ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ১ ● জয়দেবপুরের গণ বিক্ষোভ
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ২ ● আশুগঞ্জের বিমান হামলা
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ৩ ● সিলেটের মাধবপুরের যুদ্ধ
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ৪ ● রণাঙ্গনের অনাকাঙ্ক্ষিত একটি দুর্ঘটনা
১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ১১ বেঙ্গল রাইজিং হওয়ার পর আমাদের কোম্পানিকে ১১ বেঙ্গলে বদলি করা হলো। এবং ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নতুন সৈনিকদেরও ট্রেনিং শেষে এতে বদলি করা হলো। ১১ বেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন (লে. কর্নেল) জেনারেল এ এস এম নাসিম সাহেব। উপ অধিানায়ক ছিলেন (মেজর) জেনারেল সাবেদ আলী ভুঁইয়া। সুবেদার মেজর ছিলেন করিম। আমাদের ব্যাটেলিয়ানকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য আদেশ করা হয়। তখন সমগ্র বাংলাদেশের সকল রেজিমেন্টকে এ আদেশ দেওয়া হয়। ইন্ডিয়ান আর্মি মিত্র বাহিনী হিসেবে আমাদের সাথে যোগ দেয়। ইন্ডিয়ান আর্মির ট্যাংক রেজিমেন্ট প্রথম সারির অগ্রাভিযান জারি করে। এবং আমাদের কোম্পানির সাথে ওদের একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ানও ছিল।
আমরা যখন আগাকুড়া, সড়াইল, টেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম তখন পাক সৈনিকের একটি গাড়ি সিলেট অভিমুখী যাচ্ছিল। আমরা গাড়িটি থামাবার জন্য গুলি করি। গাড়িটি থামার পর (কর্নেল) জেনারেল নাসিম সাহেব ৩/৪ জন সৈনিক নিয়ে গাড়িটিকে তল্লাশি করার জন্য সামনে অগ্রসর হন। তিনি যখন গাড়ির ভেতর ঢোকার জন্য দরজায় পা দিচ্ছিলেন ঠিক ঐ মুহূর্তে গাড়ির ভিতর থেকে পাক সেনারা গুলি চালায়। নাসিম সাহেবের পায়ে গুলি লাগে। সাথে আরো দুজন সৈনিক আহত হয়। সাথে সাথেই একটি হেলিকপ্টার এসে তাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যায়। আহত সৈনিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা তাঁর আহত হবার সংবাদে খুবই ব্যথিত হয়েছিলাম এবং তার অভাব অনুভব করতাম। তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত আমরা তার জন্য দোয়া করছিলাম।
নাসিম সাহেব চলে যাবার পর (মেজর) জেনারেল সাবেদ আলী ভুঁইয়া ১১ বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সম্ভবত (ক্যাপ্টেন) জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির সাহেব উপ অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধের দায়িত্বভার নেন। ঐ সময় ভারতীয় রেজিমেন্ট আমাদের অগ্রগামী দলে দায়িত্ব নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। আমাদেরকে পশ্চাতগামী দল হিসেবে রেখে দেয়। আমাদের সিভিলিয়ান ইন্টেলিজেন্সের লোক আমাদেরকে সংবাদ দিল, পাক আর্মি আশুগঞ্জ ছেড়ে ভৈরব শহরে অবস্থান নিয়েছে। এ সংবাদ শুনে আমরা আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। কিন্তু সংবাদটি ছিল ভুল। তখন সম্ভবত দুপুর গড়িয়ে গেছে। যখন ইন্ডিয়ান আর্মির প্রথম ট্যাংক ব্রিজের উত্তর পাশে ভৈরব নদীর কাছে পৌঁছায় তখনই নদীর অপর পাশ থেকে পাক বাহিনী একসাথে আর্টিলারি, আর আর ও ভারী মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। এমনভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে যে, সামনে ধুলা ছাড়া আর কিছু দেখতে পারছিলাম না। এমতাবস্থায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে ডিফেন্স নিই।
ইন্ডিয়ান আর্মিরা পাক সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সামনে কী হচ্ছে আমরা কিছুই জানতে পারি নাই। প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতে থাকে। রাতে আমাদের সামনে অগ্রসর হতে আদেশ করা হয়। ভোরের দিকে আমরা যখন আশুগঞ্জের কাছাকাছি পৌঁছালাম তখন দেখি বহু ভারতীয় সৈন্য এ যুদ্ধে নিহত ও আহত হয়ে এদিক-সেদিক পড়ে আছে। ভোর হতেই হেলিকপ্টারে করে আহত ও নিহতদের ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যারা জীবিত রয়েছে তাদের দিকে একটি হেলিকপ্টার থেকে নাস্তার প্যাকেট ফেলা হচ্ছে। এসব দেখে খুবই ব্যথিত হলাম। সামান্য একটা ভুল সংবাদকে বিশ্বাস করে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা ওদেরকে পেছনে রেখে খুবই সতর্কতার সাথে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। দেখলাম ৩/৪টি ভারতীয় ট্যাংক বিধ্বস্থ হয়ে পড়ে আছে। আমরা আশুগঞ্জে পৌঁছে নিজেদের পছন্দ মতো জায়গায় ডিফেন্স নিই। ওরা নদীর পশ্চিম পাড়ে বিল্ডিংয়ের ভেতর ডিফেন্স নিয়ে ছিল। উভয় পক্ষের মধ্যে ছোটখাটো গুলি বিনিময় হয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে যখন শুনতে পেলাম, পাক বাহিনী আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। আমার বুকে তখনও বাংলাদেশের পতাকা বাঁধা ছিল। সাথে সাথে তা খুলে এলএমজির ব্যারেলের আগায় বেঁধে আকাশের দিকে লক্ষ্য করে আনন্দে গুলি করতে লাগলাম। আমরা প্রত্যেকেই এ আনন্দে ফাঁকা গুলি করছিলাম। আমার মনে হয় না জীবনে আর কখনো এত আনন্দিত হয়েছি। ঐ দিনটি ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় খুশির দিন। কিন্তু মহা আনন্দ নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। যখন আমরা ফায়ার করছিলাম তখন পেছন থেকে আমাদের অফিসাররা ধমকের সুরে গুলি করা বন্ধ করতে বলল। ঠিক ঐ মুহূর্তে পাক আর্মিরা আমাদের লক্ষ্য করে ওদের মেশিনগানের ব্রাশফায়ার শুরু করল। তখন বুঝলাম ওরা আত্মসমর্পণ করেনি। ভৈরব নদীর পাড় ঘেঁষে ওরা প্রায় এক ব্রিগেড সৈন্য ডিফেন্স নিয়ে ছিল। চতুর্দিক থেকে আমরা ওদেরকে ঘিরে রেখেছিলাম। আমরা আশুগঞ্জ থেকে যখন সাদা পতাকা উত্তোলন করি ওরা তখন লাল পাতাকা উত্তোলন করে আমাদের দেখিয়ে দেয়। আশুগঞ্জ থেকে মাইক দিয়ে আমাদের লোক ওদেরকে আত্মসর্ম্পণ করার জন্য ঘোষণা দিতে লাগল। ওরা ওদের গান ফায়ার দিয়ে তার জবাব দেয়।
এহেন নাটকীয় পরিস্থিতিতে ওদের আত্মসমর্পণ করানোর জন্য হেলিকপ্টারের সাহায্যে আকাশ থেকে হ্যান্ডবিল ফেলা হলো। এদিকে আটকা পড়ার পর ওদের খাদ্য, রসদ ও গোলাবারুদ শেষ হবার পথে ছিল। সম্ভবত ১৭ ডিসেম্বর ওরা আত্মসমর্পণের স্বীকৃতি দেয়। পরে আমরা গাইড করে ওদেরকে নিয়ে যাই নরসিংদী কলেজে। সেখানে এক অনাড়ম্বর অভ্যর্থনার মাধ্যমে ওদেরকে আত্মসমর্পণ করানো হয়।
ঐদিনই আমরা ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ঢাকা সেনানিবাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীদের স্থান দেওয়া হয়। আমরা ভিকারুন্নেসা গার্লস স্কুলে অবস্থান নিই। সেখানে অস্ত্রাগারে আমাদের সবার যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা করি। দুদিন পর আমরা কয়েকজন সৈনিক আউটপাস নিয়ে ঢাকা শহরে বেড়াতে বের হই। পকেটে একটি পয়সাও ছিল না। রাস্তা ঘাটে কোনো যানবাহনও নেই। ঢাকায় ঐ সময় ঘুরে ঘুরে যা দেখলাম, জনমানবশূন্য এক ঢাকা শহর। মার্কেটগুলোতে কোনো জিনিসপত্র নেই। লোকের ভিড় নেই। যানবাহনের ভিড় নেই। সব দোকানপাট ভাঙাচোরা ও খালি পড়ে আছে। বিল্ডিং ও রাস্তাগুলো বোমার আঘাতে জায়গায় জায়গায় ক্ষত বিক্ষত।
ঢাকার এমন নীরব নিস্তব্ধ রূপ জীবনে কোনো দিন দেখিনি। শুধু ঢাকা বললে ভুল হবে। গোটা বাংলাদেশের চিত্রটাই এমন ছিল। সারা দেশের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। গ্রামে-গঞ্জে অধিকাংশ বাড়িঘর পাক হানাদার বাহিনীরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। তখন ভাবতাম এদেশটা কি আগের মতো সুন্দর দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে? লোকজন যখন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ফিরে আসতে শুরু করল, তখন দেখেছি চতুর্দিকে দুর্ভিক্ষ, হাহাকার। ক্ষুধার তাড়নায় ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আমাদের লঙ্গরখানার পেছনের ড্রেন থেকে ভাতের মাড় উঠিয়ে নিয়ে যেত। আমাদের এসএম সাহেব এ দৃশ্য দেখে বাবুর্চিদের বললেন, তোমরা ভাতের মাড় আর ড্রেনে ফেলবে না। একটি বড় সসপেনে ঢেলে রাখবে। দুপুরে ছেলেমেয়েরা আসলে ওদেরকে এ মাড় দিয়ে দেবে। আমাদের উদ্ধৃত খাবার যা থাকবে তা-ও ওদের দিয়ে দেবে। যেহেতু কাজটা ছিল আইন বহির্ভূত, আমাদের তা গোপনে করতে বললেন।
৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তাই বর্তমান প্রজন্ম বুঝতেই পারে না এ বাংলাদেশ অর্জনের পেছনে কত কষ্ট কত ত্যাগ আর কত শহীদের রক্ত দিতে হয়েছে। [সমাপ্ত]