১৮৪২১৮০৮৭৬ (নগদ), ০১৮৪২১৮০৮৭৬৩ (রকেট), ০১৭১৭১২০০১২ (বিকাশ) এ আর্থিক সাহায্য পাঠাতে পারেন।
বৃহত্তর মিরপুরে গৃহহীন ও নিম্ন আয়ের জন্য খাবার সরবরাহ
ঢাকার বৃহত্তর মিরপুর থানার ঘরহীন, নিম্ন আয়ের একটা পরিবারের জন্য সাত দিনের খাবার, যেমন পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, পাঁচ কেজি আলু, এক কেজি পেঁয়াজ, এক লিটার তেল, আধা কেজি লবণ, একটি হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাঠাচ্ছে যুব ইউনিয়নের ঢাকা মহানগরের কাফরুল থানা।
ঢাকা মহানগরের সভাপতি হাবীব ইমন বলেন, যুব ইউনিয়ন উত্তরার তুরাগের বিভিন্ন মোড়ে জনসাধারণের জন্য হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে। ধানমন্ডি থানার বিভিন্ন জায়গায় ব্লিচিং পাউডারের মিশ্রণ জীবনুনাশক স্প্রে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যান্য থানাও তাদের সাধ্যমত জনগণকে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি অন্যান্য সংগঠনকেও এসব স্বেচ্ছাশ্রম কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।