১৫ বছর বয়েসী এক শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। শিশুটি কাজ করত ঢাকায়, বাড়ি মৌলভীবাজার। প্রীতি উরাং নামের চা-শ্রমিক সন্তান গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায়। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোড একটি বহুতল ভবন থেকে নিচে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় শিশুটির। এ ঘটনায় পুলিশ সাংবাদিক আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারের আগে গৃহকর্তার দাবি ছিল, তারা ঘুমে ছিলেন, ওই সময় মেয়েটি পড়ে যায়।
ঘটনা এখানেই শেষ না। এরআগে গত বছরও ওই সাংবাদিকের বাসা থেকে পড়ে গিয়ে অপর এক শিশু গুরুতর আহত হয়। ওই সময় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। মামলার পর বাদী-বিবাদীর আপসের ভিত্তিতে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। দায়মুক্ত হয়ে যান ওই সাংবাদিক। একই বাসা থেকে একাধিকবার শিশু গৃহকর্মীদের এমন নির্মম পরিণতি ভাবনার বিষয়। আগেরবার ছয় বছর বয়েসী শিশুটি প্রাণে বেঁচে গেলেও এবার পনেরো বছরের শিশুটি প্রাণে বাঁচতে পারেনি। এরইমধ্যে আটক দম্পতিকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, ঘটনার পুনরাবৃত্তির কারণ জানতে চেয়েছে, কেন হাত বেঁধে বাসায় রাখা হয়, অবহেলা এবং নির্যাতনজনিত মৃত্যু কিনা সেটাও বের করার চেষ্টা করছে পুলিশ।
বিষয়টি তদন্তাধীন। পুলিশি তদন্তে শেষে প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই। দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ও তার পরিবার যদি এই শিশু-মৃত্যুতে দায়ী থাকে তার বিচার আমরা দাবি করি। এখানে আগেভাগে কাউকে দোষী কিংবা নির্দোষ আখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে প্রশ্নের জায়গা একটাই—একই বাসায় কেন বারবার একই ঘটনা? এর দায় এড়ানোর সুযোগ কি সত্যি আছে তাদের?
পুলিশসহ বিভিন্ন মাধ্যম বলছে যে জানালা দিয়ে প্রীতি উরাং নামের মেয়েটি নিচে পড়ে যায় সেই জানালার কোন গ্রিল ছিল না। আটতলার বাসার জানালা এভাবে অরক্ষিত থাকে দিনের পর দিন; তার ওপর মাস ছয়েক আগে একই জায়গা দিয়ে আরেকটি শিশু নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হওয়ার পরেও কেন এনিয়ে কোন ব্যবস্থা নেননি গৃহকর্তা? মামলায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ যুক্ত হয়েছে। নিহত শিশুর বাবা লোকেশ উরাং বলছেন, দুই বছর আগে মেয়েকে কাজে দিলেও মেয়ের সঙ্গে তাদেরকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। মাসে এক-দুইবার মোবাইলে কথা বলতে দেওয়া হতো।
ঘটনার অব্যবহিত পর সৈয়দ আশফাকুল হকের প্রতিষ্ঠান দ্য ডেইলি স্টার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী ও নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় এক কিশোরী গৃহ সহায়কের মর্মান্তিক মৃত্যুও ঘটনায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। দুর্ভাগ্যজনক এ ঘটনার জন্য আমরা গভীর দুঃখ প্রকাশ করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। তদন্তে কী পাওয়া গেল, তা জানার অপেক্ষায় আছি আমরা।’ পত্রিকাটি অপেক্ষায় থাকার কথা জানাচ্ছে। তদন্তে যদি তাদের নির্বাহী সম্পাদক অভিযুক্ত হন তবে ধারণা করা যায়, তারা ব্যক্তির অপরাধের দায় নেবে না। নাকি বিচার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? একই ব্যক্তির বাসা থেকে একই ধরনের ঘটনার পরেও কি সত্যি এখানে অপেক্ষার বাকি থাকে কিছু!
সৈয়দ আশফাকুল হক কিংবা তার স্ত্রী-সন্তানরা যদি এই শিশু-হত্যায় জড়িত না-ও থাকেন তবে তারা কি দায় এড়াতে পারেন? বিশেষত বছর-পনেরোর কিশোরী আইনত শিশুটিকে তারা তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। এই বয়েসী একটি মেয়েকে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার পাশাপাশি হাত বেঁধে রাখতেন বলে অভিযোগ। প্রীতি উরাং নামের মেয়েটিকে যদি ওপর থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনা নাও ঘটে থাকে, তবু এখানে কি শারীরিক, মানসিক নির্যাতন ঘটেনি। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার ঘটনা কি এখানে নির্যাতনের অংশ হয় না?
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা ‘ছাড়পত্র’। কবিতাটি না জানা লোকের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই হাতেগোনা। এটা কেবল কবিতাই নয়, মানুষের আকাঙ্ক্ষাবিশেষ। সুকান্ত কবিতার একটা অংশে লিখেছেন—‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।’ প্রীতি উরাং নামের শিশুটির মৃত্যুতে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত আসামি আশফাকুল হক সাংবাদিক হিসেবে বিবিধ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নৈতিকতার চর্চা করতেন বলে বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু মেয়েটির মৃত্যুর পর প্রশ্ন জাগছে, শিশুর বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ার একক হিসেবে না হোক অন্তত একটা শিশুর বেঁচে থাকার ন্যূনতম দায়িত্ব কি পালন করেছেন তিনি? নৈতিকতা কোথায় ছিল তার সেখানে মাসের পর মাস তিনি এই বয়সের একটা শিশুকে তার পরিবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রেখেছেন!
প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুতে সাংবাদিক আশফাকুল হক জড়িত কিনা সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তবে এখন পর্যন্ত পরিস্কার মেয়েটি ওখানে ভালো ছিল না। পরিবার-বিচ্ছিন্ন কারো ভালো থাকার সম্ভাবনা কম। এখানে মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি তাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
নির্যাতনে শিশু-মৃত্যু অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা দেশে নতুন নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী কেবল জানুয়ারি মাসেই দেশে শিশু-মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। এরমধ্যে মামলা হয়েছে ১২টির। আক্রান্তদের ১৩ জনের বয়স ৬ বছরের নিচে, ১২ জনের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর এই এক বছরে সারাদেশে শিশু-মৃত্যুর সংখ্যা ৪৮৫, এরমধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ১৭৫টি। আক্রান্তদের ১১৬ জনের বয়স ৬ বছরের নিচে, ২০৬ জনের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর। ওই বছর শিশু-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১ হাজার ১৩টি, যার মধ্যে মামলা হয় ৪২৩টি। প্রতিষ্ঠানটি তথ্যগুলো নিয়েছে কেবল প্রথম আলো, ইত্তেফাক, সমকাল, সংবাদ, জনকণ্ঠ, যুগান্তর, নয়াদিগন্ত, দ্য ডেইলি স্টার, নিউ এইজ, ঢাকা ট্রিবিউন এবং কয়েকটি অনলাইন গণমাধ্যম থেকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই তথ্য আদতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য নয়, কারণ তারা সীমিত সংখ্যক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তথ্য প্রকাশ করেছে। তাদের হিসাবের বাইরে আরও অনেক ঘটনা আছে নিশ্চিতভাবেই। এখানে একদিকে তথ্য সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা, অন্যদিকে রয়েছে শিশু-নির্যাতনের ঘটনার সবটা গণমাধ্যমে আসে না।
প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করা। এটা হত্যা নাকি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু তা তদন্তে বেরিয়ে আসুক। অসাবধানতায় এ মৃত্যু যদি উল্লেখও হয়, তবুও এটাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না, কারণ এখানে আছে অবহেলা, আছে জীবনকে মৃত্যু পর্যন্ত ঠেলে দেওয়া পথ! আশফাকুল হকের তাই দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ সামান্যই।