জীবনের শেষ ক্লাস
সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের চার তলার করিডোরে বুধবার (১৪ অক্টোবর) দুপুরে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। পাশে দুই সহকর্মী ড. আশরাফ (কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি) ও ড. আবুল হোসেন (সাবেক ডিন)। প্রকাশ্যে কোনো আবেগ তাকে স্পর্শ করছে না। তথাপি চোখ দুটো কিঞ্চিত লালাভ ও অব্যক্ত অশ্রুর ছোঁয়ায় টলটলে।
একজন মানুষের জীবনে ঘটনাটি ঐতিহাসিক। সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর শিক্ষকতা জীবনের অন্তে সর্বশেষ ক্লাশটি নিয়ে তিনি বিদায় নিচ্ছেন। বনানীময় ক্যাম্পাসে তারুণ্যের আগুণে-দীপ্ত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে তিনি আর কখনোই আসবেন না। স্মৃতির পাহাড়ের মতো পেছনে থেকে যাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও তার প্রিয় অর্থনীতি বিভাগ।
‘শেষ ক্লাস নিলাম আজ’ আমাকে সামনে পেয়ে হাত মেলাতে মেলাতে বললেন অর্থনীতি বিভাগের প্রথিতযশা শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইরশাদ কামাল খান। তাঁর উষ্ণ করতলের স্পর্শে আমার ভেতরেও তখন গোপনে বইছে স্মৃতির তুষারপাত। তার অতিক্রান্ত চল্লিশ বছরের প্রায় ত্রিশ বছর তিনি ছিলেন আমাদের নিত্যসঙ্গী, সিনিয়র সহকর্মী।
নিজে গাড়ি চালিয়ে এসেছেন ক্যাম্পাসে। চমৎকার দুই কন্যাকে সঙ্গ দিয়েছেন। ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা-আলোচনায় মুগ্ধ করেছেন আমাদের মতো উৎসুক-তরুণ সহকর্মীদের। একটি আস্ত ক্যারিয়ার সাফল্যের সঙ্গে পাড়ি দিতে গিয়ে হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি, শিক্ষক সমিতির সম্পাদক, চট্টগ্রাম ইনডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
চট্টগ্রামের আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র হয়েও তিনি ছিলেন বিশ্বায়নের সন্তান। শিক্ষা ও কর্মের সূত্রে ঘুরেছেন জগতময়। প্রাইমারি থেকেই ঢাকায় রেসিডেন্টসিয়াল মডেলে। তারপর ক্যাডেট কলেজ হয়ে পূর্ব ইউরোপে। তারও পর হংকং, মেকাও এমন অনেক জায়গায়।
বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে স্বাচ্ছন্দ তাঁর। পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি মাধ্যমে। পঠন-পাঠনের মাধ্যমও ইংরেজি। বিক্রম শেঠ, অমিতাভ ঘোষের নতুন বই পড়লেই সাবলীল আলোচনা করেছেন আমাদের সঙ্গে। কলকাতা বা দিল্লি থেকে ফিরে এলে নতুন বই বা নতুন বিষয় নিয়ে অবধারিতভাবে কথা বলেছেন। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে তথ্য ও উপাত্তের দিক থেকে সব সময় থেকেছেন আপ-টু-ডেট।
চট্টগ্রাম সম্পর্কে তাঁর রয়েছে প্রত্যক্ষ জ্ঞান। দক্ষিণ পটিয়ার এই জাতক আনোয়ারা-দিয়াঙ এলাকার খ্রিস্টান সমাজ ও সংস্কৃতির অনেক কিছুই জানতেন। সারা জীবন চট্টগ্রাম শহরে নাগরিক জীবন-যাপনের সুবাধে শৈশবের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠী, হারিয়ে যাওয়া চীনা সম্প্রদায়, গুজরাতি, আগা খানি ইত্যাদি জাতি সম্পর্কেও সরাসরি অর্জন করেন পরিচ্ছন্ন ধারণা।
চট্টগ্রাম শহর থেকে দূরের ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার বাসে, টিচার্স লাউঞ্জে, অফিস রুমের চেম্বারে, চট্টগ্রাম ক্লাবে, ইত্যাদি নানা জায়গায় তার সঙ্গে আলাপচারিতার অভিজ্ঞতাগুলো ছিল আনন্দ ও জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত। চট্টগ্রামের নেতৃস্থানীয় বাম-প্রগতিশীল-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পিতা ডা. কামাল এ. খানের ঐতিহ্যের পথ ধরে তিনিও অসাম্প্রদায়িক, বহুত্ববাদী, সংস্কৃতিমনা আবহে নিজের জীবনকে যাপন করেছেন।
বলতে দ্বিধা নেই, তাকে ঘিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নান্দনিক বৃত্ত গড়ে উঠেছিল, যেখানে অগ্রসর আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের একটি প্রাণবন্ত ধারা প্রবহমান ছিল। সাধারণের ভীড়ে ক্ষয়িষ্ণু বিদ্যামুখীদের একটি ক্ষুদ্রমণ্ডলী গড়ে উঠেছিল তাঁকে ঘিরে। যেখানে সবার আসার ও অংশগ্রহণের সুযোগ ও সামর্থ্য ছিল না।
পিতৃকুলের আভিজাত্যের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাতৃকুলের সুবাদে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোর শরাফত বহন করেছেন। যার শেকড় বিস্তৃত ছিল অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতার রাজনীতি, সমাজ ও সাহিত্যে। বৈবাহিক সূত্রে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক সুষমা ছিল তার অধীত। মেয়েদের বসবাসের কারণে আটলান্টিকের উভয় তীরের জনপদগুলো তিনি ভ্রমণে ও যাপনে আত্মস্থ করেছেন।
ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার নানা প্রান্তের সৌরভের ভেতর তিনি বছরের অনেকটা সময় কাটিয়ে বিশ্বায়নের আভা মেখে চিরায়ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের যাপিত জীবনের একজন অগ্রগণ্য, অনবদ্য, উজ্জ্বল সদস্য হিসেবে জ্বলজ্বল করছেন। বয়স তাঁর তারুণ্যের কাছে এসে মাথা হেট করেছে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তাঁর কাছে এসে প্রজ্বলিত হয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি জীবনের শেষ ক্লাশটি সম্পন্ন করলেও বিলক্ষণ জানি, তাঁর মতো একজন সৃজনশীল শিক্ষক ও মননশীল মানুষের অধ্যয়ন, পড়াশোনা, ক্লাস নেওয়া ইত্যাদি বিদ্যায়নিক কাজ-কর্ম কখনোই শেষ হওয়ার নয়।
অধ্যাপক ড. ইরশাদ কামাল খান, ‘নেভার সে ইউ গুডবাই’। আপনাকে কখনোই বিদায় জানানো সম্ভব হবে না। আপনি আমাদের মাঝেই থাকবেন। নৈসর্গিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাশ্বত প্রকৃতির পরতে পরতে আপনি থেকে যাবেন কাল থেকে কালান্তরে।