চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লার গোলাম রাব্বানী
কেউ বিশ্বাস করবে না এই প্রৌঢ় ভদ্রলোক চট্টগ্রাম কলেজ ও ভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন। জীবনেও মাদ্রাসায় না পড়ে মহাকবি হাফিজ, রুমি, ফেরদৌসীর ফারসি উক্তি আর ইকবালের উর্দু অনেক কবিতা তার কণ্ঠস্থ। নিজেকে তিনি পরিচয় দেন 'আন্দরকিল্লার রাব্বানী' নামে।
চৌধুরী গোলাম রাব্বানীকে চট্টগ্রামের অন্য রকম এক চরিত্র বলা যায়। শহর-নগর থেকে মেট্রোপলিশ, কসমোপলিশ, মেগাপলিশ হওয়ার আগে প্রাচীন পাড়াগুলোতে অনেক চরিত্রের দেখা পাওয়া যেতো। তিনি তেমনই একজন। হয়ত সত্তর বর্ষী এই ভদ্রলোক প্রাচীন চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত। চরম নগরায়নের তোপে এমন চরিত্রগুলোকে আজকাল আলাদাভাবে খুঁজে পাওয়া আর সম্ভব হয় না।
১৬৬৬ সালে চট্টগ্রামে মুঘল বিজয়ের স্মারক হিসাবে মগ-আরাকান-পর্তুগিজ অধ্যুষিত আনন্দকিল্লায় প্রতিষ্ঠিত শাহী মসজিদে তিনি নিয়মিত নামাজ পড়েন। আন্দরকিল্লা পেরিয়ে নগরের বাহিরকিল্লা বলে যে বিস্তৃতি, সেখানে ঘোরাফেরা করলেও তার ঘাঁটি আন্দরকিল্লায়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এই সন্তান কবে ও কিভাবে যেন আন্দরকিল্লার পরিচয়েই মশহুর হয়ে গেছেন।
প্রাচীন ও আধুনিক চট্টগ্রামের সন্ধিস্থল জনাকীর্ণ আন্দরকিল্লার চৌরঙ্গী হোটেলের আড্ডায় তার সঙ্গে দেখা হলো। স্মৃতিধর লোকটি ছাত্রজীবনে ড. আনিসুজ্জামান, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের সান্নিধ্যের কথাগুলো বলছিলেন, 'পুরনো শিক্ষাগুরুদের অধ্যবসায় ও সাধনার ঐতিহ্য ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে', আক্ষেপ করেন তিনি।
পঁচিশ বছর আগে চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে মোহতারাম রহমান সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় উর্দুভাষীদের এক জলসায় কবিতা পাঠ করতে গিয়ে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। সেসব কথা উল্লেখ করে তিনি আফসোস করেন, 'চট্টগ্রামে বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক দ্যোতনার ধারাটিও বিলীন হয়ে যাচ্ছে।' আমি একমত হই। কারণ গুজরাতি মেমন সম্প্রদায়ের সদস্য আমার অনেক চট্টগ্রামবাসী ছাত্র-ছাত্রীও অভিবাসনের পথে বিশ্বের নানা প্রান্তে চলে গেছে।
বিশ্বায়নের তীব্র মাতাল স্রোতের প্রভাবে ভয়াবহ সামাজিক গতিশীলতা আর নগর পরিকাঠামোর আমূল পালাবদল ঘটালেও চৌধুরী গোলাম রাব্বানী এবং এ রকম আরও কিছু চরিত্র স্থানিক পরিসরেই মিশে থাকেন। আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহের স্মৃতি ধারণ করে এইসব চরিত্র কথ্য ইতিহাসকে প্রবহমান রাখেন।
দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপশ্চিম প্রান্তের পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংলগ্ন খায়বার-পাখতুনখাওয়া অঞ্চলের নাভিমূল, পাঠান-মুলুক পেশোয়ার থেকে চীন পর্যন্ত প্রসারিত যে ঐতিহাসিক সিল্ক রোড, সেখানে প্রাচীন ক্যারাভান ধীর লয়ে চলে বিশ্রামের ফুসরত পেতো অনেকগুলো কিসসাখানি বাজারে। বাজারের সরাইখানায় বিশ্রামরত বণিকরা আয়েশ করে পেশাদার গল্প বলার লোকের গল্প ও কাহিনি শুনতো। কিসসা শোনা ছাড়া মধ্যযুগে আর কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না তখন। আজকের মতো টিভি চ্যানেল, স্যাটেলাইটের সুবাদে মুঠো ভর্তি বিনোদন সে আমলে ছিল অসম্ভব।
মধ্যযুগের ইংরেজি সাহিত্যের প্রধান চরিত্র জিওফ্রে চসার তার সুবিখ্যাত 'ক্যান্টাবেরি টেলস'-এ এমন গল্পগুলোই সঙ্কলিত করেছেন। আরব ভূমি ঘুরে আসা ইউরোপীয় পরিব্রাজকদের কাহিনিগুলো তিনি আরো অনেক গল্পের সঙ্গে গ্রন্থভুক্ত করেছেন।
সম্ভবত এ কারণেই, আজকের মতো আনুষ্ঠানিক বিশ্বায়ন শুরু হওয়ার বহু আগে মানুষের বিশ্বব্যাপী লেনদেন, আদানপ্রদানের যে শ্লথ বিশ্বায়ন চলছিল, তাতেই একদেশের গল্প, রূপকথা আরেক দেশে ছড়িয়ে গেছে। ইশপের বহু নীতি কাহিনি আমাদের দেশেও অন্য আঙিকে পাওয়া যাচ্ছে। কম্পিউটার বা গ্রন্থ নয়, কিসসা বলার লোকায়ত লোকগুলোই এসব ধরে রেখেছিলেন এবং ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মাধ্যমে সিল্ক রোড বা ক্যান্টাবেরি হয়ে বিশ্বের সম্পদ হয়েছে এইসব কথা ও কাহিনি।
চট্টগ্রামের আনন্দকিল্লার চৌধুরী গোলাম রাব্বানী এবং এ রকম চরিত্রগুলোই কথ্য ইতিহাসের বাহন হয়েছেন। হারিয়ে যাওয়া লোকায়ত কথকদের শেষ চিহ্ন হয়ে ঝলকে উঠার এই মানুষগুলোকে রাক্ষুসী নগরায়নের বৈশ্বিক তাণ্ডবের সমাগত দিনগুলোতে আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না। পাহাড়ি অরণ্য পেরিয়ে নগর চট্টগ্রামের ঐতিহ্যশাসিত আন্দরকিল্লায় গেলে আমার সঙ্গে নিশ্চিত দেখা হয় চৌধুরী গোলাম রাব্বানীর। তার দিকে তাকিয়ে আমার তখন ইতিহাস-পরম্পরার সিল্ক রোডের কিসসাখানি বাজারের হারিয়ে যাওয়া কথকদের কথা মনে পড়ে।