সৃষ্টিশীলদের খেয়ালিপনা

কোলাজ মন্তাজ



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

কেন সৃষ্টিশীলদের মধ্যে একটু খেয়ালিপনা থাকে? এ প্রশ্ন করা হয়েছিল পাভলভকে। তিনি বলেছিলেন, “তারা তুলনামূলকভাবে বেশি সংবেদনশীল ও অগ্রসর চিন্তার হন। ফলে প্রচলিত সমাজে তারা একটু মিসফিটই থাকেন। এই মিসফিট থাকাটাকেই অনেকে ভাবেন খেয়ালিপনা। এর বেশি কিছু নয়।”

“অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গড়তে হয় একেকটি চরিত্র; সেই চরিত্রগুলো ধীরে ধীরে গল্প হয়ে ওঠে—একের এর এক শব্দের গাঁথুনি, সে বড় সহজ কাজ নয়।’ লেখক হয়ে ওঠার গল্প বলছিলেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ভি এস নাইপল। “আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কী লিখব তার কিছু্ই জানতাম না। কিন্তু লিখব, এটা জানতাম। আমি বুঝতে পারলাম যে এজন্য আমাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব বিব্রতকর ছিল। আসলে লেখাঝোঁকা পাগলামি ছাড়া আর কিছু্ই না। আবার এটাও বলতে হয়, কোনো কিছুই খুব সহজ না। অনেক চিন্তাভাবনা করে তারপরেই একটা কিছু দাঁড়ায়।” নোবেলজয়ী এই সাহিত্যিক বলেন, ‘আমি লেখক হতে চাইছিলাম, কিন্তু জানতাম না কী লিখব। আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম বাবার জন্য, আমার অনেক লেখায় আমার বাবার জীবনের ছাপ রয়েছে।” তাঁর জীবনে নাদিরা আসার পর তিনি লেখার টেবিলে বসতেন নাদিরাকে গভীর চুম্বন করে। একটা সময় তার বুকপকেটে নোটবই নিয়ে ঘুরতেন। তার কাছে যাদের ভিন্নরকম মনে হতো, তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। এবং সেগুলো লিখে রাখতেন। একবার এক সেনা কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন করে বিপদেই পড়েছিলেন। প্রশ্নটা ছিল, “আপনি তো বীরের মতো লড়াই করতে পারবেন? কিন্তু আপনি কি সেক্সুয়ালি স্ট্রং?”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও পাগলামি ছিল। বিভিন্ন ডিজাইনের কলম সংগ্রহের শখ ছিল। কিন্তু তিনি সেই কলমগুলো দিয়ে খাতায় একটি আঁচড় কেটেও দেখতেন না। শান্তি নিকেতনে ঘন ঘন বাড়ি বদলাতেন। নারিকেল তেল দিয়ে ভেজেও রুটি খেয়ে দেখেছেন প্রথম। কাজী নজরুল ইসলামের খেয়ালের হিসাব ছিল না। নজরুলের একটা বিশেষ খেয়াল ছিল, ওঁনার মনে কোনো আনন্দ বা উল্লাস জাগলে তিনি চিৎকার করে উঠতেন, “দে গরুর গা ধুইয়ে।” ধূমকেতুর কবিকে দেখতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। একদিন সকালে নজরুল গেলেন ঠাকুর বাড়িতে। আঙিনায় ঢুকতে ঢুকতে ডাকলেন, কবি কবি! কবি বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। আর নজরুল রবীন্দ্রনাথকে দেখেই বলতে শুরু করলেন, “দে গরুর গা ধুইয়ে!”

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আরেক অদ্ভুত খেয়াল ছিল। বাড়িতে তো বটেই বাইরে কোথাও সভা সমিতিতে গেলে সবসময় সঙ্গে একটা মোটা মুগুর জাতীয় জিনিস নিতেন। গাড়িতে বা সভাতে যেখানে বসতেন হাতের নাগালের মধ্যেই রাখতেন। একবার এক লেখক সাহস করে জানতে চেয়েছিলেন, সঙ্গে মুগুর কেন? সহাস্য তিনি যা উত্তর দিয়েছিলেন, তার ভাবার্থ হলো, ওঁনার মধ্যে সব সময় একটা অজানা ভয় কাজ করত। ভাবতেন, কেউ বোধহয় অকস্মাৎ আক্রমণ করবে। তাই আত্মরক্ষার জন্য ওই মুগুর রাখা। অবশ্য এ খেয়াল বেশিদিন ছিল না। মাস সাতেক ছিল।

বিভূতিভূষণের সেই পারলৌকিক বিশ্বাস এতটাই তীব্র ছিল যে, মৃত্যুর কিছু দিন আগে এক শ্মশানে নিজের মৃতদেহকে নাকি নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। তারাশঙ্করের মামলা-মকোদ্দমা করার এক উদ্ভট খেয়াল ছিল। সুযোগ পেলেই তিনি কারো বিরুদ্ধে মামলা ঠুঁকে দিতেন নিঃসঙ্কোচে। শিবরাম চক্রবর্তী, তিনি বলতেন বা লিখতেন শিব্রাম চক্কোত্তি। উচ্চ বংশের ছেলে হয়েও সারা জীবন মেসেই কাটিয়েছেন। তার এক অদ্ভুত খেয়ালের মধ্যে ছিল কোনো ব্যক্তির তথ্য, ফোন নাম্বার খাতায় সংগ্রহ করে রাখতেন। তার মেসের দেয়ালটাই ছিল বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র সেতুবন্ধন। তার মেসবাড়ির ঘরের পুরনো দেয়াল বিভিন্ন লোকের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বারে পরিপূর্ণ ছিল।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন

এবার বলি কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। কবি একা একা হেঁটেছেন, কখনো ঘুমের মধ্যে, কখনও বা স্বপ্নে। তাঁর কবিতার মতো কবিও এক বিচিত্র খেয়ালে শিশিরে ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়েছেন বারবার। সরীসৃপ শীতল অন্ধকারে হেঁটে গেছেন পার্কে ঘাসে, ট্রাম লাইনের বুকে। কবিপত্নী লাবণ্য দাশ রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে দেখতেন, কবি পাশে নেই। কী করতেন তখন কবি? কোথায় যেতেন? কবির বন্ধুদের লেখায় জানতে পারি, কবি ঘর ছেড়ে অন্ধকারে একা পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকতেন। কখনো-বা ঘাসে পড়ে থাকা শুকনো ডাল তুলে নিয়ে অন্ধকারে গাছের দিকে ছুড়ে দিতেন। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলে বলতেন, গাছের ডাল দিয়ে গাছকে মারি কেন জানো? যেমন নিজের হাত নিজের গায়ে লাগলে আমাদের ঘুম ভাঙে না, তেমনই গাছের ডাল দিয়ে গাছকে মারলে গাছের ঘুম ভাঙে না। অথচ গাছে আশ্রয়কারী যে পাখিগুলো তারা জেগে উঠবে! আর সেই এক সমুদ্র অন্ধকারের বুকে তাদের কিচির মিচির শব্দ আমাকে আরো এক গভীরতর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে। “অনন্ত নক্ষত্র-বীথি তুমি অন্ধকারে!” বলুন তো, এ খেয়ালের কোনো অনুভব কি আমাদের চেতনায় জাগাতে পারব?

কমল কুমার মজুমদার শেষের দিকে মনে করতেন তাকে দিয়ে কেউ লেখায়, মানে তিনি লেখেন না। তিনি বসে আড্ডা দেওয়ার চেয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। উল্টোদিকে মানিক বন্দোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায় আড্ডা মানেই মদ থাকতে হবে। মাতাল না হলে কি আড্ডা জমে। মানিক প্রতিদিনের বাজার-খরচের তালিকায় দেশি বাংলা মদের খরচও লিখে রাখতেন। শক্তি তো খালাসিটোলায় মদ খেয়ে প্রায় পথ হারিয়ে ফেলতেন। দেখা গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাসায় গিয়ে সন্দীপন সন্দীপন ডাকছেন। রামকিংকর বেজ গাঁজা খেতেন। গাঁজা খাওয়ার পর কেউ তার পাশে গেলেই বলতেন, “তুমি কি সাওতালী নাচ দেখেছো কখনো? সাওতালী নাচ দেখবে? আমি নেচে দেখাব।’

আমাদের দেশের শিল্পী সুলতান একসময় শাড়ি পরতেন। হাসনাত আবদুল হাই তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, শাড়ি পরেন কেন? সুলতানের সাদাসিধে জবাব, “রাধাভাবে পাইছে।” হুমায়ুন আজাদ একা কোথাও রাত্রি যাপন করতে ভয় পেতেন। সে ভয় তাড়ানোর জন্য মদ গিলতেন। বাংলা প্রসঙ্গে ফের পরে বলি, এখন একটু পশ্চিমে তাকাই।

অ্যাডলফ হিটলার। তার বিচিত্র শখও চমকে দেওয়ার মতো। তার অদ্ভুত শখের মধ্যে ভায়োলিনের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। অ্যাডলফ হিটলার ছোটবেলা থেকেই ভায়োলিন বাজাতে পারদর্শী ছিলেন। সেই সময়ে তিনি জার্মানির অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভায়োলিন বাদক ছিলেন। হিটলারের নির্দেশে যত খুন ও হত্যাযজ্ঞ করা হয়েছে এর প্রত্যেকটির পর তিনি তার ভায়োলিনটি বাজিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেন। দুঃখ প্রকাশের ভঙ্গিমা আমেরিকান লেখক জ্যাক লন্ডনেরটি ছিল মজার। তিনি সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। পরিচিত কেউ মারা গেলে সেখানে উপস্থিত হয়ে মাথা থেকে হ্যাট খুলে নীল ডাউনের ভঙ্গিমায় বসে বলতেন, “যীশু তোমার অসুস্থতা কামনা করি।” একেকজন মানুষের ঘুমানোর স্টাইল একেক রকম। কেউ ডান দিকে কাত হয়ে ঘুমান, কেউ বামে, চিত্ বা উপুড় হয়ে ঘুমান। চার্লস ডিকেন্সের এই অদ্ভুত শখটি ঘুমানোর স্টাইলের সাথে সম্পর্কিত। চার্লস ডিকেন্স যিনি ভিক্টোরিয়ান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইংরেজ ঔপন্যাসিক হিসেবে সুপরিচিত। এই ইংরেজ ঔপন্যাসিক সবসময় উত্তর দিকে মাথা রেখে ঘুমাতেন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন যে এভাবে ঘুমানোর ফলে তাঁর লেখালেখি ভালো হবে। একজন বয়সে তরুণ ইংরেজ কবি, তাঁর প্রায়ই মনে হতো পাখি যদি উড়তে পারে তিনি কেন পারবেন না! যেমন ভাবা তেমন কাজ, দোতলার বারান্দা থেকে একদিন পাখি হয়ে গেলেন। মানুষ-কবি কল্পনায় যত পাখি হন না কেন, বাস্তবে তো আর পারবেন না। তাই ঘাড়মুখ গুঁজে পড়লেন বাগানের ঝোপের মধ্যে। হাতের হাড় ভেঙে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেন।

এ রকমই খেয়ালি ছিলেন কবি জন কীটস্। কবি ওয়ার্ডস ওয়ার্থ রোজ বিকেলে তাঁর পোষা কুকুরগুলোকে নিয়ে বেড়াতে বের হতেন। একটু ফাঁকা কোনো জায়গা পেলে দাঁড়িয়ে পড়তেন। নিজের সেদিনের লেখা কবিতা জোরে জোরে আবৃত্তি করতেন। কুকুরগুলো চুপচাপ কানখাড়া করে শুনলে, উনি বুঝে যেতেন কবিতা ঠিক আছে। আর যখন কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে আওয়াজ দিত, তখন উনি বুঝতেন এ কবিতাটা ঠিক হয়নি। ছন্দ বা শব্দচয়নে গোলমাল হয়েছে কোথাও। বাড়ি ফিরে আবার সংশোধন করতেন। তারপর বন্ধুদের সামনে পড়তেন বা পত্রিকায় ছাপতে দিতেন। কিন্তু, আপনারা কেউ শুনেছেন এমন সব সাহিত্যরসিক কুকুরদের কথা? নিশ্চয়ই না।

কৈশোরে যার অ্যাডভেঞ্চার পড়ে আমার বুক কাঁপত, আর যৌবনে যাঁর ‘টয়লার্স অব দ্য সি’ পড়েছি, সেই লেখক ভিক্টর হুগোর পাগলামি বা খেয়ালের জন্য এখন তার পরিণতির কথা ভাবলে মায়াই লাগে। জানি না কেন তার মধ্যে কোনো বিচিত্র ধ্বংসাত্মক খেয়াল ছিল। সমুদ্রে যখন ঝড় উঠত, বাতাস অস্থির, অবিরল ধারায় বৃষ্টি ঝরত, সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে একা নৌকো নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। তাঁর লেখার মতো তাঁর খেয়াল ছিল এমনই বুক কাঁপানো! এমন পাগলামি তার মৃত্যু ডেকে এনেছিল। সত্যি সত্যি সেই ভিক্টর হুগো খেয়ালের বশে ওই রকম এক দুর্যোগপূর্ণ রাতে অস্থির সমুদ্রের বুকে নৌকাবিহারে বেড়িয়েছিলেন, আর কোনোদিন ফিরে আসেন নি।

সাগরপ্রেমিক ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়েও ভিক্টর হুগোর মতোন। ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ বইয়ের নাম সবার জানা। তার শখ ছিল শিকার করা। আর শুধু শিকার করলেই তো হবে না, তার স্মৃতি-চিহ্ন তো রাখতে হবে। তাই শিকার করা পশুর দেহাংশ শোভা পেত তাঁর ড্রয়িংরুমে, লেখার ঘরে, দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে, এমন কি বেডরুম পর্যন্ত। তাঁর এই বিচিত্র খেয়ালের জন্য বন্ধু প্রতিবেশি, এমন কি আত্মজনেরা পর্যন্ত বাড়ি আসা বন্ধ করে দিয়েছিল মৃত পশুর চামড়ার পচা দুর্গন্ধের ঠেলায়। কিন্তু তিনি কোনো দুর্গন্ধ পেতেন না। তার প্রথম বউ এসব কারণে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি দমেননি।

ফরাসি লেখক আলেক্সান্ডার ডুমার খেয়ালে রুচির ছাপ ছিল। তিনি বিভিন্ন রঙের কাগজ পছন্দ করতেন। এই তথ্য বেশ প্রচলিত যে, ফরাসি লেখক নীলরঙের কাগজে উপন্যাস লিখতেন, গোলাপি রঙের কাগজ রেখেছিলেন কবিতা লেখার জন্য এবং পত্রিকায় ছাপানোর জন্য তিনি লেখা পাঠাতেন হলুদ রঙের কাগজে। আগাথা ক্রিস্টিরও লেখার ব্যাপারে ছিল বিচিত্র খেয়াল। আমরা সবাই চেয়ার বা টেবিলে বসে লেখালেখি করে থাকি। কিন্তু ইংরেজ অপরাধ কল্পকাহিনীর প্রথিতযশা লেখক আগাথা ক্রিস্টি জীবনে কখনো চেয়ার বা টেবিলে বসে লিখতেন না। কখনো রান্না ঘরে রান্না করতে করতে বা ট্রেনে ভ্রমণ করতে করতে অথবা হোটেল রুমে বসে তাঁর লেখালেখি চালিয়ে যেতেন। তাঁর চেয়ার টেবিলে বসে লিখবার অভ্যাস যেমন ছিল না, এমনকি তাঁর কোনো নিজস্ব অফিস ছিল না।

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

ক্যালভিনো গুরুত্বপূর্ণ ইতালিয়ান লেখক। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ইতালীয় সাহিত্যে যে বিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল, ক্যালভিনো ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগামী। তিনি লেখার আগে জুয়া খেলতেন। যেদিন আর্থিক সংকট থাকত সেদিন জুয়াও খেলতেন না। লিখতেনও না। এমন খেয়াল অবশ্য রুশ সাহিত্যিক দস্তয়ভস্কির মধ্যে ছিল। তিনিও জুয়া খেলতেন এবং বাজির শেষদানে না হারা পর্যন্ত খেলেই যেতেন। যেই হারতেন তখন বলতেন, “এখন আমার হারানোর কিছু নেই। লেখাই এখন উপযুক্ত সময়।” এবার মনে করুন কোনো চিত্রশিল্পী এক নির্জন ফসলহীন মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজের কান নিজে কাটলেন। তারপর সেই রক্তাপ্লুত যন্ত্রণাবিকৃত আপন মুখচ্ছবি ক্যানভাসে চিত্রিত করলেন। আমরা তো ভাবব পাগলামির চূড়ান্ত। সেই সাথে সাথে এটাও ভুললে চলবে না, কী অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণা আর প্রেমহীন হতাশা থেকে সেদিন শিল্পী ওই কাজটি করেছিলেন। এই শিল্পীর নাম ভ্যান গঁঘ। পরে অবশ্য সত্যি সত্যি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন।

মনে করুন একজন লেখক, তিনি পুরুষ। সারাদিন বসে লেখেন। কিন্তু যেই সন্ধ্যে হয়, মহিলাদের মতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি করে সাজেন। স্নো পাউডার কাজল রুজ—সবই ব্যবহার হয়। তারপর গায়ে দামি আতর ছড়িয়ে নৈশ বিহারে বেরিয়ে পড়েন। ইনি একজন পৃথিবীখ্যাত ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার।নাম তার গি দ্য মোপাসাঁ। সুইডিশ লেখক অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ ছিলেন একাধারে নাট্যকার, ঔপন্যাসিক এবং ছোট গল্পের জাদুকর। তার জন্ম ১৮৪৯ সালে। সেই বছরেই আরেক বিখ্যাত লেখক এডগার অ্যালান পো মারা যান। অগাস্ট সবসময় ধারণা করতেন, অ্যালান পোর আত্মাই তার ওপর ভর করে আছেন। পো তাকে দিয়ে সব ধরনের লেখা লিখিয়ে নিচ্ছেন। হ্যানস ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসন লেখক হিসেবে যেমন প্রসিদ্ধ ছিলেন তেমনি নানারকম অদ্ভুত খেয়ালের ব্যাপারেও তার জুড়ি মেলা ভার। হ্যানস পুড়ে মারা যাওয়ার ভয়ে বেশ ভীত ছিলেন। তিনি এতটাই ভীত ছিলেন যে, তিনি যেখানেই যেতেন, একটা লম্বা দড়ি সঙ্গে রাখতেন। যদি কোনো কারণে আগুন লাগে আর তিনি উপরতলার কোনো ঘরে সেই সময় ঘুমোন, তাহলে যেন দড়ি বেয়ে নিরাপদে নিচে নেমে আসতে পারেন—এই আশায়।

ঔপন্যাসিক নাথানিয়েল হাওথর্নের কিশোর বয়সের একটা প্রিয় খেলা ছিল নিজেকে কোনো অন্ধকার ঘরের মধ্যে আটকে রেখে কল্পনা করা যে, ঘরটার চাবি হারিয়ে গেছে। রুশ কবি মায়াকোভস্কি খেয়াল ছিল লাল কালিতে লেখা। তাই তাঁর কবিতাকে বলা হতো লাল কবিতা। প্রেমের কবিতার জন্য তিনি পৃথিবী বিখ্যাত। কবি আত্মহত্যা করেছিলেন। আর আত্মহননের ঠিক আগে যে শেষ কবিতাটা লিখেছিলেন, সে কালির রঙও ছিল লাল। তবে তা নিজের রক্তের রঙ। হাতের শিরা কেটে সেই রক্তে কলম ডুবিয়ে লিখেছিলেন শেষতম স্বগতোক্তি!

জন শিভার ছিলেন পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হওয়া একজন আমেরিকান ঔপন্যাসিক। তার অভ্যাস ছিল বিচিত্র। তিনি সক্কাল বেলা ঘুম থেকে উঠে স্যুটেড বুটেড হয়ে বেসমেন্টে যেতেন। এরপর স্যুট প্যান্ট খুলে কেবল বক্সার এবং শার্ট পরে লিখতে বসতেন। লাঞ্চ টাইমে আবারও স্যুটেড ব্যুটেড হয়ে একটি স্যান্ডউইচ খেয়ে এসে আবারও পোশাক খুলে লিখতে বসতেন। জন শিভার তো তাও কিছু একটা পরে লিখতেন। কিন্তু তার চেয়ে পোশাকের ব্যাপারে এগিয়ে ছিলেন ট্রুম্যান ক্যাপোট। তিনি বসে লিখতে পারতেন না। আদুরে বেড়ালের মতো বিছানায় বা সোফায় শুয়ে শুয়ে লিখতেন। তাতে কোনো অবাক হওয়ার ব্যাপার নেই, তাই তো? কিন্তু তিনি লেখার সময় নগ্ন থাকতেন। কেন থাকতেন এ ব্যাপারে অবশ্য মুখ খোলেননি।

বিখ্যাত ইংরেজ কবি ও সমালোচক জন ড্রাইডেন। তিনি পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকতেন বেশি। তাই তার স্ত্রী লেডি এলিজাবেথের প্রতি তেমন মনোযোগ দিতেন না। একদিন স্ত্রী তার পড়ার ঘরে ঢুকে রেগে গিয়ে বললেন, “তুমি সারাদিন যেভাবে বইয়ের ওপর মুখ গুঁজে পড়ে থাকো তাতে মনে হয় তোমার স্ত্রী না হয়ে বই হলে বোধহয় তোমার সান্নিধ্য একটু বেশি পেতাম।” ড্রাইডেন তখন বইয়ের ওপর মুখে গুঁজে রেখেই বললেন, “সেক্ষেত্রে বর্ষপঞ্জি হইও, বছর শেষে বদলে নিতে পারব।” এমন কথার পর নিশ্চয়ই ড্রাইডেনের স্ত্রীর তার সাথে সংসার করার কথা না। কিন্তু করেছেন। ড্রাইডেন ‘চিনাকা’ পুরস্কারে সম্মানিত হবার পর একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবাই যখন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখন তার স্ত্রীকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলে তিনি বলেছিলেন, “তিনি এত জ্ঞানী যে, আমার সাথে বিছানায় বাতি নিভিয়ে শোওয়ার সময়ও হাতে বই থাকলে খুশি হন।” ড্রাইডেন তখন বলেন, “এই বই-ই আমাকে বিখ্যাত করেছে। আর তুমি তার বউ।”

বিখ্যাত বা জনপ্রিয় হওয়ার নেশা সালভাদর দালির মাঝেও ছিল। একটু বেশি পরিমাণেই। ১৯০৪ সালের ১১ মে স্পেনের ক্যাটালোনিয়ার ফিগুয়েরেস শহরে সালভাদর দালির জন্ম। বিশ্বখ্যাত চিত্রকর। যৌবনে যখন দালি আমেরিকায়, বলাই বাহুল্য তখন তিনি খুব পরিচিত মুখ ছিলেন না। নিউইয়র্কবাসীর কাছে নিজেকে তুলে ধরতে দালি রাস্তায় হাঁটার সময় হাতে ঘণ্টা রাখতেন। যখন মনে হতো পথচারীরা তাঁর ওপর দৃষ্টি দিচ্ছে না, অথবা বেশি মানুষের সমাগম যেখানে—সেখানে তাঁর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে তিনি একটানা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করতেন! যাতে তাঁর দিকে জনসাধারণ দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়। তাঁর এমন কাণ্ডের সুবাদে অল্প কদিনেই দালি হয়ে উঠলেন শহরের পরিচিত মুখ। মানুষ যখন দালিকে রাস্তায় হাঁটতে দেখত, তারা আশঙ্কা করত এবং সাথে সাথে উদগ্রীব থাকত অদ্ভুত, পাগলাটে কোনো ঘটনার জন্য। কারণ ততদিনে তারা জেনেছে, দালি মানেই বেখাপ্পা কিছু ঘটবে, ঘটতে চলেছে...। তাই সিগমুন্ড ফ্রয়েড দালিকে দেখে বলেছিলেন—“স্পেনীয়দের মধ্যে এমন ফ্যানটিক আমি আর দেখিনি।” দালির ভাষ্যমতে, “বিদায় নেওয়ার আগে ভাবলাম, প্যারানয়া বা মস্তিষ্কবিকৃতিবিষয়ক আমার (দালির) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ তাঁকে (ফ্রয়েডকে) দিই। যে ম্যাগাজিনে লেখাটি ছাপা হয়েছিল, পাতা বের করে তাঁকে সবিনয় অনুরোধ জানালাম সময় পেলে তিনি যেন তা পড়ে দেখেন। পত্রিকাটির দিকে কণামাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে ফ্রয়েড আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি আগ্রহী হবেন এই ভেবে আমি বললাম, লেখাটি কোনো পরাবাস্তববাদী চালাকি নয়, বরং অতি উচ্চাশাপূর্ণ একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ। লেখাটির নাম পুনরাবৃত্তি করে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়েও দিলাম। সম্পূর্ণ অমনোযোগী ফ্রয়েডের সামনে আমার গলা ক্রমশ উচ্চকণ্ঠ হয়ে আসছিল। তারপর, আমার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ অভিনিবেশ পরিবর্তন না করে স্তেফান জিভিগের দিকে তাকিয়ে ফ্রয়েড মন্তব্য করলেন, ‘আমি এর আগে এরকম একজন আপাদমস্তক হিস্পানীয়কে দেখিনি। আস্ত পাগল!”

কিন্তু ফ্রয়েডও তো কম পাগল ছিলেন না। ফ্রয়েড শব্দের বাংলা অর্থ করলে যা বোঝায় তাহলো ‘আনন্দ’। তো, জীবনে তিনি মানুষের মনোজগত নিয়ে সিরিয়াস চিন্তাভাবনা করলেও তিনি কি বলতে পারবেন তিনি মাঝেমাঝে কেন একটি ঘটনা প্রায়ই ঘটাতেন? সেই ঘটনার কোনো মনোবিশ্লেষণও তিনি করেননি কোথাও। কিন্তু হ্যারি ফিলার্সের ফ্রয়েডকে নিয়ে লেখা জীবনীগ্রন্থে দেখা যায়, “ফ্রয়েড যুবা বয়সে মাঝে মাঝে কোনো রেস্তেরাঁয় ঢুকে দেখা গেল খাচ্ছেন। তার আশপাশের টেবিলেও খাবারে ব্যস্ত লোকজন। সেই রেস্তেরাঁগুলোতে কোনো মিউজিকও বাজত না। না ছিল কোনো ড্যান্স ফ্লোর। কিন্তু হঠাৎই দেখা যেত ফ্রয়েড বিল মিটিয়ে তুলনামূলক একটু খোলামেলা জায়গা রেস্তেরাঁর ভেতরই বেছে নিয়ে কোমর দুলিয়ে নাচতেন এবং বলতেন, ‘আই এ্যাম ফ্রয়েড, আই এ্যাম ফ্রয়েড।” এ কি মনোযোগ কাড়ার জন্য নয়?

আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত

ফিরে আসি ফের বাংলায়। কলকাতার রমাপদ চৌধুরীর একটা অদ্বুত অভ্যাস ছিল। সেটি মাথার নিচেও বালিশ দিতেন এবং চিত হয়ে শুয়ে পায়ের নিচেও বালিশ দিতেন। বালিশের কথা যখন এলোই তখন মনে পড়ে গেল সুনীল ও শক্তির একটা যুবা বয়সের ঘটনা। তারা দুজন এলএসডি খেয়ে নেশায় মত্ত হওয়ার পর এক রুমে দু বিছানায় শুয়ে আছেন। হঠাৎ সুনীল তাকিয়ে দেখেন শক্তি ওপরের ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বালিশের তুলা বের করে বাতাসে উড়াচ্ছেন। কেন কেন? জানতে চাইলেন? শক্তি জবাবে বললেন, “ওই ফ্যানে আমার অণ্ডকোষ ঘুরছে এমন মনে হচ্ছে।”

ফ্যান নিয়ে ঘটনা আছে গৌরকিশোর ঘোষের জীবনে। তখন তিনি ট্রিলজির ‘প্রেম নেই’ উপন্যাস লিখছেন। দেশভাগের ওপর এ উপন্যাসের পটভূমি। তখন তার মধ্যে ভীষণ মৃত্যুচিন্তা কাজ করত। তো যখনই মৃত্যুচিন্তা বেশি ভর করত তখনই ঘরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে ফ্যান ছেড়ে তাকিয়ে থাকতেন একদৃষ্টিতে। এরকম বহুদিন করেছেন ‘প্রেম নেই’ উপন্যাস শেষ না করা পর্যন্ত। অথচ তিনি খুব বাস্তববাদী ছিলেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শিক।

হুমায়ূন আহমেদের অনেক খেয়ালিপনার ঘটনা এদেশের সবারই জানা। একটা ঘটনা শুধু বলি। তখনও তিনি খুব জনপ্রিয় নন। নন্দিত নরকে পাঠকসমাদৃত হয়েছে আর বিটিভিতে তার লেখা নাটক প্রচার শুরু হয়েছে মাত্র। একদিন তিনি বেইলি রোড দিয়ে বিকালে যাচ্ছিলেন। মহিলা সমিতি মঞ্চে তখন নিয়মিত নাটক হতো। তো এর সামনেই নাটকপাগল মানুষেরা ফুটপাতে বসে আড্ডা দিতেন। হুমায়ূন আহমেদ দেখলেন সেই বিকালে এক লোককে ঘিরে অনেক ভিড়। লোকটা মাউথ অর্গান বাজাচ্ছেন আর বিচিত্র কিছু ভঙ্গি করছেন। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখেন লোকটা অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। হুমায়ূন আহমেদ দাড়াতেই ফরীদি সব থামিয়ে এগিয়ে এলেন এবং বললেন, “আরে মিতা আপনি।” এরপর ফরীদি তাকে একটা দোকান থেকে হিয়ে কলম কিনে গিফট করলেন। তো সেদিনই রাতে হুমায়ুন ফরীদি আর সুর্বণা মুস্তফার বাসার সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে ফোন করলেন ফরীদিকে। ফরীদি ফোনকল রিসিভ করতেই লোকটা বললেন, “আমি আপনার জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসেছি। আজ রাতটা আপনার সাথে রাতের খাবার খেতে চাই।” তখন রাত সোয়া এগারোটা। ফরীদি নেমে এলেন। যে লোকটি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি হুমায়ূন আহমেদ।

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;