লঞ্চের টিভিতে কেন শুধু ভারতীয় সংস্কৃতি!
এমভি আল বোরাক থেকে: সকাল সাড়ে নয়টায় চাঁদপুর থেকে রওনা করে লঞ্চ এমভি আল বোরাক। চাঁদপুরের অন্য লঞ্চগুলোর তুলনায় এটি কিছুটা ছোট। তবে সকাল ৯টার পর আর ভালো কোনো লঞ্চ না থাকায় বাধ্য হয়ে উঠতে হলো।
লঞ্চের নিচতলায় সাধারণ সিট এবং বেঞ্চ। সিটের ভাড়া ১৫০ টাকা এবং বেঞ্চ ও দাঁড়িয়ে বসে থাকার ভাড়া ১০০ টাকা। সিটের নম্বর দেওয়া আছে, তাই আগেই টিকেট কাটতে হয়।
এর ওপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় রয়েছে প্রথম শ্রেণি এবং কেবিন। ৩ ঘন্টা ২০ মিনিটের ভ্রমণে খুব বেশি সিটে বসা হয় না, তাই এবারে সাধারণ সিটের একটি টিকেট কাটলাম৷ সিট খুঁজে বসতেই কানে আসলো উচ্চ শব্দে হিন্দি গানের আওয়াজ। সাধারণ ডেকে একটি টেলিভিশন আছে। সেখানে চলছে বলিউডে প্রায় দেড় যুগ আগে মুক্তি পাওয়া সিনেমা 'তেরে নাম' এর একটি গান। চুল ঝাঁকিয়ে সালমান খান নায়িকার সঙ্গে নাচছেন। এভাবে আরও কয়েকটি হিন্দি গান চললো। যার মধ্যে রয়েছে 'কাজরারে'সহ বেশ কয়েকটি আইটেম গান।
কিশোর বয়সীরা হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেও বেশিরভাগেরই সেদিকে কোনো আকর্ষণ নেই। এর মধ্যে 'এক হালি ১৫ টাকা, ৬টা ২০ টাকা,' কলা বিক্রেতার ডাক, রুটি বিক্রেতার হাঁক, জুতার কালি করতে মুচির দৌঁড়ে বেড়ানো, লঞ্চ ছাড়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যস্ততা অনেক বেশি।
লঞ্চ ঘাট ছেড়ে ধীরে ধীরে প্রশস্ত মেঘনার বুকে বয়ে চললো। এবার টেলিভিশন স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সিনেমা। হিন্দি ছবিটার নাম 'দ্যা জ্যাকপট'। ভারত-পাকিস্তান বিরোধ, প্রেম, রক্তাক্ত মারামারি নিয়ে ছবি। প্রথম দিকে ভাষাগত জটিলতার কারণে অনেকেরই সেদিকে খেয়াল ছিল না। তবে বসে বসে সময় কাটাতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকাটা মন্দ নয়! আর ধীরে ধীরে ঘটনা প্রবাহের সঙ্গেও চলতে শুরু করা যায়। ভাষাটাও সমস্যা হয় না বেশি। বরং রপ্ত হয়ে যায়।
লঞ্চের প্রথম শ্রেণি এবং কেবিনগুলোতেও একই সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে। অনেকেই ঝিমুচ্ছেন আবার অনেকেই তাকিয়ে আছেন স্ক্রিনে।
পাশের সিটে তরুণ আব্দুল ওহাব ঢাকায় একটি সুয়েটার কারখানায় চাকুরি করেন। জানতে চাইলাম সিনেমাটি তিনি কেমন উপভোগ করছেন? উত্তরে বললেন, বাংলা নাটক বা সিনেমা হলে ভালো হতো। এটায় মারামারি অনেক, তবে সবাইতো আর হিন্দি ভাষা বোঝে না৷ আর বাংলাদেশের ভ্রমণে কেন এতো হিন্দি ভাষার সিনেমা বা নাটক চলবে?
কথাটা যুক্তিযুক্ত মনে হলো। ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার মাধ্যমে সংস্কৃতি বিকাশের একটি বড় স্থান পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। যার মধ্যে প্রথমেই লঞ্চ এবং ট্রেন। কারণ দীর্ঘ ভ্রমণে মানুষের সময় কাটানোর বড় মাধ্যম হয়ে ওঠে টেলিভিশন। তবে এখন অনেকেই মোবাইল স্ক্রিনে ব্রাউজিং করে সময় কাটাচ্ছেন৷
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এমভি দেশান্তরে করে ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাওয়ার সময়ও দেখলাম প্রথমে হিন্দি সিনেমার গান এবং পরে ভারতীয় বাংলা সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছিল। নায়ক ছিলেন জিৎ। কিভাবে জিৎ ভারতের প্রধান গুন্ডা হয়ে ওঠেন সেটা নিয়েই সিনেমাটির গল্প৷
বাংলাদেশের নাটক সিনেমার এখন বেশ সুনাম রয়েছে অন্তত এই বাংলা অঞ্চলে৷ তাহলে বাস বা লঞ্চের মতো পাবলিক ট্রান্সপোর্টগুলোতে কেন ভারতীয় সিনেমা আর সংস্কৃতির এখনো এই আধিপত্য!
নদীতে এখন ঠাণ্ডা বাতাস। তাই ডেকের এক পাশ সবসময় ভারি পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে৷ দোতলা-তিন তলার বারান্দায় দাঁড়ালে যেন ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর হিম হয়ে যায়।
লঞ্চ মুন্সিগঞ্জের দিকে আসলে একটি ইঞ্জিন নৌকা এগিয়ে আসে। নৌকা থেকে ঝড়ের বেগে লঞ্চে উঠে যান কয়েকজন। ডাকাত পড়ার মতো মনে হলেও আসলে এরা ভাসমান হকার। চলতি লঞ্চে এরা ফেরি করে বেড়ান। এক লঞ্চ থেকে আরেক লঞ্চে!