‘মিশ্র ভাষা’র জগতে ভাষার শুদ্ধতা জরুরি
ভাষাবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় ‘মিশ্র ভাষা’ বলে একটি ধারণার প্রচলিত আছে। যেখানে বহু জাতি, বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন থাকে, সেখানে মিশ্র ভাষা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ‘মিশ্র ভাষা’ নামক পরিচিতি একেবারেই প্রযোজ্য না হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দিনে দিনে বাংলা ভাষা নানা মিশ্রণে আকীর্ণ হচ্ছে। বিশ্বায়নের আন্তঃযোগাযোগ ও মিডিয়ার কারণে শুদ্ধ ও প্রমিত ভাষায় প্রতিনিয়ত মিশ্রন হচ্ছে, যা থেকে বাংলা ভাষাও রেহাই পাচ্ছে না।
এটাও ঠিক যে, ভাষাকে বয়ে চলতে হলে নানা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে অনেক কিছুই আহরণ করতে হয়। খোদ বাংলা ভাষাতেই অজস্র বিদেশি শব্দ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাংলা ভাষা কাঠামোতে আত্মস্থ হয়েই আছে। বিকৃত মিশ্রণে পরিণত হয়নি। ভাষায় বিভিন্ন নতুন ও বিদেশি শব্দের অন্তর্ভুক্তি গ্রহণযোগ্য হলেও ভাষার মধ্যে অপরিকল্পিত মিশ্রণ বিপজ্জনক।
বাংলা ভাষায় মিশ্রণ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারণ, বাংলা নামে মাঝে মাঝে যা কানে আসে, তাকে ভুল মিশ্রণই বলতে হয়। বিদেশি শব্দ নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করে ভাষাটি ব্যবহার করা হয় না। বরং কিছু বিদেশি শব্দের মতো করে বাংলাকে উচ্চারণ করার এবং ভুল পন্থায় বিভিন্ন বিদেশি শব্দকে জুড়ে দেওয়ার ফলেই এই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। ভাষা প্রবাহটিও এতে ক্ষুণ্ন হচ্ছে বা শুদ্ধতা হারাচ্ছে।
বিশেষ্য, বিশেষণ কিংবা কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া, সর্বনাম ইত্যাদি বাংলা ভাষায় যেভাবে ব্যবহার করা নিয়মসিদ্ধ, সেটা না করা হলেই বাক্য গঠন ও ভাষা কাঠামোতে পতন আসে। এই বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে হয় ভাষা প্রয়োগ ও ব্যবহারের সময়। তাহলেও মিশ্রণ বা দোষণীয় ব্যবহারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। সতর্ক না হলে মিশ্রণ দোষ ঘটা স্বাভাবিক।
বাংলা ভাষাকে মিশ্রকরণের পেছনে দায়িত্ব একজনের নয়, অনেকের। যে স্কুলগুলো বাংলা বলতে চায় না, বাংলা পড়াতে চায় না এবং যে সমস্ত অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের শুদ্ধ বাংলা চর্চা থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে চান, তাদেরকে মার্জনা করার সুযোগ থাকে না। আধুনিকতা বা স্টাইলের নাম করে মাতৃভাষাকে বিকৃত বা মিশ্রিত করার অধিকার কারোই থাকার কথা নয়। এমনি কর্ম (কুকর্ম) যারা করছেন, তাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে বৈকী!
ভাষা বিকৃতি ও মিশ্রকরণের কুপ্রভাব পথে-ঘাটে, পরিবারে, সমাজে পড়ছে। এর পেছনে আরেক অনুঘটক হলো মিডিয়া। বিশেষত এফএম রেডিও’র ব্যাপক প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা রীতিতে একটি অমার্জনীয় অধঃপতন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের উচ্চতর মহল থেকেও এ ব্যাপারে ক্ষোভের উচ্চারণ শুনতে পাওয়া গেছে। ছেলেমেয়েদের ভাষারীতিও বদলে যাচ্ছে এ সমস্যা কারণে।
কম্পিউটারের অবাধ প্রচলনের ফলেও ভাষাকে সংক্ষিপ্তকরণের নামে বিকৃত বা মিশ্রিত করার একটি প্রবণতা দৃশ্যমান হয়েছে। ফেসবুক ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের বহু স্ট্যাটাসে বা মেসেজে এমন ভাষা ব্যবহার বলা হচ্ছে, সাধারণের জন্যে যা ক্ষতিকর। অর্থের দিক থেকে এবং প্রয়োগের দিক থেকে এক্ষেত্রে চরমভাবে শুদ্ধতার হানি ঘটানো হচ্ছে।
বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান মানদণ্ড অবশ্যই এটা যে, ভাষাটি বাংলাদেশের বাংলা ভাষীদের। বিশ্বের সকল বাংলা ভাষীই এই ভাষা পরিমণ্ডলের অংশ। ব্যকরণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতায় পুষ্টি লাভ করেই এ ভাষা চর্চিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পটভূমিটি সামনে না থাকলে বাংলা ভাষার উত্তরাধিকার বহন করার কাজটি যথাযথ হওয়াও অসম্ভব।
বাংলার মতো একটি ধ্রুপদী ভাষা, যা কোটি কোটি মানুষের ভাষা, তা শুধুমাত্র একটি শ্রেণির ভুল ব্যবহারজনিত উদাসীনতায় বিকৃত ও মিশ্রিত হয়ে শুদ্ধতা হারাবে, এমন অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। এই ভুল একই সঙ্গে ইচ্ছাকৃত এবং জ্ঞানের স্বল্পতা জাত। ফলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রতিহত করা আবশ্যক। শুদ্ধ ও বিকৃত বা মিশ্রণ সম্পর্কের সচেতন থাকা দরকার। তাহলেই ভাষার শুদ্ধ ও পরিশীলিত ব্যবহার অব্যাহত থাকা সম্ভব।
বিশ্বায়ন ও আন্তঃসংযোগের ধাবমান যুগে বিকৃতি বা মিশ্রণ ঠেকানো না হলে ভাষার আদি ও অকৃত্রিম রূপ-চরিত্র হারিয়ে যেতে পারে। আমাদের অসতর্কতায় এমন বিপদ যেন না হয়, তা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।