নিরাপদ সড়কের লড়াকু যোদ্ধা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

দিনটি ছিল ২২ অক্টোবর, ১৯৯৩ সাল। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সিনেমার শুটিং দেখতে স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন কক্সবাজার যাওয়ার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সে বছরই ১ ডিসেম্বর থেকে ‘নিরাপদ সড়ক নিরাপদ জীবন’ শ্লোগান নিয়ে মাঠে নামেন ইলিয়াস কাঞ্চন। তারপর থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের জন্য দেশব্যাপী অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন যেন নিরাপদ সড়কের লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণ একজন লড়াকু যোদ্ধা।

‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’-এর উদ্বোধনী সেমিনার হয়েছিল ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালের মিলনায়তনে। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসাবে তাতে যোগ দেন। এটিএম শামসুজ্জামান, মিজু আহমেদসহ অসংখ্য চলচ্চিত্র অভিনেতার উপস্থিতিতে সে সেমিনারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক হিসাবে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিল আমি। চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি ‘বাচসাস’-এর সভাপতি প্রয়াত গোলাম কিবরিয়া ছিলেন সে আয়োজনের নেপথ্যে। সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক-কথাশিল্পী রাহাত খানের ভাগ্নে, সাংবাদিক আলীমুজ্জামান হারুসহ আরও অনেকেই।

বিজ্ঞাপন

স্বজন হারানোর বেদনায় দীর্ণ নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সেদিন নিরাপদ সড়কের জন্য যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন, তা শুধু আবেগ ও হাহাকার ছিল না। ছিল রোড সেফটি বা নিরাপদ সড়কের দাবিতে হৃদয় নিঙড়ানো শপথের দৃঢ় উচ্চারণ। দিনে দিনে তা আরও সমৃদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় ‘নিরচা’ বা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দাবি ধ্বনিত করেছেন তিনি। তরুণ-যুবকদের সম্মিলনে গড়েছেন কমিটি। জনসমাজ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠার অব্যাহত চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে এই ভয়ঙ্কর সামাজিক সমস্যাটির সমাধানে হার-না-মানা লড়াকু যোদ্ধার মতোই অবিরাম লড়ে চলেছেন তিনি।

নিরাপদ সড়কের জন্য প্রচার-প্রচারণার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল-কলেজের তরুণ শিক্ষার্থী, চালক ও হেলপারদের সচেতনামূলক নানা প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্পেইনেও ইলিয়াস কাঞ্চন নিত্য নিয়োজিত আছেন। কখনো তাকে পরিবহণ সেক্টর অসম্মান করার চেষ্টা করেছে; শত্রু হিসাবে ভুল বুঝেছে। কিন্তু তিনি কারও বিরুদ্ধে নয়, নিরাপদ সড়কের পক্ষে থেকে নিজের মহৎ মানবিক সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েই যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের শহর ও প্রত্যন্ত এলাকায় আন্দোলন, সংগঠন গঠন ও প্রচারণার পাশাপাশি ২০১৫ সালের ৪ মে জাতিসংঘের ‘রোড সেফটি প্রোগ্রাম’-এ যোগ দিয়েও তিনি ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দাবিটিকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপন করেছেন।

বিজ্ঞাপন

সড়ক বা অন্যান্য দুর্ঘটনায় বহুজনই স্বজন-পরিজনকে হারান। কিন্তু সবাই সেই হারানোর বেদনা ও যন্ত্রণাকে ব্যক্তিগত স্তরের বাইরে নিয়ে এসে সামাজিক পরিবর্তনের ইতিবাচকতায় উপস্থাপন করতে পারেন না। ব্যক্তিগত দুঃখের গহ্বরে ব্যাথা-বেদনাকে ধরে রেখে তিলে তিলে আগুনে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে সে বেদনাকে দূরীকরণের জন্য মানুষের মধ্যে নিবেদিত হওয়ার গৌরব সবাই লাভ করেন না। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ব্যক্তিগত কষ্ট-বেদনাকে সামাজিক কল্যাণ অর্জনের পথে নিয়ে গিয়ে সৃজন করেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত।

সমাজের নানা কুসংস্কার, অসঙ্গতি ও সমস্যাকে ব্যক্তিগত কষ্টের জায়গায় না রেখে সামাজিক-সম্মিলিত শক্তিতে মোকাবেলা করা হলেই সমাজ এগুবে। নইলে সমস্যা থেকেই যাবে; কষ্টও চলতেই থাকবে। কষ্ট ও বেদনার শক্তিকে সমাজ প্রগতির পথে পরিচালনার মাধ্যমেই আসবে ইতিবাচক অর্জন; ইলিয়াস কাঞ্চন সেই প্রেরণাও সবার মধ্যে জাগিয়েছেন।

১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণকারী ইলিয়াস কাঞ্চন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে লাভ করেছেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারসহ বহুবিধ সম্মাননা। অভিনয়ে বিশেষ কৃতিত্ব ও বৈশিষ্ট্যের জন্য রূপালি পর্দার এই নায়ক স্মরণীয় হয়ে আছেন সহস্র দর্শকের চিত্তে। আর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর মতো জনস্বার্থে নিবেদিত সামাজিক আন্দোলনের জন্য তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।