বিশ্ব চলচ্চিত্রে মোজার্ট এবং বিথোফেন



রায়হান রহমান রাহিম, কন্ট্রিবিউটর
মোজার্ট ও বিথোফেন

মোজার্ট ও বিথোফেন

  • Font increase
  • Font Decrease

সংগীত পছন্দ করুন বা না-ই করুন, মোজার্ট এবং বিথোফেনের নাম শোনেননি এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই রয়েছে। বহু বছর আগে, সংগীত যখন ছিল কেবলই আভিজাত্যের অন্যতম উপাদান, সেই সময় সংগীতকে ব্যক্তি মানসের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই দুই মহান শিল্পী।

সংগীতকে তাঁরা এমন একটি শিল্প-মাধ্যম রূপে বের করে এনেছিলেন যেন বৈচিত্র্যময় জীবনের খুব কাছের অনুভব এই সংগীত। এবং মানুষ চাইলেই তার সব রকম অনুভূতি সংগীতের মাধ্যমে অনায়াসে প্রকাশ করতে পারে। তাঁদের কাজের ব্যাপকতা এত প্রসারিত ছিল যে নানা শিল্প-মাধ্যমে তাঁদের তৈরিকৃত সুর মিশেছে। সেই মিশ্রণ শিল্পের ভাবকে করেছে তাৎপর্যমণ্ডিত, দিয়েছে অনন্য উচ্চতা। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই আমরা এই বিষয়টিকে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে দেখেছি।

মোজার্ট-এর পুরো নাম উলফগ্যাং অ্যামাদিউস মোজার্ট। ১৭৫৬ সালের ২৭ শে জানুয়ারি অস্ট্রিয়ার সালজবার্গে লিওপোল্ড-মারিয়া দম্পতির সংসারে মোজার্ট জন্মগ্রহণ করেন। আঠার শতকের মধ্যবর্তী এই সময়টি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ইউরোপের জন্য ছিল এক ক্রান্তিকাল। রোমান সাম্রাজ্যের ভাঙন-পরবর্তী প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রভাব সালজবার্গ শহরের ওপরও পড়েছিল। রেঁনেসা ও বারোক যুগের সুরশৈলী যে-রকমভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, এই সময়ে এসে তার একটা বড়োসড়ো পরিবর্তন চোখে পড়ে। নাতিদীর্ঘ কম্পোজিশনগুলোকে পূর্ণমাত্রা ও পূর্ণাঙ্গ কম্পোজিশনগুলোকে জটিল যন্ত্রাণুষঙ্গে ভিন্ন মাত্রা দেবার প্রয়াস গড়ে উঠতে দেখা যায়। সংগীত ক্রমেই গির্জা ও রাজদরবার-ভিত্তিক একটি শিল্পমাধ্যমের স্বীকৃতি পেয়ে আভিজাত্যের তকমা গায়ে জুড়ে নেয়।

বাবা লিওপোল্ডের হাত ধরে মোজার্টের সংগীতে হাতেখড়ি হয়েছিল। সালজবার্গ কোর্টের এসিস্ট্যান্ট কনসার্ট মাস্টার লিওপোল্ড একজন সফল কম্পোজার এবং বেহালাবাদক ছিলেন। লোকশ্রুতিতে আছে, লিওপোল্ড যখন সাত বছর বয়সী কন্যাকে কিবোর্ডে হাতপাকা করবার দীক্ষা দিচ্ছিলেন, সবসময় বোনের সাথে থাকা তিন বছর বয়সী মোজার্ট খেলার ছলেই কিবোর্ড আত্মস্থ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। বাবা লিওপোল্ডের সাহায্যে অল্প বয়সেই ভায়োলিন-সহ নানা সংগীত বাদ্যযন্ত্র মোজার্টের আয়ত্তে এসে যায়। ধীরে ধীরে মোজার্ট পিয়ানো, অর্গান এবং ভায়োলাও শিখে নেন এবং মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি নিজস্ব কম্পোজিশন তৈরি করে তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন।

তারপর মোজার্টের গল্পটা শুধুই ইতিহাসের। একের পর এক সিম্ফোনি, অপেরা, মিনি অপেরা, স্ট্রিং কোয়ার্টেটের অর্কেস্ট্রা, ভায়োলিন সোনাটা, সেরিনেইডস, মোটেটস, মাসেস-সহ মহান নানা ধ্রুপদী সংগীত তিনি তাঁর মাত্র ৩৫ বছর আয়ুষ্কালীন জীবনে তৈরি করে গেছেন।

বিথোফেনের গল্পটা তো আরো অদ্ভুত। পিতা জোহান ভ্যান বিথোফেনের ছিল সংগীত অনুরাগী মন। তিনি চাইতেন ছেলে মোজার্টের মতো কিংবদন্তি হবে। সেই লক্ষ্যেই খুব অল্প বয়স থেকেই জোহান ছেলেকে নিয়মিত কঠোর অনুশীলন করাতেন।

১৭৭০ সালের ১৭ই ডিসেম্বর জার্মানির বন শহরে লুডভিগ ফান বিথোফেন জন্মগ্রহণ করেন। ধ্রুপদী সংগীত যখন গির্জা ও রাজদরবারের চার দেয়ালে আটকে আছে তখন রাস্তায় এবং তথাকথিত সকল আমোদের আসরগুলোতে এক ধরনের হালকা সংগীত বাজবার রেওয়াজ ছিল। তবুও বাবার ইচ্ছানুযায়ী খুব অল্প বয়স থেকেই বিথোফেনকে ধ্রুপদী সংগীত চর্চায় মনোনিবেশ করতে হয়। মদ্যপ পিতার সাথে বিথোফেনের সম্পর্ক ভালো ছিল না এবং অল্প বয়সে মাতৃহীন হয়ে বিথোফেন ধীরে ধীরে সংগীত চর্চা, নতুন সুর তৈরির দিকেই তীব্রভাবে ঝুঁকে পড়েন।

মাত্র সাত বছর বয়সে জনসমক্ষে বিথোফেন পিয়ানো বাজিয়ে আলোচনায় চলে এসেছিলেন। যে সময়টায় সংগীত ছিল গির্জা ও রাজাদের নির্দেশিত শিল্পমাধ্যম ঠিক সে সময়েই নিজস্ব আবেগ আর সংগীত-দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বিথোফেন তৈরি করেছিলেন একের পর এক সোনাটা, সিম্ফোনি, পিয়ানো অর্কেস্ট্রা। ১৮১০ সালের দিকে তাঁর শ্রুতিজনিত সমস্যা এত বিকটাকার হয়ে ধরা পড়ে যে তিনি প্রায় বধিরই হয়ে গিয়েছিলেন বলা যায়। তবুও ভাবলে অবাক হতে হয়, তাঁর বিখ্যাত ‘নবম সিম্ফোনি’র কাজ ১৮২৪ সালে শেষ হয় এবং সে-সময় তিনি কানে কিছুই শুনতেন না। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে এই মিউজিক মায়েস্ত্রো ১৮২৭ সালের ২৬ শে মার্চ পরপারে পাড়ি জমান।

চলচ্চিত্রকে বলা যায় একটা মিশ্র শিল্প-মাধ্যম৷ মিশ্র ঠিক সেই কারণে যে—নিজস্ব ভাব সাবলীলভাবে ফুঁটিয়ে তুলতে চলচ্চিত্রকে সবসময়ই অন্য কোনো শিল্প মাধ্যমের ওপর ভর করতে হয়। চলচ্চিত্র আমাদের জীবনের সবচেয়ে কাছাকাছি শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। চলচ্চিত্রে সংগীতের প্রত্যক্ষ প্রভাব তো রয়েছেই বরং সংগীত আয়োজনের সঠিকতা এবং উপযুক্ত প্রয়োগ চলচ্চিত্রকে বরাবরই একটি নতুন মাত্রা দান করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন চলচ্চিত্র-পরিচালকগণ নিজেদের নির্মিত চলচ্চিত্রকে মানুষের হৃদয়ের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসতে যতবার সংগীতের ব্যবহার সমন্ধে চিন্তা করেছেন, ততবারই তাঁরা মোজার্ট এবং বিথোফেনের সুরের দ্বারস্থ হয়েছেন বিনা সংকোচে।

জীবন সম্পর্কিত প্রত্যেকটি অনুভব-অনুভূতির সাথে এই দুই শিল্পীর তৈরিকৃত সুরের অন্তরঙ্গতা এত প্রবল ছিল যে এই সুর ব্যবহার করা ছাড়া চলচ্চিত্র পরিচালকদের হাতে চলচ্চিত্রকে আরো জীবনমুখী করবার অন্য উপায় ছিল না।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামকরা নানা চলচ্চিত্রে মোজার্ট এবং বিথোফেনের সুর ব্যবহার নিয়ে এবার একটু জেনে আসা যাক।

নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র তৈরিকালীন সময় থেকে মোজার্টের সংগীত চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে। স্প্যানিশ চলচ্চিত্র পরিচালক লুইস ব্যুনয়্যেল ১৯৩০ সালে তার “L'Age d'Or” নামক নির্বাক চলচ্চিত্রে মোজার্টের “Ave verum corpus” নামক মোটেটটি ব্যবহার করেন। এরপর একে একে “দ্য ব্লু এঞ্জেল”, “ওয়াথেরিংহেইটস”, “দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ানগ্রে”, “কাইন্ডহার্টস এন্ড করোনেটস”, “ভার্টিগো”, “দ্য ইপক্রেস ফাইল”, “পিকনিক এট হ্যাংগিং রক”, “আলভিরাম্যাডিগান”, “দ্য স্পাইহুলাভডমি”, “এ্যানি হল”-সহ নানা সিনেমায় তাঁর পিয়ানো সোনাটা, মিনি অপেরাটিউন, সিম্ফোনি, পিয়ানো অর্কেস্ট্রা একে একে ব্যবহৃত হয়ে চলচ্চিত্রে সংগীতের একটি সুস্থিত অবস্থান তৈরি করে।

বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা স্ট্যানলিকুবরিকের ধ্রুপদী সংগীতের প্রতি অগাধ আগ্রহের খবর আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কুবরিক সবসময়ই সঠিক দৃশ্যের জন্য সঠিক সংগীত বেছে নেওয়াতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার “আইজ ওয়াইড শাট” চলচ্চিত্রটির কথা মনে আছে? নায়ক টমক্রুজের ভীত চোখ, অস্থির পায়চারিতে দর্শককে আরো গভীরভাবে আটকে দিতে কুবরিক সাহায্য নিয়েছিলেন মোজার্টের “Rex tremendae” নামক সৃষ্টির।

বিখ্যাত রোমান্টিক চলচ্চিত্র “হোয়েন হ্যারি মেট স্যালি”-র কথা আমরা ভুলব কেমন করে? সে চলচ্চিত্রটিতেও মোজার্টের ই ফ্ল্যাট মেজর স্কেলের স্ট্রিং কুইন্টেটটি অন্যরকম আবহ তৈরি করেছিল। তারপর “এলিয়েন”, “আউট অফ আফ্রিকা”, “নাও ইউসিমি ২” , “ব্রেথলেস”, “মাই লেফট ফুট”, “ফাইভ ইজি পিসেস”-সহ আরো অসংখ্য সিনেমার আদি, মধ্য কিংবা অন্তে মোজার্টের সংগীত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে আলোকিত করেছে।

জীবন ধারণকালীন জটিলতা, বিচ্ছিন্নতা এবং পূর্ণতা-অপূর্ণতার সংযোগে বিথোফেন যে সুরই তৈরি করেছেন, চলচ্চিত্র পরিচালকরা সেখানে পেয়েছেন আত্মার সজীব সংযোগ। চলচ্চিত্র দুনিয়ায় একটা কথা কিন্তু বেশ প্রচলিত। বলা হয়—“আপনি যদি একটি চলচ্চিত্রও জীবনে দেখে থাকেন, তাহলে অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে আপনি বিথোফেনকে শুনেছেন।”

আইএমডিবি’র তথ্যানুসারে ১২০০-র অধিক চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্রে বিথোফেনের সংগীত ব্যবহার করা হয়েছে।

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে “ডেড পোয়েটস সোসাইটি” চলচ্চিত্রটি নিয়ে এখনো নিয়ম করে সব মহলে কথা হয়। এ সিনেমায় বিথোফেনের “Ode to Joy” যা “Symphony No. 9” নামেও খ্যাত, ব্যবহার করেছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক। শুধু এই সিম্ফোনিটিই নয়, বিথোফেনের তৈরিকৃত “Piano Concerto No. 5”-এর সফল ব্যবহারও আমরা উক্ত সিনেমাতে শুনেছি। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ওপর তারেক মাসুদ নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র “আদম সুরত”-এ পরিচালক তারেক মাসুদ বিথোফেনের “Symphony No. 9” ব্যবহার করেছিলেন।

“ক্রিমসন টাইড”, “লিংকন”, “মিশন ইম্পোসিবল”, “দ্য জু কিপারসওয়াইফ”, “ফ্যান্টাসিয়া”, “মিসারি”, “ক্যালিফোর্নিয়া”-সহ বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোতে বিথোফেনের পিয়ানো সোনাটা কী চমৎকার আবহ তৈরি করেছে। “বিফোরসানরাইজ”, “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড : জুরাসিক পার্ক”, “দ্য এজ অফ ইনোসেন্স”-সহ বিভিন্ন আঙ্গিকের সিনেমাগুলোতে বিথোফেনের “Piano Sonata No. 8”-এর ব্যবহার ঘটনার বাঁক বদলে দিয়েছে নতুন মাত্রা।

এক কথায় বলা যায়, তাঁর স্ট্রিং কোয়ার্টেট, সিম্ফোনির সুর এবং পিয়ানো সোনাটাগুলো ব্যবহৃত হয়েছে—এমন চলচ্চিত্রের নাম বলে এবং লিখে শেষ করা সম্ভব নয়।

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;