ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ২
আশুগঞ্জের বিমান হামলা
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের স্মৃতি ১ ● জয়দেবপুরের গণ বিক্ষোভ
আশুগঞ্জে আমাদেরকে ভৈরব নদীর পাড় ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে ডিফেন্স নিতে বলা হয়। ব্রিজের পূর্ব পাড়ে একটি এইচএমজি বসানো হয়। আর আমাকে বলা হয় দক্ষিণ প্রান্তে নদীর পাড় ঘেঁষে এলএমজি নিয়ে অবস্থান করতে। যেন ঢাকা থেকে নদীপথে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আসলে তাদেরকে আটকে ধ্বংস করতে পারি। কিছু পাবলিক এসে আমার এলএমজির বাংকারকে খুব মজবুত করে সেল্টারসহ করে দিল। আশুগঞ্জে সম্ভবত আমরা ২/৩ দিন অবস্থান করি। তারপর একদিন ভোরে দেখি ৪টি জঙ্গি বিমান আমাদের ডিফেন্সের উপর চক্কর লাগিয়ে আমাদের বিভিন্ন বাংকারের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। একমাত্র আমার পজিশনটাই যুদ্ধবিমানগুলোর দৃষ্টির অগোচরে ছিল। তাই আমি শুরু থেকে ওদের আক্রমণের গতিধারা লক্ষ করে আসছি। ৪টি যুদ্ধবিমানের প্রবল আক্রমণের মুখে আমাদের ডিফেন্স টিকতে পারল না। সম্ভবত ২০/২৫ মিনিট বা আধাঘণ্টা যুদ্ধ বিমানের গোলাবর্ষণের পর আমাদের কোম্পানির সৈনিকগণ উইড্রল করতে শুরু করে। হঠাৎ একটি যুদ্ধবিমান আমার বাংকারকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুর করে। তখন আমি যুদ্ধবিমানের উদ্দেশ্যে গুলি করতে শুরু করি। আমি একসময় লক্ষ করি আমাদের সৈনিকদের গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানগুলোর গুলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। তখন আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে একা ফেলে রেখে বাকিরা সব চলে গেছে অথবা শহীদ হয়ে গেছে।
চিন্তিত হয়ে পড়ে আমি আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলাম। তখন বুঝতে পারলাম একমাত্র আল্লাহই আমার সাহয্যকারী। যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে আমার এলএমজির দিয়ে শর্ট ব্রাশফায়ার মারতে শুরু করলাম। আমি খুব হিসাব করে গুলি খরচ করে যাচ্ছিলাম। একসময় আমার বাংকারকে লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করার জন্য যেই ড্রাইভ করে ঐ মুহূর্তে আমি যুদ্ধমিবানকে লক্ষ্য করে লং ব্রাশফায়ার করি। ঐ সময় আল্লাহর অসীম মেহেরবানীতে গোলাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আমার সামনে অদূরে নদীর মধ্যে পড়ে যায়। আমি শুধু একাই যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি। আর প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতিক্ষায় আল্লাহকে ডাকছি। প্রায় একঘণ্টা পর দুটি ফাইটার চলে গেল এবং দুটি যুদ্ধবিমানই আমার ডিফেন্স লক্ষ্য করে গুলি নিক্ষেপ করতে থাকল। আমিও ক্ষণে ক্ষণে যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্য করে বৃথা গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্য করে আমার গুলি ছোঁড়ার কারণে যুদ্ধবিমানটি আমার বাংকারের ওপর সঠিকভাবে গুলি নিক্ষেপ করতে পারছিল না। কেননা, আমার চেয়ে ওর মৃত্যুর ভয়টাই ছিল বেশি। আমি একাই গুলি করছি।
আমার একার গুলি করার শব্দ শোনতে পেরে নাসিম সাহেব আমাদের ব্যাটালিয়নের বি কিউএম এইচ ফরাজ আমদে সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে আমার থেকে ৪/৫শ গজ পেছনে গ্রামের ভিতরের একটি গাছ তলায় এসে আমাকে ডাকলেন। আমি নাসিম সাহেবকে ডাকতে দেখে উপরের দিকে ইশারা করে বুঝালাম, আমি বাংকার থেকে উঠতে পারছি না। অগত্যা ব্যর্থ হয়ে তিনি ফিরে গেলেন। তখন আমার মন আরো দুর্বল হয়ে পড়ল। বুঝলাম, হয়তো আমার এখানেই মৃত্যু হবে নতুবা বেঁচে থাকলেও আমি আমার কোম্পানি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। ভাবছি অনেক কিছু। আমাদের দেশের টাকা দিয়ে যে যুদ্ধ বিমান ও গোলা বারুদ কেনা হয়েছিল সেগুলো দিয়েই আজ তারা আমাদের হত্যা করে যাচ্ছে। যে যুদ্ধবিমানগুলো আমাদের রক্ষার জন্য বিদেশ থেকে কেনা হয়েছিল সেগুলো সেগুলা দিয়েই আমাদেরকে ও দেশের সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে। যুদ্ধ বিমানের বিরুদ্ধে গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে বাঁচানোর জন্য এবং একটি যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করার আশায়। এভাবে সম্ভবত আরও ঘণ্টাখানিক চলল।
কিছুক্ষণ পর পালাক্রমে দুটি যুদ্ধবিমান ঢাকায় চলে যায় এবং ঢাকা থেকে দুটি যুদ্ধ বিমান এসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমি হিসাব করে গুলি খরচ করছি। এভাবে প্রায় ৮ বাক্স গুলি শেষ হয়ে যায়। এমন সময় দেখি, যুদ্ধ বিমানের সাথে দুটি হেলিকপ্টার আসে। যেখানে আমাদের কোম্পানি হেডকোয়ার্টার ছিল সেখানে আমাদের ডিফেন্সের পেছনে ঐ হেলিকপ্টার থেকে রশি বেয়ে পাকিস্তানের কমান্ডো সৈনিকরা নামছে। এবং যে রাস্তাটি সম্ভবত সার কারখানার দিকে গিয়েছে ঐ রাস্তার ওপর কমান্ডোরা এসে অবস্থান নিচ্ছে। এ দেখে আমি বাঁচার আশা একেবারে ছেড়ে দিলাম। রীতিমতো কালেমা পড়া শুরু করলাম। এবং যুদ্ধ বিমানকে লক্ষ্য করে এলএমজির শর্ট ব্রাশফায়ার দিয়ে যাচ্ছিলাম। আল্লাহর অসীম মেহেরবানিতে একটু পরেই দেখি একটি যুদ্ধবিমান চলে গেল। অপর যুদ্ধবিমানটা বারবার চক্কর দিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকল। আমি অসহায়ের মতো নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম, আরো দুটি হেলিকপ্টার আরো কিছু কমান্ডো আগের জায়গায় নামিয়ে দিল। তখন আমার বুঝতে বাকি রইল না, নিশ্চিত আমি মারা যাব নতুবা কমান্ডোদের হাতে ধরা পড়ব। এদিকে যুদ্ধবিমানকে গুলি করতে করতে করতে আমার এলএমজির গুলি শেষ হবার পথে। শেষ ম্যাগজিনের চেইনটা এলএমজির সাথে লাগালাম। যুদ্ধবিমানকে লক্ষ্য করে আরো দু/তিনবার শর্ট ব্রাশফায়ার করে চলে যাবার প্রস্তুতি নিলাম।
এলএমজি ও খালি ম্যাগজিনের বাক্সগুলো ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে কাঁধে ঝোলালাম। আল্লাহর নাম নিয়ে কালেমা পড়তে পড়তে বাংকার থেকে বের হলাম। (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেবকে যে পথ দিয়ে যেতে দেখেছি সে পথ ধরে দৌড়াতে শুরু করলাম। তখনও যুদ্ধবিমান আকাশে চক্কর দিচ্ছিল। আমি দৌড়ে একটি গ্রামের ভিতর প্রবেশ করি। সর্বদাই গাছপালার আড় রেখে অগ্রসর হতে থাকি। লোকদের জিজ্ঞাসা করি আমাদের সৈনিকেরা কোথায় গিয়েছে। তারা আমাকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে একটি প্রাইমারি স্কুল দেখিয়ে দেয়। আমি তখন সেই স্কুলের দিকে যাই। সেখানে যাবার পর (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেবকে দেখতে পাই। তাকে দেখতে পেয়ে আমি অনেকটাই স্বস্তি ফিরে পেলাম। সেখানে ২০/২৫ জন সৈনিক ভাইদেরকে দেখতে পেলাম। বাকি সৈনিকরা কে কোথায় রয়েছে বা কে কে শহিদ হয়েছে এরা কেউ বলতে পারে না। যা হোক দুপুরে ওখানে খাওয়া-দাওয়ার পর (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেব আমাদের স্কুল ঘরে বসিয়ে একটি ছোট দরবার নিলেন।
তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা খাঁটি মনে বলো, আমার সাথে কে কে থাকতে চাও? আর কে কে চলে যেতে চাও? যারা চলে যেতে চাও তারা আমার কাছে তোমাদের অস্ত্র গোলা জমা দিয়ে চলে যেতে পার। যারা আমার সাথে থাকতে চাও তারা হাত তোলো।” তখন আমরা যে কয়জন সেখানে ছিলাম প্রত্যেকে হাত তুলে স্বীকারোক্তি দিয়ে ওয়াদা করলাম, “আমরা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অথবা দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আপনার সাথেই থাকব।” আমাদের কথা শুনে (ক্যাপ্টেন) জেনারেল নাসিম সাহেব বেশ সন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন, “আমরা দেশ ও দেশের মানুষের জন্য সেনা বিদ্রোহ করেছি। আমাদের ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। গোটা দেশ এবং দেশের জনগণও যদি পাকিস্তানের পক্ষে হয়ে যায় তবুও আমাদেরকে যুদ্ধ চালিয়েই যেতে হবে। ভিয়েতনামের মতো আমাদের এ যুদ্ধ আজীবনের যুদ্ধ। তবে একটা কথা মনে রেখো, যদি কোনো দিন আমরা দেশ স্বাধীন করতে পারি, তবে সেদিন, তোমাদের একটা বিরাট মর্যাদা হবে। যা তোমরা এখন কল্পনাও করতে পারবে না। আর তোমরাই হবে এ দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক।”
সেদিন এ কথাটা আমার নিকট উপহাসমূলক মনে হয়েছিল। আজও তেমনি মনে হয়। বাস্তবতা বড় কঠিন। তখন আমাদের একটাই স্বপ্ন ছিল, দেশ ও জাতিকে স্বাধীন করা। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সিলেটের তেলিয়াপারা গার্ডেনে নিয়ে যান।
তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধ
ক্যাপ্টেন সেলিম সাহেব এবং ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব আমাদেরকে তেলিয়াপাড়া টি গার্ডেনে যে জায়গায় নিয়ে যান সেটা ছিল পাক আর্মির সাজানো ফাঁদ। তা নাসিম সাহেব জানতেন না। আমরা যখন ওদের এ্যাম্বুসের ঘেরাওয়ের ভিতর প্রবেশ করি তখন ছিল গভীর রাত। হঠাৎ ৩ দিক থেকে গুলি শুরু হলো। আমরা উপায় না দেখে পাল্টা গুলি করতে করতে পেছন দিক থেকে বের হয়ে আসি। সারা রাত পাক বাহিনীর সাথে গুলাগুলি চলতে থাকে। নাসিম সাহেব আমাদেরকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসেন। সেলিম সাহেবের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই। পরে মাধবপুরে তাকে দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে সেলিম সাহেব ছিলেন পকিস্তানের গুপ্তচর। সেলিম সাহেব আমাদেরকে যতগুলো অপারেশনে নিয়ে গিয়েছিল সবকটি অপারেশনই ছিল আমাদের ধরা পরার মতো। কিন্তু মহান আল্লাহর একান্ত ইচ্ছা আমাদেরকে রক্ষা করেছে। আল্লাহ প্রদত্ত নাসিম সাহেবের উপস্থিত বুদ্ধি আর আমাদের অসীম সাহসিকতা প্রতিবারই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে তাদের ষড়যন্ত্র তছনছ করে দিয়েছে। মাধবপুরের যুদ্ধটাও ছিল ক্যাপ্টেন সেলিম সহেবের চক্রান্ত। সে পাকিস্তানি বাহিনীকে আমাদের ডিফেন্সের পিছন দিক থেকে সরাসরি আক্রমণের রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিল। এসব কারণে পরে তাকে বন্দী করে হত্যা করা হয়। [চলবে]