বিশ্ব দর্শন দিবস: মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় দর্শন
অজানাকে জানা ও দুর্জ্ঞেয় রহস্য উদঘাটন করা মানব মনের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কৌতুহলী মনের জ্ঞান অন্বেষণ, সত্য ও সঠিক জ্ঞান লাভ এবং মৌলিক, ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা থেকেই ফিলোসফি’র উৎপত্তি। ‘ফিলোসফি’ (Philosophy) শব্দের উদ্ভব হয়েছে দুটো গ্রিক শব্দ-Philos (মানে ভালোবাসা) এবং Sophia (মানে জ্ঞান) হতে। সুতরাং ফিলোসফি (Philosophy) শব্দের অর্থ হলো Love of wisdom অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। ‘ফিলোসফি’(Philosophy)র বাংলা প্রতিশব্দ হলো দর্শন, যদিও এর আরও সুন্দর প্রতিশব্দ জ্ঞানানুরাগ, জ্ঞানপ্রীতি, প্রজ্ঞাপ্রীতি প্রভৃতি রয়েছে।
তবে প্রাচীনকাল থেকে একাডেমিকভাবে ‘ফিলোসফি’বিষয়টি বাংলায় দর্শন বা দর্শনশাস্ত্র নামেই পরিচিত লাভ করেছে। মূলত জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থেকে গড়ে ওঠা জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতায় প্রাচীন যুগে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে সূচনা হয় দর্শন শাস্ত্রের এবং গড়ে ওঠে দর্শনের ইতিহাস।
পিথাগোরাসের মতে, জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ, তথা সত্যানুসন্ধানের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাই ফিলোসফির মূল লক্ষ্য। দর্শন সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের চর্চার মাধ্যমে; মুক্তবুদ্ধি ও নৈতিক চেতনাকে জাগ্রত করে বিশ্বকে পথ দেখায়, অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যায়। R.J. Hirst এর মতে- “Philosophy is a rational investigation into certain fundamental problem about the nature of man and the world he lives in”। ফিলোসফি জ্ঞান ও সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে জগত ও জীবনের মৌলিক এবং ব্যবহারিক সমস্যাবলির যৌক্তিক সমাধান করে।
ফিলোসফার বা দার্শনিক মাত্রই জ্ঞানানুরাগী, আপোসহীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির অধিকারী। জ্ঞান, সত্য ও আলোর দিশারী হবেন দার্শনিক। বৃহৎ অর্থে ফিলোসফার বা দার্শনিক বলতে আমরা শুধু একটি বিশেষ বিদ্যায় সনাতন গতানুগতিক জ্ঞানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বোঝাই না। বর্তমানকালে অভিজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, প্রকৌশলী, আইনবিদ, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, পরিবেশবিদ, জীব বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং ধর্ম বিশেষজ্ঞসহ সকল প্রকার বিজ্ঞ ও পন্ডিতব্যক্তিদের দার্শনিক হিসেবে গণ্য ও আখ্যায়িত করা হয়। কারণ, তাদের সম্মিলিত মেধা, মনন, বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ব্যতিত জীবন, সমাজ ও প্রকৃতিকে সামগ্রিকভাবে জানা সম্ভব হয় না।
দার্শনিকদের পরিচয় সম্পর্কে প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থে বলেছেন: ““He who has a taste for every sort of knowledge and is curious to learn and is never satisfied may be justly termed as Philosopher।” দার্শনিক সমাজের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তির আলোকে জগত ও জীবনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। রাষ্ট্র বা সমাজের এমন কোনো দিক নেই যেখানে দার্শনিকদের অবদান নেই। দার্শনিকরা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চায় আপোষহীন। দার্শনিকরা যুগে যুগে কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নত না করে, সকল বাঁধা অতিক্রম করে জ্ঞান চর্চা করেছেন, সত্য-সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে অগ্রসর হয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পরও গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস তার নীতি, সত্যবস্তু থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াননি। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের মতো সক্রেটিস বলেছিলেন: ““I to die and you to live. Which is better God only knows”।
মানুষ মাত্রই একটি দর্শন নিয়ে তার জীবন পরিচালিত করে। সে দর্শন তার জীবনের আশা-আকাঙ্খা এবং জীবনধারার একটি রূপরেখা তার নিজের অজান্তেই তৈরি করে। দর্শনবিহীন জীবন কল্পনা করা যায় না কেননা মানবীকরণে, মানবিক মূল্যবোধ অর্জনে, বিকাশ ও সংরক্ষণে দর্শন চিরদিন দিয়ে এসেছে যুগযুগান্তকারী দিকনির্দেশনা। সঠিক ও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বিবেচনা করলে দেখা যায় বিচার ও বিশ্লেষণমূলক, যুক্তিধর্মী ও বুদ্ধিবাদী এবং ব্যবহারিক ও জীবনভিত্তিক পর্যালোচনাই দর্শন।
ফিলোসফি বা দর্শনের আলোচ্য বিষয় বহু এবং এর পরিধি ব্যাপক। মূলত মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কোনো দিক এবং তত্ত্বালোচনার কোনো অংশই দর্শনের আলোচনার বর্হিভূত নয়। দর্শনের পরিধি ব্যাপক- জগত, জীবন, মানুষ এবং মৌলিক সমস্যা সবই দর্শনের আলোচ্য বিষয়। এক সময়ে বিস্ময় ও কৌতূহল থেকে দার্শনিক চিন্তাভাবনা শুরু হলেও তা ক্রমশ জীবন ভিত্তিক ব্যবহারিক বিষয়াবলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকে। তাই ফিলোসফি ইতিহাস, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আইনশাস্ত্র, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি এমনকি পরিবেশ ও ব্যবসার মতো বাস্তব ও জীবনমুখী বিদ্যা ও শাস্ত্রসমূহের প্রতি মনোনিবেশ করছে জীবনকে সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলা জন্য।
তবে আলোচ্য বিষয় যাই হোক না কেন, সে আলোচনা অবশ্যই যৌক্তিক, বুদ্ধিগ্রাহ্য, বস্তুনিষ্ঠ ও সুসংবদ্ধ হতে হবে।
দর্শনকে জীবন-বিচ্ছিন্ন ও অপ্রয়োজনীয় বলে অনেকে অবমূল্যায়ন করেন। বস্তুত ফিলোসফির এমন অবমূল্যায়নের মূলে একটা বড় কারণ হলো এ বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে। আমাদের মানসিকতা বর্তমানে অনেকাংশে ব্যবসায়িক এবং নগদ ব্যবহারিক মূল্য ও সাফল্য দ্বারা প্রভাবিত। ফলে সাহিত্য, দর্শন, নীতিবিদ্যা, ধর্ম ও অধিবিদ্যা কম আকর্ষণীয়। স্যাটেলাইট, স্মার্টফোন ও ফেইসবুক বিশ্বায়নের এ যুগে কতকিছু আছে তবুও যেন শান্তি নেই কোথাও। কারণ অর্থনৈতিক প্রগতিই মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের একমাত্র পথ নয়। হিংসা-বিদ্ধেষ, ক্রোধ, প্রতিযোগিতা, সংঘাত, সন্ত্রাস মানুষকে জীবনবিমুখ করে ফেলেছে। সামাজিক মানবিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে সমাজিক অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে চরম হারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচর্চা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনের মূলভিত্তি হলেও তা আমাদের জীবনকে কখনো পূর্ণতা দিতে পারবে না। এ পূর্ণতার জন্য একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথপ্রদর্শক হবে ফিলোসফি বা দর্শন।
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘সফল মানুষ হওয়ার চেয়ে সৎ ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হওয়া অধিকতর জরুরি।’ দর্শন তার যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেক, ন্যায়বোধ, নীতি- নৈতিকতা দিয়ে সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার, শোষণ প্রতিহত করে উদারতা, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধন ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করবে। জ্ঞান, সত্য ও আলোর দিশারী হবেন দার্শনিক। দর্শন হবে অগ্রগতি ও মঙ্গলের নিয়ামক।
দর্শনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ, আর এই মানব কল্যাণের জন্য প্রয়োজন যথার্থ দার্শনিক চিন্তাধারা। বর্তমান বিশ্ব দারুনভাবে নৈতিক সংকটে জর্জরিত। বিশ্বে তাই শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, উদারতা, স্বাধীনতা, পরিবেশ, ব্যবসা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সবকিছুর সাথে দর্শন ও নৈতিকতাকে যুক্ত করতে হবে। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ফিলোসফি হতে পারে কান্ডারিস্বরূপ। দর্শনের যৌক্তিক চিন্তা, ন্যায়পরতা ও সুনীতির বাণী পেীঁছে দিতে হবে সমাজের প্রতিটি স্তরে।
২০০২ সালে ইউনেস্কো সর্বপ্রথম দর্শন দিবসের ঘোষণা দেয় এবং ২০০৫ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে প্রতি বছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব দর্শন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর ‘ বিশ্ব দর্শন দিবস ২০১৮’ পালিত হতে যাচ্ছে। ইউনেস্কোর-র জেনারেল কনফারেন্সের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে- “Philosophy is a discipline that encourages critical and independent thought and is capable of working towards a better understanding of the world and promoting tolerance and peace”। মানবজাতির সামগ্রিক শুভ কামনায় ও দর্শন চর্চার সুফলকে মানবজাতির কল্যাণে প্রয়োগ করার লক্ষ্যে ইউনেস্কোর অনেক কল্যাণকামী পদক্ষেপের একটি হলো বিশ্ব দর্শন দিবস ঘোষণা।
অস্থিতিশীল বিশ্বে বিরাজমান সংকট নিরসনে, দর্শনের প্রায়োগিক ও মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করা এই দিবস পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। বিশ্ব দর্শন দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমাদের শপথ নিতে হবে- বিচারমূলক যৌক্তিক চিন্তা, দূরদৃষ্টি, নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে একটি সত্য-সুন্দর-মঙ্গলময় মানবিক বিশ্ব গড়বো। জয় হোক দর্শনের, জয় হোক মানবতার।
বেল্লাল আহমেদ ভূঞা (অনিক): লেকচারার, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।