ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়াকে যখন মসজিদ ঘোষণা করা হয় সে সময়, গ্লি নামের একটি বিড়াল রাতারাতি ইন্টারনেট সেলিব্রিটি হয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। তুর্কি প্রশাসনও বিড়ালটিকে মসজিদ থেকে না তাড়িয়ে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে। প্রাণীদের প্রতি তুর্কিদের এমনই মমতা। এমন প্রাণী আর পাখি তুর্কি ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। পাখি নিয়ে তুরস্কের একটি ঐতিহ্য সারা বিশ্বে বিশেষভাবে প্রশংসা অর্জন করেছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে শীতের মৌসুমে তুরস্কের পাহাড়ের চূড়াগুলো তুষারে ঢেকে যাওয়ায় পাখিদের খাদ্যের অভাব দেখা দিত। তখন খাবারের অভাবে হাজার হাজার পাখি মারা যেত। এখন অবশ্য সেই অবস্থা নেই। শুভ্র তুষারের চাদর যখন সবকিছুকে ঢেকে ফেলে, তখন তুরস্কবাসী পাহাড়ে গিয়ে পাখিদের জন্য শস্যদানা ছিটিয়ে দেয়। এটি একটি অতিপ্রাচীন ইসলামি ঐতিহ্য, যা এখনও তুরস্কে প্রচলিত।
এই অসাধারণ প্রথাটি সবার প্রথম চালু করেছিলেন উমাইয়া বংশীয় মুসলিম খলিফা উমার ইবনে আবদুল আজিজ রহ.। অনেক ঐতিহাসিক বইয়ে বর্ণিত আছে, খলিফা উমার ইবনে আবদুল আজিজ বলেছিলেন, ‘পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পাখিদের জন্য খাদ্য ছিটিয়ে দাও। মুসলিম শাসনের অধীনে একটি পাখিও যেন না খেয়ে মারা না যায়।’
আল্লাহতায়ালার অপরূপ সৃষ্টিকৌশলের এক মহা নিদর্শন অনিন্দ্যসুন্দর ও পরম আকর্ষণীয় পক্ষীকুল। আকাশে ডানা মেলে পাখিরা উড়ে বেড়ায় এবং নিজস্ব ভাষা ও পদ্ধতিতে সৃষ্টিকর্তার গুণগান করে।
পক্ষীকুল মানবজাতির উপকারী, পরিবেশবান্ধব এবং পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক। পাখিরা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা করে।
মানবজাতির ন্যায় পশু-পাখিও খাদ্য-পানীয়সহ আল্লাহর অন্যান্য নিয়ামতের অংশীদার। কোরআনে কারিমে তাদের প্রাপ্য অংশ প্রদানের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বিছানা বানিয়েছেন এবং তাতে তোমাদের জন্য চলার পথ করে দিয়েছেন। আর আসমান থেকে তিনি পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দিয়ে আমি বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। তোমরা নিজেরা খাও এবং তোমাদের গবাদিপশু চরাও। অবশ্যই এতে বিবেকবান লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ –সূরা ত্বোয়াহা: ৫২-৫৩
এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি উটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যা অনাহারে পেট ও পিঠ একত্র হয়ে গিয়েছিল। তা দেখে নবী করিম (সা.) বললেন, তোমরা এ সব বোবা পশুদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। এদেরকে দানাপানি দিয়ে সুস্থ সবল রাখ ও সুস্থ সবল পশুর পিঠে চড় এবং খাওয়ার সময়ও সুস্থ সবল প্রাণীর গোশত খাও।’ -সুনানে আবু দাউদ: ২৫৩৯
পশু-পাখি আল্লাহর নির্দেশে মানবজাতির বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করার পাশাপাশি জীবন পর্যন্ত দিয়ে থাকে। কিন্তু মানবজাতি বিভিন্ন সময়ে তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। তাদের প্রজনন, লালন-পালন, পরিবহণ, মালামাল বহন, ক্রয়-বিক্রয়, জবাই ও জবাইয়ের পরবর্তী পর্যায়েও তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করে থাকে।
ইসলামি শরিয়ত মানবজাতিকে পশু-পাখির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর তাদের থেকে উপকার গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছে।
তুর্কিরা বিষয়টি মন থেকে ধারণ করে শীতকালে পাখিদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে। কিন্তু কষ্টের সঙ্গে বলতে হয়। আমাদের শীতকালে আশ্রয় নেওয়া অতিথি পাখিদের নির্বিচারে শিকারের উৎসব চলে। অথচ তারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে আমাদের জলাশয়গুলো আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক।
পাখপাখালিকে অহেতুক হত্যা কিংবা শিকার করা ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায় এবং প্রচলিত আইনেও দণ্ডনীয় অপরাধ। পাখপাখালির জীবন রক্ষা করে পাখিদের লালন-পালন প্রশংসনীয় ও পুণ্যের কাজ। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য হাঁস-মুরগি, কবুতরের গোশত ও ডিম উপাদেয় খাদ্য হিসেবে প্রচুর উপকার সাধন করে। তাই পাখিদের বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া এবং তাদের প্রতি উত্তম আচরণ ও সদয় ব্যবহার করা ধর্মীয় অনুশাসনে অপরিহার্য; প্রয়োজনে তাদের ভোগ করা যাবে, যেভাবে ইসলামের দিকনির্দেশনা রয়েছে।
সকল প্রকার সৃষ্টিসহ পাখিদের প্রতি ভালোবাসা, সদয় ব্যবহার ও দয়া প্রদর্শন করা ইসলামের বিধান। যারা অবুঝ-অবলা পাখিদের প্রতি দয়া করবে না, আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন না।
আমাদের দেশে আগত অতিথি পাখিদের প্রতি অবিবেচক ও অশোভন আচরণ করলে এবং শিকার বা বধ করলে এর জন্য পরকালে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। পাখিদের প্রতি সদয় হয়ে তাদের ফরিয়াদ থেকে বাঁচার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় অতিথি পাখিদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদানসহ আল্লাহর সব সৃষ্টির প্রতি সদয় ব্যবহার এবং দয়া প্রদর্শন করা মুসলমানদের ইমানি দায়িত্ব ও অবশ্যকর্তব্য।