“সাহিত্য কি খেলাধুলা যে প্রতিযোগিতা হয়, এরপর ট্রফি তুলে দেওয়া হবে বিজয়ীর হাতে? এই পুরস্কার তুলে দেওয়ার সংস্কৃতিও উচ্চমন্য ও হীনমন্যকুলের জন্ম দেয়। যাকে বলে এলিটিজম। এ ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর।” (ট্রিনকোয়ান লেকচার, জেমস জয়েস)
জেমস জয়েস এখনো বিশ্বসাহিত্যে লেখকদের লেখক। কিন্তু তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। পাননি লিও তলস্তয়, জোসেফ কনরাড বা হেনরি জেমস, মার্সেল প্রুস্ত, পল ভ্যালেরি, মিলান কুন্ডেরাসহ অসংখ্য সাহিত্যিক। আবার এমন অনেকে পেয়েছেন নোবেল যাদের এখন আর কেউ চেনেই না। কালজয়ী হয়ে ওঠেনি তাদের সৃষ্টি। নাম বললেই ভাববেন, এরা কারা? নামই তো শোনেননি আগে। অথচ পড়েননি তো কম। শোনেন তবে সাহিত্যে নোবেলজয়ী চার নাম আপাতত—হেনরিক শিয়েঙ্কেভিচ, রুদলফ ইউকেন, এলভিন্দ জনসন, জয়েস হ্যারিহননি।
আসলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে নোবেল অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য হলেও পান না। আবার দেখা যায় রাজনৈতিক বিবেচনায় কেউ কেউ পান না, পেলেও পরে নোবেল লরিয়েটের কাছ থেকে পুরস্কার কেড়ে নেওয়া হয়। এ এক মজার রাজনীতি। তবে অপ্রকাশ্য। নোবেল পুরস্কার নিয়ে যে অনিয়ম হয় সে বিষয়ে ২০১৯ সালে বড় স্বীকারোক্তি করেছেন নরওয়েজিন নোবেল কমিটির সেক্রেটারি লিন্ডস্ট্যাড। তিনি বলেন, “১০৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাদ পড়াটা (গ্রেটেস্ট অমিশন) হলো নিঃসন্দেহে মহাত্মা গান্ধীর কখনো নোবেল পুরস্কার না-পাওয়া।” পাঁচবার নোবেল পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছিলেন গান্ধীজি। ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দুবার। শতাব্দীকাল ধরে নোবেল কমিটি যে ঘরে বসে পুরস্কারপ্রাপকদের নাম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে সেই ঘরে বসেই লিন্ডস্ট্যাড জানালেন, “তবে এটা ঐতিহাসিক একটা সত্যি হয়ে থেকে গিয়েছে যে গান্ধী কখনো নোবেল পুরস্কার পাননি।” তাঁর মতে, এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ ছিল নোবেল কমিটির সদস্যদের ইউরোপ-কেন্দ্রিক মনোভাব।
আরো পড়ুন ➥ সৃষ্টিশীলদের খেয়ালিপনা
আক্ষেপের সুরে লিন্ডস্ট্যাড বলেছেন, “নোবেল প্রাইজ ছাড়াও চলে যায় গান্ধীজির। তবে গান্ধীজিকে ছাড়া নোবেল কমিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।” নোবেল পাননি স্টিফেন হকিং। কিন্তু তিনিই কসমোলজিতে কিংবদন্তি। তো, তিনি স্বীকার করে নিলে সাহিত্যেও যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে রাজনীতি হয় সেটি আমাদের না বোঝার কথা না। মিলান কুন্ডেরা ২০১৩ সালে এক ইন্টারভিউতে বলেন, “কেন যে আমার নাম আসে বারবার নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময়। আমি কি নোবেল না পেলে আর মিলান কুন্ডেরা থাকব না?”
কিন্তু নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দুজন খ্যাতিমান। একজন জ্যাঁ পল সার্ত্রে অন্যজন বরিস পাস্তের্নাক। আর বব ডিলানও প্রথমে নিতে চাননি। বেকায়দায় পড়েছিলেন নোবেল কমিটি। পরে অবশ্য বব ডিলান পুরস্কারটা নেন।
ফ্রান্সের জ্যাঁ পল সার্ত্রে বিশ্বখ্যাত ফিলোসফার ও সাহিত্যিক। ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সময় তার নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এবং অন্য কারণে। সার্ত্র মূলত দার্শনিক হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাটক, উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখেছেন। রোডস টু ফিড্রম, আইরন ইন দ্য সোল কার বিখ্যাত উপন্যাস। লিখেছেন আত্মজৈবনিক। তাই তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান সাহিত্যিকদের একজন বলে বিবেচনা করা হয়। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগেই সার্ত্র জানতে পারেন ওই বছরের মনোনীত সাহিত্যিকদের তালিকায় তাঁর নাম আছে। জানার পরপরই চিঠি লিখে তিনি যোগাযোগের চেষ্টা করেন সুইডিশ একাডেমির সঙ্গে। কিন্তু তাঁর চিঠি গিয়ে পৌঁছানোর আগেই ঘোষিত হয় পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্তি ঠেকাতে না পেরে প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেন সার্ত্র। কমিটিকে নিজের অপারগতা জানান তিনি বেশ বিনয়ের সঙ্গে। নোবেল কমিটি বা পুরস্কারকে কোনোরূপ দোষারোপ না করে এই প্রত্যাখ্যানকে একেবারেই ‘ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত’ বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু অনেকে বলেন যে সার্ত্রর এই প্রত্যাখ্যানের নেপথ্যে কারণ তাঁর আগে আলবেয়ার কামুর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। আলবেয়ার কামু ফিলোসফিক্যালি সার্ত্রে দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল গুরু শিষ্যের। আলবেয়ার কামুর মৃত্যু সংবাদে সার্ত্রের চোখে কান্না দেখা গিয়েছিল। কামু পুরস্কারটি পেয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে এবং খবরটি পাওয়ার পর খুব উচ্ছসিত হয়ে নোবেল কমিটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন সার্ত্রে। কিন্তু এরপর সার্ত্র আর কামুর মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়। আগে পুরস্কার পেয়ে কামু এগিয়ে গেলেও কয়েক বছর পর ওই একই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে সার্ত্র হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন নোবেল প্রাপ্তি আদতে তেমন মহান কিছু নয়। কিন্তু সার্ত্রের বন্ধু প্লেভে সেসময় জানিয়েছিলেন, সার্ত্রের মধ্যে আলবেয়ার কামুকে নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। থাকলে তিনি কামু মারা যাওয়ার পর কান্না করতেন না। তিনি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখান করেন নীতিগত কারণেই। নিচে সার্ত্রের চিঠিটি দেওয়া হলো:
১৪ অক্টোবর , ১৯৬৪, প্যারিস
প্রিয় সচিব মহোদয়,
আমি আজই জানতে পেরেছি, কোনো কোনো সূত্র অনুসারে আমি এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেতে পারি। পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার আগে তা নিয়ে কথা বলা অবিবেচনাপ্রসূত মনে হতে পারে, কিন্তু কোনো ভুল বোঝাবুঝি ঠেকানোর জন্য এই চিঠি লিখছি। আপনাকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই যে সুইডিশ একাডেমি, যা অনেক খ্যাতিমান লেখককে সম্মানিত করেছে, তার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ও বস্তুগত কারণে আমি সেসব লেখকের তালিকাভুক্ত হতে চাই না। শুধু ১৯৬৪ সালে নয়, এর পরে কোনো সময়েই এই সম্মান আমার কাঙ্ক্ষিত নয়।
বিনম্র শ্রদ্ধাসহ,
জ্যাঁ পল সার্ত্র
২২ অক্টোবর সুইডিশ ও ২৩ অক্টোবর ফ্রান্সের একটি পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা। এখানে দীর্ঘ বিবৃতিতে তিনি ব্যাখ্যা করেন পুরস্কার গ্রহণে নিজের অনীহার কথা:
“আমি ১৯৪৫ সালের পর থেকে সব ধরনের অফিশিয়াল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে আসছি। আমি জ্যাঁ পল সার্ত্র লিখে স্বাক্ষর করা আর নোবেলজয়ী জ্যাঁ পল সার্ত্র লিখে স্বাক্ষর করা এক নয়। একজন লেখক যখন এই ধরনের কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেন, তিনি আদতে পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।”
সার্ত্রের বন্ধু প্লেভে জানান, “বিশ্বযুদ্ধের পর সার্ত্রে নিউটন বোমার আবিষ্কারকের ‘নোবেল’ নিতে অনাগ্রহী ছিলেন এবং মনে করতেন এ পুরস্কার নেওয়া মানেই নৈতিকভাবে তার মানবিকতার পরাজয় ঘটবে।”
আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন
বরিস পাস্তের্নাক রাশিয়ার জনপ্রিয় কবি, ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক। জন্ম মস্কোতে, ১৮৯০ সালে। মাই সিস্টার, লাইফ (১৯১৭) তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু উপন্যাস লিখেই খ্যাতিমান হন। জীবনের শেষ ভাগে এসে লেখেন উপন্যাস ডক্টর জিভাগো (১৯৫৭) রাশিয়ার সর্বকালের সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর মধ্যে একটি। এটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট শাসনকে ব্যঙ্গ করে লেখা। বইটি প্রকাশের পরের বছর ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে সুইডিশ একাডেমি। তবে এ বইটির জন্য নয়। পুরস্কার দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয় তার কাব্যকে। পুরস্কারের সাইটেশনে লেখা হয়, রুশ গীতিকাব্যে অবদান এবং রাশিয়ার মহাকাব্যিক ঐতিহ্যকে জারি রাখার কারণে তাঁকে এই পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি জানতেন যে পুরস্কারটি পেতে যাচ্ছেন ড. জিভাগো লেখার জন্য। কারণ তাঁর কাব্য তাঁর বিবেচনায় আহামরি কিছু না। সেসব কথা তিনি বলেছিলেন ওই বছরই ২১ ডিসেম্বর ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত দ্য স্ক্রেপসি পত্রিকায়। তিনি পুরস্কার প্রত্যাখান করেন। তিনি মনে করতেন তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন কিন্তু এটি যেন পুঁজিবাদী সমাজ লুফে না নেয় এ পুরস্কার দিয়ে। কিন্তু তাঁর পুরস্কার প্রত্যাখানের বিষয়ে অন্য গল্পও রয়েছে। নোবেল পুরস্কারের ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে নাকি আনন্দিত হন পাস্তের্নাক। সৌজন্যবোধ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যথারীতি ২৫ অক্টোবর তিনি টেলিগ্রাম করেন সুইডিশ একাডেমিকে। কিন্তু এই পুরস্কারে তখনকার সোভিয়েত সরকার মোটেও খুশি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের সময় তখন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঠান্ডা দ্বন্দ্ব চলছে ইউরোপ, আমেরিকার অধিকাংশ পুঁজিবাদী দেশগুলোর। আর নোবেল পুরস্কারকে সমাজতান্ত্রিক শাসকেরা বরাবরই দেখে এসেছেন পুঁজিবাদের প্রকাশ হিসেবে। ফলে ২৫ তারিখেই পাস্তের্নাকের পুরস্কারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। ‘মস্কো লিটারেরি সোসাইটি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের দাবি তুলে স্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচি শুরু করে। পাস্তের্নাক-বিরোধী আন্দোলন ও প্রচারণাও জমে ওঠে। একপর্যায়ে সেটি বড়ো আকার ধারণ করে। পাস্তের্নাককে ‘রাষ্ট্রদোহী’, ‘শত্রুর সঙ্গে আঁতাতকারী’ ইত্যাদি বলে আক্রমণ করতে থাকেন উত্তপ্ত ছাত্র-জনতাসহ সোভিয়েতের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী। পগুঞ্জন রয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে তাঁকে বলা হয়, একবার স্টকহোমে পুরস্কার আনতে গেলে আর কোনো দিন নিজ দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। এ কারণে ভয় পেয়ে নাকি লেখক পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সত্য ছিল তিনি ক্যাপিটেলিজমকে কোনো ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না।
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হ্যান্ড। কিন্তু লক্ষ করুন তিনি নোবেল বিজয়ী হওয়ার পর থেকে তার পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক। বিতর্ক এমন পর্যায়ে চলছে যে অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন। অবশ্য পিটার হ্যান্ডকেও এর জন্য কম দায়ী নন বলে অনেকে মনে করছেন। বর্তমান দুনিয়ায় কিংবদন্তিতুল্য দার্শনিক জিজেক স্লাভক সিএনএনকে বলেছেন বলেছেন, “এবারের নোবেল পুরস্কার এটাই প্রমাণ করে যে, পিটার হ্যান্ডকে অতীতে ঠিক কথাটাই বলেছিলেন।” পিটার হ্যান্ডকে অতীতে কী বলছিলেন সেটি জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে অস্ট্রিয়ান নিউজপেপার ‘ডাই প্রেস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের দিকে নজর দিলে।
তিনি তখন বলেছিলেন, “নোবেলপ্রাইজ শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত।” তিনি আরো বলেছিলেন, “সাহিত্যের মিথ্যা সিদ্ধ ঘোষণা।” ‘গার্ডিয়ান’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ লেখক হারি কানজু বলেছেন, “যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের এমন বুদ্ধিজীবী দরকার, যাঁরা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অবহেলা ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের মুখে মানবাধিকার রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবেন। হান্ডকে তেমন ব্যক্তি নন।” আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এদি রামা বলেছেন, “কখনো ভাবিনি নোবেল পুরস্কারের কথা ভেবে আমার বমিভাব হবে।”
আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার
কসোভোর প্রেসিডেন্ট হাশিম থাচি টুইটে বলেছেন, “নোবেল পুরস্কারের এই সিদ্ধান্ত ভুক্তভোগীদের জন্য অপরিমেয় বেদনা হয়ে দাঁড়াবে।” বিশ্বজুড়ে লেখকদের সংগঠন পেন আমেরিকার সভাপতি জেনিফার ইগান টুইটারে লেখেন, “এমন একজন লেখক যিনি তাঁর কণ্ঠকে ঐতিহাসিক সত্যকে মুছে ফেলতে ব্যবহার করেছেন, তাঁকে নির্বাচিত করা খুবই বিস্ময়কর।” কেন পিচার হ্যান্ডকে এত তোপের মুখে পড়েছেন এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, নব্বই দশকে বসনিয়া যুদ্ধে সার্বদের সমর্থন দেওয়ার কারণে হ্যান্ডকে অত্যন্ত বিতর্কিত ছিলেন। পিটার হান্ডকের বিরুদ্ধে আলোচিত স্রেরেব্রেনিৎসা গণহত্যাকে অস্বীকার করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি যুদ্ধাপরাধী স্লোভেদান মিলোসোভিচেরও ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। বসনিয়া যুদ্ধে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোভেদান মিলোসোভিচের নেতৃত্বে সার্ব বাহিনী ১৯৯৫ সালের ১১ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ১২ দিনে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেরেব্রেনিৎসা শহরের আট হাজারের বেশি মুসলিম পুরুষ ও ছেলেশিশু হত্যা করে। নারীদের বন্দীশিবিরে রেখে ধর্ষণ করা হয়। ২০০৬ সালে পিটার হ্যান্ডকে সার্বিয়ার নৃশংসতার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন এবং সার্বিয়ার ভাগ্যকে ইহুদিদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যদিও তিনি পরে ওই মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “মুখ ফসকে বেরিয়েছে।” সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব ম্যাটস ম্যালম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, “কমিটি কেবল সাহিত্যিক ও নান্দনিক গুণাবলির ভিত্তিতেই বিজয়ীকে বাছাই করেছে এবং একাডেমির জন্য এরকম বাধ্যবাধকতা নেই যে, তাকে রাজনৈতিক বিবেচনার বিপরীতে সাহিত্যমূল্যের সমন্বয় করতে হবে।”
নোবেল কমিটি যাই ব্যাখ্যা দিক, লক্ষ করুন কারা পিটার হান্ডকের সমালোচনা করেছেন? নিপীড়িত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাই।
আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিকেই যদি তাকাই তবে দেখি তাঁর জীবনেও আছে অনেক বিতর্কিত অধ্যায়। তিনি হিন্দু মৌলবাদী ফাদার সংগঠন ‘হিন্দু মহাসভা’র নেতা বালগঙ্গাধর গ্রেফতার হলে চাঁদা তুলেছিলেন জামিনের জন্য। ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসক বেনিতো মুসোলিনির প্রশংসা করেছিলেন। অবশ্য তার আগেই ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পেয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইতালিতে যান। সেবার মুসোলিনির এক কাছের জন ফরমিচি রবীন্দ্রনাথের জন্য জাহাজভর্তি বই পাঠান। পরের বছর আবার যান রবীন্ত্রনাথ। দেখা হয় এবার মুসোলিনির সাথে। মুসোলিনি জানান, ইতালীয় ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রনাথের সব লেখা তিনি পড়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে আর পায় কে? খুশি হয়ে যান। মুসোলিনির চাল বুঝতে পারেন না।
পরের দুই সপ্তাহে রবীন্দ্রনাথ ইতালির রাজাসহ রোমের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। দেন কয়েকটি বক্তৃতাও। একটিতে মুসোলিনি উপস্থিত ছিলেন। সেবার সফরের শেষদিকে রবীন্দ্রনাথ ফের দেখা করেন মুসোলিনির সঙ্গে। তখন রবীন্দ্রনাথ যত্রতত্র ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির প্রশংসা করে বেড়াচ্ছেন। পরে নিজে নিজের ভুলটা বুঝতে পারেন। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদসহ সব ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবল বিরোধিতা করেছেন।
আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত
আর্জেন্টাইন হোর্হে লুই বোর্হেসের চিলির অগাস্তো পিনোশে, স্পেনের ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, আর্জেন্টিনার হোর্হে রাফায়েল ভিদেলারের প্রশংসায় মুখর ছিলেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী হিটলারের বিরোধিতা করেন। আবার পেরন শাসনের বিরোধীতায় আর্জেন্টিনার কমিউনিস্ট পার্টির দোদুল্যমানতা দেখে বোর্হেস কমিউনিজমের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেন। শুধু আস্থা হারিয়ে ফেলা নয়, সমর্থন করেন সামরিক জান্তাকে। বোর্হেসের সেই বিখ্যাত উক্তি জানেন তো! তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্রে তাঁর আর আস্থা নেই। অন্য দেশের জন্য ভালো হলেও হতে পারে, কিন্তু চিলি বা আর্জেন্টিনায় এটি কার্যকর কোনো পদ্ধতি নয়।
অবশ্য একদা কমিউনিস্ট সমর্থক ছিলেন বলেই হয়তো নোবেল কমিটি তার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। বোর্হেসকে আর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তবে তিনি তাদের মনোনীত সংক্ষিপ্ত তালিকায় দুবার ছিলেন। ১৯২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন ন্যুট হামসুন। ২৫ বছর পর আডলফ হিটলারের মৃত্যুতে শোকবার্তা লিখেছিলেন, “হিটলার ছিলেন মানবজাতির যোদ্ধা। সব জাতির জন্য ন্যায়বিচারের বার্তা প্রচারক।” এরপর ন্যুট হ্যামসনের নোবেল পুরস্কারের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে নেয় নোবেল কমিটি। শেষ জীবনে ন্যুট হ্যামসন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। তখন স্যানাটোরিয়ামে শুধু বিড়বিড় করে নাকি বলতেন, “আমার হিটলারের পক্ষ নেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি।”
নোবল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একজন লেখক সম্পর্কে আলোচনা করলেই এ বিষয়ে রাজনীতিটা পরিষ্কার হয়ে যায়; তিনি চিনুয়া আচেবে। পশ্চিমের অনুসারী না হবার কারণেই এই পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন নাইজেরিয়ান এই মহান লেখক। তিনি একজন মৌলিক ও অত্যন্ত শক্তিমান ঔপন্যাসিক। ম্যানবুকার প্রাইজপ্রাপ্ত লেখক চিনুয়া আচেবে আঙুল দিয়ে দেখান পশ্চিমের আফ্রিকা দেখার চোখকে: “মানুষ আফ্রিকা যায়। সেখানে তাদের চোখ তা-ই দেখে, যা তাদের মন ইতোমধ্যেই বিশ্বাস করে বসে আছে। ফলে প্রকৃতই চোখের সামনে যা আছে, ব্যর্থ হয় তা দেখতে। পশ্চিমারা আফ্রিকাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশ হিসেবে গণ্য করে না। তাদের কাছে, আফ্রিকা দুনিয়ার যত আজগুবি, অবিশ্বাস্য আর অযৌক্তিক বস্তুতে ভরপুর।” 'আর কিছু বলার দরকার আছে কি? আছে আছে। ভারসাম্য রাখার জন্য অবশ্য নাইজেরিয়ারই ওলে সোয়েনকাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ঠিক আছে তো!