বিশ্ব চলচ্চিত্রে মোজার্ট এবং বিথোফেন
সংগীত পছন্দ করুন বা না-ই করুন, মোজার্ট এবং বিথোফেনের নাম শোনেননি এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই রয়েছে। বহু বছর আগে, সংগীত যখন ছিল কেবলই আভিজাত্যের অন্যতম উপাদান, সেই সময় সংগীতকে ব্যক্তি মানসের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই দুই মহান শিল্পী।
সংগীতকে তাঁরা এমন একটি শিল্প-মাধ্যম রূপে বের করে এনেছিলেন যেন বৈচিত্র্যময় জীবনের খুব কাছের অনুভব এই সংগীত। এবং মানুষ চাইলেই তার সব রকম অনুভূতি সংগীতের মাধ্যমে অনায়াসে প্রকাশ করতে পারে। তাঁদের কাজের ব্যাপকতা এত প্রসারিত ছিল যে নানা শিল্প-মাধ্যমে তাঁদের তৈরিকৃত সুর মিশেছে। সেই মিশ্রণ শিল্পের ভাবকে করেছে তাৎপর্যমণ্ডিত, দিয়েছে অনন্য উচ্চতা। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই আমরা এই বিষয়টিকে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে দেখেছি।
মোজার্ট-এর পুরো নাম উলফগ্যাং অ্যামাদিউস মোজার্ট। ১৭৫৬ সালের ২৭ শে জানুয়ারি অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে লিওপোল্ড-মারিয়া দম্পতির সংসারে মোজার্ট জন্মগ্রহণ করেন। আঠার শতকের মধ্যবর্তী এই সময়টি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ইউরোপের জন্য ছিল এক ক্রান্তিকাল। রোমান সাম্রাজ্যের ভাঙন-পরবর্তী প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রভাব সালজবার্গ শহরের ওপরও পড়েছিল। রেঁনেসা ও বারোক যুগের সুরশৈলী যে-রকমভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, এই সময়ে এসে তার একটা বড়োসড়ো পরিবর্তন চোখে পড়ে। নাতিদীর্ঘ কম্পোজিশনগুলোকে পূর্ণমাত্রা ও পূর্ণাঙ্গ কম্পোজিশনগুলোকে জটিল যন্ত্রাণুষঙ্গে ভিন্ন মাত্রা দেবার প্রয়াস গড়ে উঠতে দেখা যায়। সংগীত ক্রমেই গির্জা ও রাজদরবার-ভিত্তিক একটি শিল্পমাধ্যমের স্বীকৃতি পেয়ে আভিজাত্যের তকমা গায়ে জুড়ে নেয়।
বাবা লিওপোল্ডের হাত ধরে মোজার্টের সংগীতে হাতেখড়ি হয়েছিল। সালজবার্গ কোর্টের এসিস্ট্যান্ট কনসার্ট মাস্টার লিওপোল্ড একজন সফল কম্পোজার এবং বেহালাবাদক ছিলেন। লোকশ্রুতিতে আছে, লিওপোল্ড যখন সাত বছর বয়সী কন্যাকে কিবোর্ডে হাতপাকা করবার দীক্ষা দিচ্ছিলেন, সবসময় বোনের সাথে থাকা তিন বছর বয়সী মোজার্ট খেলার ছলেই কিবোর্ড আত্মস্থ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। বাবা লিওপোল্ডের সাহায্যে অল্প বয়সেই ভায়োলিন-সহ নানা সংগীত বাদ্যযন্ত্র মোজার্টের আয়ত্তে এসে যায়। ধীরে ধীরে মোজার্ট পিয়ানো, অর্গান এবং ভায়োলাও শিখে নেন এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি নিজস্ব কম্পোজিশন তৈরি করে তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন।
তারপর মোজার্টের গল্পটা শুধুই ইতিহাসের। একের পর এক সিম্ফোনি, অপেরা, মিনি অপেরা, স্ট্রিং কোয়ার্টেটের অর্কেস্ট্রা, ভায়োলিন সোনাটা, সেরিনেইডস, মোটেটস, মাসেস-সহ মহান নানা ধ্রুপদী সংগীত তিনি তাঁর মাত্র ৩৫ বছর আয়ুষ্কালীন জীবনে তৈরি করে গেছেন।
বিথোফেনের গল্পটা তো আরো অদ্ভুত। পিতা জোহান ভ্যান বিথোফেনের ছিল সংগীত অনুরাগী মন। তিনি চাইতেন ছেলে মোজার্টের মতো কিংবদন্তি হবে। সেই লক্ষ্যেই খুব অল্প বয়স থেকেই জোহান ছেলেকে নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করাতেন।
১৭৭০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর জার্মানির বন শহরে লুডভিগ ফান বিথোফেন জন্মগ্রহণ করেন। ধ্রুপদী সংগীত যখন গির্জা ও রাজদরবারের চার দেয়ালে আটকে আছে তখন রাস্তায় এবং তথাকথিত সকল আমোদের আসরগুলোতে এক ধরনের হালকা সংগীত বাজবার রেওয়াজ ছিল। তবুও বাবার ইচ্ছানুযায়ী খুব অল্প বয়স থেকেই বিথোফেনকে ধ্রুপদী সংগীত চর্চায় মনোনিবেশ করতে হয়। মদ্যপ পিতার সাথে বিথোফেনের সম্পর্ক ভালো ছিল না এবং অল্প বয়সে মাতৃহীন হয়ে বিথোফেন ধীরে ধীরে সংগীত চর্চা, নতুন সুর তৈরির দিকেই তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়েন।
মাত্র সাত বছর বয়সে জনসমক্ষে বিথোফেন পিয়ানো বাজিয়ে আলোচনায় চলে এসেছিলেন। যে সময়টায় সংগীত ছিল গির্জা ও রাজাদের নির্দেশিত শিল্পমাধ্যম ঠিক সে সময়েই নিজস্ব আবেগ আর সংগীত-দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বিথোফেন তৈরি করেছিলেন একের পর এক সোনাটা, সিম্ফোনি, পিয়ানো অর্কেস্ট্রা। ১৮১০ সালের দিকে তাঁর শ্রুতিজনিত সমস্যা এত বিকটাকার হয়ে ধরা পড়ে যে তিনি প্রায় বধিরই হয়ে গিয়েছিলেন বলা যায়। তবুও ভাবলে অবাক হতে হয়, তাঁর বিখ্যাত ‘নবম সিম্ফোনি’র কাজ ১৮২৪ সালে শেষ হয় এবং সে-সময় তিনি কানে কিছুই শুনতেন না। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এই মিউজিক মায়েস্ত্রো ১৮২৭ সালের ২৬ শে মার্চ পরপারে পাড়ি জমান।
চলচ্চিত্রকে বলা যায় একটা মিশ্র শিল্প-মাধ্যম৷ মিশ্র ঠিক সেই কারণে যে—নিজস্ব ভাব সাবলীলভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে চলচ্চিত্রকে সবসময়ই অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমের ওপর ভর করতে হয়। চলচ্চিত্র আমাদের জীবনের সবচেয়ে কাছাকাছি শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। চলচ্চিত্রে সংগীতের প্রত্যক্ষ প্রভাব তো রয়েছেই বরং সংগীত আয়োজনের সঠিকতা এবং উপযুক্ত প্রয়োগ চলচ্চিত্রকে বরাবরই একটি নতুন মাত্রা দান করে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন চলচ্চিত্র-পরিচালকগণ নিজেদের নির্মিত চলচ্চিত্রকে মানুষের হৃদয়ের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসতে যতবার সংগীতের ব্যবহার সমন্ধে চিন্তা করেছেন, ততবারই তাঁরা মোজার্ট এবং বিথোফেনের সুরের দ্বারস্থ হয়েছেন বিনা সংকোচে।
জীবন সম্পর্কিত প্রত্যেকটি অনুভব-অনুভূতির সাথে এই দুই শিল্পীর তৈরিকৃত সুরের অন্তরঙ্গতা এত প্রবল ছিল যে এই সুর ব্যবহার করা ছাড়া চলচ্চিত্র পরিচালকদের হাতে চলচ্চিত্রকে আরো জীবনমুখী করবার অন্য উপায় ছিল না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা নানা চলচ্চিত্রে মোজার্ট এবং বিথোফেনের সুর ব্যবহার নিয়ে এবার একটু জেনে আসা যাক।
নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র তৈরিকালীন সময় থেকে মোজার্টের সংগীত চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে। স্প্যানিশ চলচ্চিত্র পরিচালক লুইস ব্যুনয়্যেল ১৯৩০ সালে তার “L'Age d'Or” নামক নির্বাক চলচ্চিত্রে মোজার্টের “Ave verum corpus” নামক মোটেটটি ব্যবহার করেন। এরপর একে একে “দ্য ব্লু এঞ্জেল”, “ওয়াথেরিংহেইটস”, “দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ানগ্রে”, “কাইন্ডহার্টস এন্ড করোনেটস”, “ভার্টিগো”, “দ্য ইপক্রেস ফাইল”, “পিকনিক এট হ্যাংগিং রক”, “আলভিরাম্যাডিগান”, “দ্য স্পাইহুলাভডমি”, “এ্যানি হল”-সহ নানা সিনেমায় তাঁর পিয়ানো সোনাটা, মিনি অপেরাটিউন, সিম্ফোনি, পিয়ানো অর্কেস্ট্রা একে একে ব্যবহৃত হয়ে চলচ্চিত্রে সংগীতের একটি সুস্থিত অবস্থান তৈরি করে।
বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্ট্যানলিকুবরিকের ধ্রুপদী সংগীতের প্রতি অগাধ আগ্রহের খবর আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কুবরিক সবসময়ই সঠিক দৃশ্যের জন্য সঠিক সংগীত বেছে নেওয়াতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার “আইজ ওয়াইড শাট” চলচ্চিত্রটির কথা মনে আছে? নায়ক টমক্রুজের ভীত চোখ, অস্থির পায়চারিতে দর্শককে আরো গভীরভাবে আটকে দিতে কুবরিক সাহায্য নিয়েছিলেন মোজার্টের “Rex tremendae” নামক সৃষ্টির।
বিখ্যাত রোমান্টিক চলচ্চিত্র “হোয়েন হ্যারি মেট স্যালি”-র কথা আমরা ভুলব কেমন করে? সে চলচ্চিত্রটিতেও মোজার্টের ই ফ্ল্যাট মেজর স্কেলের স্ট্রিং কুইন্টেটটি অন্যরকম আবহ তৈরি করেছিল। তারপর “এলিয়েন”, “আউট অফ আফ্রিকা”, “নাও ইউসিমি ২” , “ব্রেথলেস”, “মাই লেফট ফুট”, “ফাইভ ইজি পিসেস”-সহ আরো অসংখ্য সিনেমার আদি, মধ্য কিংবা অন্তে মোজার্টের সংগীত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে আলোকিত করেছে।
জীবন ধারণকালীন জটিলতা, বিচ্ছিন্নতা এবং পূর্ণতা-অপূর্ণতার সংযোগে বিথোফেন যে সুরই তৈরি করেছেন, চলচ্চিত্র পরিচালকরা সেখানে পেয়েছেন আত্মার সজীব সংযোগ। চলচ্চিত্র দুনিয়ায় একটা কথা কিন্তু বেশ প্রচলিত। বলা হয়—“আপনি যদি একটি চলচ্চিত্রও জীবনে দেখে থাকেন, তাহলে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে আপনি বিথোফেনকে শুনেছেন।”
আইএমডিবি’র তথ্যানুসারে ১২০০-র অধিক চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্রে বিথোফেনের সংগীত ব্যবহার করা হয়েছে।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে “ডেড পোয়েটস সোসাইটি” চলচ্চিত্রটি নিয়ে এখনো নিয়ম করে সব মহলে কথা হয়। এ সিনেমায় বিথোফেনের “Ode to Joy” যা “Symphony No. 9” নামেও খ্যাত, ব্যবহার করেছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক। শুধু এই সিম্ফোনিটিই নয়, বিথোফেনের তৈরিকৃত “Piano Concerto No. 5”-এর সফল ব্যবহারও আমরা উক্ত সিনেমাতে শুনেছি। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ওপর তারেক মাসুদ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র “আদম সুরত”-এ পরিচালক তারেক মাসুদ বিথোফেনের “Symphony No. 9” ব্যবহার করেছিলেন।
“ক্রিমসন টাইড”, “লিংকন”, “মিশন ইম্পোসিবল”, “দ্য জু কিপারসওয়াইফ”, “ফ্যান্টাসিয়া”, “মিসারি”, “ক্যালিফোর্নিয়া”-সহ বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোতে বিথোফেনের পিয়ানো সোনাটা কী চমৎকার আবহ তৈরি করেছে। “বিফোরসানরাইজ”, “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড : জুরাসিক পার্ক”, “দ্য এজ অফ ইনোসেন্স”-সহ বিভিন্ন আঙ্গিকের সিনেমাগুলোতে বিথোফেনের “Piano Sonata No. 8”-এর ব্যবহার ঘটনার বাঁক বদলে দিয়েছে নতুন মাত্রা।
এক কথায় বলা যায়, তাঁর স্ট্রিং কোয়ার্টেট, সিম্ফোনির সুর এবং পিয়ানো সোনাটাগুলো ব্যবহৃত হয়েছে—এমন চলচ্চিত্রের নাম বলে এবং লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।