বাউল এখন ডিসকো!
ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: একতারা, দোতারা, মন্দিরা হলো লোকগানের প্রাণ। আধুনিক বাদ্যযন্ত্র লোকসংগীত বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত সুর হারিয়ে যাচ্ছে, লোকগানকে তার জায়গায় থাকতে দেওয়া উচিত।
বার্তা২৪.কমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে এমন মন্তব্য করেন বাউল শিল্পী রফিকুল ফেরদৌস। ময়মনসিংহ অঞ্চলে রঙের বাউল ফেরদৌস নামে ব্যাপক পরিচিত। বাউল শিল্পীর চেয়ে বর্তমান সময়ের বাউল শিল্পের আইকন কুদ্দুস বয়াতির শীর্ষ পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর কুদ্দুস বয়াতির রঙে সাজতে চান, যে কারণে নাম নিয়েছেন রঙের বাউল।
গানের টানে স্কুল ছেড়েছিলেন। মারপিটও হজম করতে হয়েছে অনেক। কিন্তু তাকে দমানো যায়নি। নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলছেন। যদিও পরে সমানতালে গান ও লেখাপড়া দু’টোই এগিয়ে নিয়েছেন। দর্শন বিভাগে অনার্স সম্পন্ন করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তবে আজও গানটাকেই আঁকড়ে ধরে আছেন।
শিল্পী ফেরদৌস মনে করেন, বাংলাদেশের মতো এতো সমৃদ্ধ লোকগান খুব কম জাতির রয়েছে। লোকগানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা না গেলে বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাস হুমকির মুখে পড়বে। এসব গানে ছিলো অনেক প্রাণ। যাত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রা শিল্পীরা এখন বাউল গানে ঢুকছে, আর তারা যেভাবে উপস্থাপন করছে তাতে বিকৃত হচ্ছে লোকগান। বাউল এখন ডিসকো হয়ে যাচ্ছে।
আগের দর্শকরা অভিনয় দেখতে পছন্দ করতো। অভিনয়ের মধ্যদিয়ে সমাজের সুখ-দুঃখ অন্যায়-অবিচার তুলে ধরতো। এতে মানুষ অনেক দিক-নির্দেশনা পেতো। শেষ বিচারে কিন্তু সততাই জয়ী হতো। আর তাই দেখে মানুষ সততার পথেই দীক্ষা নিতো, প্রতিবাদের দীক্ষা নিতো। আর এখনকার তরুণ দর্শকরা নাচ দেখতে পছন্দ করে। আর যাত্রা শিল্পীরা যেহেতু কিছুটা গানও জানে তারা নাচের সঙ্গে যেভাবে লোকগান উপস্থাপন করছে। আবার এর সঙ্গে যে সব যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, এতে লোকগানের প্রকৃত সুর হারিয়ে যাচ্ছে।
লোকগানগুলো রক্ষায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা জানেন কতজন শিল্পী রয়েছে। তবে কিছুটা আক্ষেপও ঝরে তার কন্ঠে। বলেন, আমাদের এই অঞ্চলের সংস্কৃতির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। এখানে অনেক দেশখ্যাত শিল্পীর জন্ম হয়েছে। ময়মনসিংহের শিল্পীরা না খেয়ে মরে, আর এখানে অনুষ্ঠান করা হয় কুষ্টিয়া থেকে শিল্পী এনে।
রঙের বাউল বলেন, এবার কাছের মানুষ সংস্কৃতি মন্ত্রী হয়েছে (ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা)। অনেক কিছু দাবি-দাওয়া আবদার থাকবে। অনেক এলাকায় হয় কি-না, আমার জানা নেই, এখানে এখনও অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। অনেক স্কুলে গানের ক্লাস হয়।
বাউল শিল্পীদের অনেকের মধ্যে একাধিক বিয়ে করার প্রবণতা নিয়ে আক্ষেপ ঝরে তার গলায়। বলেন, বাউল শিল্পী হলেই তিনটা-চারটা বিয়ে করতে হবে। যেখানে যাবেন সেখানেই নতুন নতুন সংসার গড়তে হবে এটাকে আমি ঘৃণা করি। এতে বাউলদের সম্পর্কে সমাজে খারাপ ধারণা জন্ম নিচ্ছে।
প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় এক বন্ধুর মাধ্যমে গানে হাতেখড়ি। স্কুল পালিয়ে গান শুনতে যেতেন। এজন্য তার পিঠকে নাকি অনেক মাশুল গুণতে হয়েছে। মাইকের আওয়াজ পেলে সবকিছু ভুলে আবার ছুঁট দিতেন। প্রাইমারি শেষ করে ময়মনসিংহ সদরের লেতু মন্ডল উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তার জন্য সূবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়।
সেখানে সপ্তাহে দুই দিন গানের তালিম হতো। মনির ওস্তাদের কাছে পাকা হয়ে ওঠেন। এরপর মুকুল নিকেতনে উচ্চ বিদ্যালয়ে সালাম ওস্তাদের সংস্পর্শে আসেন। মুকুল নিকেতনে থাকাকালীন সময়ে স্টেজে গান গাওয়া শুরু করেন।
এভাবে আরও অনেক ওস্তাদের কাছে তালিম নেন। এক মঞ্চে গান গাইতে গিয়ে কুদ্দুস বয়াতির সঙ্গে তার পরিচয়। ধীরে ধীরে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এরপর একসঙ্গে অনেক মঞ্চে গেয়েছেন। বয়াতি তাকে শীর্ষের স্বীকৃতি দিয়েছে এটা জীবনের বড় প্রাপ্তি মনে করেন। বিটিভিতে মাটির গানসহ অন্যান্য বেসরকারি টিভিতেও অনেক অনুষ্ঠান করেছেন।
বিভিন্ন শিক্ষণীয় ও জনসচেতনামূলক গান লেখেন। এবারও নির্বাচনের আগে নৌকা মার্কার জন্য গান রচনা করেছেন। বলেন, বেটির (শেখ হাসিনা) জন্য কিছু করতে মন চায়। তাই গেয়েছি। বেটির মতো আর কেউ দেশটাকে এতো ভালোবাসে না।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখনও মনে হয় গানের সা’টাই শিখতে পারিনি। শেখার মধ্যেই আছি। ময়মনসিংহের আঞ্চলিক গান প্রিয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত গেয়ে যেতে চাই। চেষ্টা থাকবে নতুন প্রজন্মকে শেখানোর জন্যও। তারা যেনো আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে লালন করতে পারে।
ময়মনসিংহের ক্রীড়া ও শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস। এখনও অনেক সংগঠন সক্রিয়। সার্কিট হাউসের মাঠকে চারদিকে ঘিরে রেখেছে এসব সংগঠন। এখন চলে সাহিত্যিকদের আড্ডা, ব্রহ্মপুত্র পাড়ে এখনও জমে কবিতার আড্ডা, তার মাঝে বাউল ফেরদৌসেরও কিছুটা ভূমিকা রয়েছে।