-কায়সার, সত্যি কোনো সমস্যা হবে না তো?
ইত্তেফাকের দিলু ভাই (দিলু খন্দকার) দুঃশ্চিন্তার স্বরেই প্রশ্নটা করলেন।
মিউনিখে জার্মানি ও কোস্টারিকার উদ্বোধনী ম্যাচের পর আমাদের পরিকল্পনা আর্জেন্টিনা-আইভরি কোস্টের ম্যাচ কাভার করা। সেটা আবার জার্মানির একেবারে অন্যপ্রান্তে। ম্যাপ দেখে মনে হলো- মিউনিখ যদি রংপুর হয় তবে হামবুর্গ কক্সবাজার! মিউনিখ এ মাথায়, হামবুর্গ ও’মাথায়। দ্রুতগতির ট্রেনেই যেতে লাগে ছয় ঘণ্টার বেশি।
বিশ্বকাপের শহরে সবে আমরা হাঁটাহাটি শুরু করেছি। যেদিকেই তাকাই সবকিছুর সঙ্গে প্রথমবারের মতো পরিচয় হচ্ছে। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে আয়োজক জার্মানি দারুণ একটা ব্যবস্থা রেখেছিল সাংবাদিকদের জন্য। বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা সব সাংবাদিকদের জন্য ট্রেন ও বাসে ফ্রি চলাচল। কোনো টিকেট লাগবে না। গলায় ঝুলানো অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডে একটা সাদা হলোগ্রাম লাগানো আছে। বাসে উঠার সময় সেটা ড্রাইভারকে দেখালেই হলো। ট্রেনেও তাই। অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড গলায় থাকলেই পুরো জার্মানি জুড়ে সব ধরনের ট্রেনে বিনামূল্যে ভ্রমণ। হ্যাঁ, যখন ইচ্ছে যতবার। যেখানে খুশি ততবার। একেবারে ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী সেবা!
মিউনিখে প্রথম ম্যাচ শেষে রাতের ট্রেনে হামবুর্গ যাব। পরদিন রাতে হামবুর্গে আর্জেন্টিনা ও আইভরি কোস্টের ম্যাচ। আর্জেন্টিনা ম্যাচ মানেই তো অন্য আনন্দ! আমাদের চারজনের ট্রেনের টিকিট রিজার্ভ করা। রাতের ট্রেনে যাব, সিট না পেলে ঘুমাব কিভাবে? এই চিন্তায় অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখিয়ে আগের দিনই স্টেশনে গিয়ে চারটা সিট রিজার্ভ করি আমরা চারজন।
চারজন মানে রানা হাসান, মুজিবুর রহমান, নাসিমুল হাসান দোদুল ও আমার। সেই বিশ্বকাপে আমাদের টিম লিডার দিলু খন্দকার উদ্বোধনী ম্যাচের আগেই মিউনিখে এসে পৌঁছান ঠিকই। কিন্তু তার আসার দিনক্ষণ আমাদের জানা না থাকায় ট্রেনে তার জন্য সিট রিজার্ভ করা হয়নি। তাই একটু টেনশনে ভুগছেন। সিট মিলবে তো? শেষ চেষ্টা হিসেবে মিউনিখের প্রধান রেলস্টেশনে ছুটলাম আমরা। কাউন্টারের মেয়েটি কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে দুপাশে মাথা নাড়ল।
-সরি ম্যান, নো চান্স। হামবুর্গের রাতের ট্রেনের টিকিট রিজার্ভের সময় আগেই শেষ।
-কিন্তু আমাদের যে যেতেই হবে এই ট্রেনে। পরদিনের ম্যাচটা কাভার করতে হলে আমাদের এই ট্রেনটা ধরতেই হবে। চারটা সিট আমাদের রিজার্ভ আছে। আরেকটা হলেই চলবে। একজনকে ফেলে কিভাবে যাব! প্লিজ, কোনো উপায়?
আমাদের নাছোড়বান্দা টাইপ আচরণ দেখে ডয়েস বানের (জার্মানির ট্রেন) কাউন্টারের মেয়েটি একটা বুদ্ধি দিলো।
-সিট না পেলে দাঁড়িয়ে যাবে। বেশি কষ্ট হলে মেঝেতে শুয়ে পড়বে!
-তাই নাকি? আমাদের টিকিট যে প্রথম শ্রেণীর। ওখানে সিট না পেলে কি মেঝেতে শোয়া যাবে? বুঝতেই পারছো সারারাত ট্রেনে কাটাতে হবে। অন্তত ঘণ্টা কয়েক তো ঘুমাতে হবে। দাঁড়িয়ে থেকে তো আর ঘুমানো যায় না!
মেয়েটি হাসি নিয়েই আমাদের টেনশন আরেকটু বাড়িয়ে দিলো- ‘একটু আগেভাগে স্টেশনে এসো নইলে ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা দখল হয়ে যাবে!’
মিউনিখে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ফাঁকে দিলু ভাইকে হামবুর্গ ট্রেনের ইতিবৃত্ত জানালাম। দিলু ভাই, রাতের খাওয়া একটু আগেভাগে খেয়ে স্টেশনে দৌড়াতে হবে।
দিলু ভাইয়ের সেই চিন্তা- আমার তো সিট রিজার্ভ করা নাই।
-আরে দুর, ও নিয়ে টেনশন নিয়েন না। আমার সিট তো রিজার্ভ আছে। আপনি ওটাতে বসবেন। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, ভাই।
জার্মানি-কোস্টারিকা ম্যাচ শেষে আমরা হোটেলে ফিরে পাচঁ দিনের বিল মেটালাম। আমি আর দোদুল এক রুমে। পাচঁ দিনের ভাড়া বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৩ হাজার টাকা! রাতে আমাদের মোনাকো হোটেলের পেছনেই মুন্সীগঞ্জের মনিরের মোগলাই হোটেলে ডিনার শেষ করে দৌড়ালাম আমরা রেল স্টেশনে। শুরুর পাঁচ দিনে মিউনিখ শহর বেশ চেনাজানা হয়ে গেছে। বিদায় নেওয়ার সময়ে ব্যাগে জোর করে বাডউইজারের বিয়ারের বোতল রেখে মনির চোখ টিপলেন- বস্ রাতে তো পানি খাইতে হইবো। ওটা খাইয়েন।
পাচঁজনের এই দলে মনির ঠিকই চিনেছিলেন কার কি পছন্দ!
রাতে মিউনিখ রেল স্টেশনে প্রচুর ভিড়। চারধারে লোকে ভরা। স্টেশনের ইলেক্ট্রনিকস বোর্ডে হামবুর্গের ট্রেনের ঠিকানা খুঁজে আমরা পঞ্চপাণ্ডব প্লাটফর্মে দাঁড়ালাম। ঘড়ির কাঁটা ধরে ট্রেন এসে থামল। হৈহৈ করে সবাই উঠলাম। শুরু হলো লাগেজ রাখার জায়গা দখলের। সিট না পেয়ে অনেকে মেঝেতে বসে পড়েছে। কুছ পরোয়া নেই ভঙ্গিতে মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে কয়েকজন বান্ধবীর গলা জড়িয়ে ঘুমিয়েও পড়ল!
এবং আশঙ্কাই সত্যি, দিলু ভাই সিট পেলেন না! আমরা তাকে সিট ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ভীষণ ভদ্রলোক দিলু ভাই বসবেনই না। ভাবলাম এখন না, একটু পরে জোর খাটাব।
আর্জেন্টিনার ম্যাচ পরের রাতে। নিশ্চয়ই এই ট্রেনে ম্যারাডোনার দেশের সাংবাদিকদের পাব। ঠিকই পেয়ে গেলাম। আমার পাশের সিটেই বসে একের পর এক সিগারেট পোড়াচ্ছিলেন অ্যারিয়েল স্কের। বুয়েন্স আয়ার্সের ক্লারিন এক্স নামের একটি পত্রিকায় রিপোর্টিং করেন। পার্ট টাইমে কলেজে পড়ান।
-তোমার মূল পেশা কোনটি? প্রশ্নটা শুনে চাপ দাড়িতে হাত বুলিয়ে হাসলেন অ্যারিয়েল।
-এই বিশ্বকাপ পর্যন্ত তো রিপোর্টিংই মূল কাজ। এখানে কলেজ কোথায় পাব, ভাই ?
বাংলাদেশ থেকে আমরা একদল সাংবাদিক বিশ্বকাপে এসেছি জেনে আরো অনেকের মতো অ্যারিয়েলও অবাক!
-তোমরা তো বিশ্বকাপে খেলছ না। তারপরও এত আগ্রহ!
৩৭ দিনের বিশ্বকাপের শেষ দিন পর্যন্ত আরো অনেককে আমাদের এই প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল। ম্যারাডোনা সম্পর্কে অ্যারিয়েল এত বেশি জানে যে ট্রেনের প্রথম ঘণ্টা কিভাবে যে কেটে গেল টেরই পেলাম না।
হঠাৎ সামনের বগিতে গান-বাজনার আওয়াজ শুনে কৌতূহল চাপল। শব্দ শুনেই বোঝা যাচ্ছে পার্টি শুরুর কিক-অফের বাঁশি ওটা!
-দিলু ভাই, আমি ওখানে যাই, আপনি এই সিটে না বসলে এটা দখল হয়ে যাবে। দিলু ভাই এবার না করার কোনো উপায় পেলেন না।
ল্যাপটপের ব্যাগ কাঁধের পেছনে নিয়ে পাশের বগিতে এলাম। ওরে বাবা! এখানে যে জমজমাট পার্টি। জার্মানির সমর্থকরা উদ্বোধনী ম্যাচে কোস্টারিকার জালে ৪-২ গোলের আনন্দে নেচে কুদে একাকার। প্রচণ্ড শব্দে গান বাজছে। সবার হাতে বিয়ারের বোতল। ঠোঁটে সিগারেট। গানের তালে তালে শরীর ঝাঁকিয়ে উদ্দাম নাচ। টেবিল চাপড়ে তাতে তাল মেলাচ্ছে একদল। সবার জন্য উন্মুক্ত এই পার্টিতে যোগদানের আমন্ত্রণ মিলল। প্রতিযোগিতা চলছিল দাঁতের ফাঁকে চেপে বিয়ারের বোতলের ঢাকনা খোলার। চ্যালেঞ্জটায় জেতায় চারপাশ থেকে হৈহৈ। পিঠ চাপড়ানি পেলাম। সেই সঙ্গে বোতলটাও! মিউনিখের বাভারিয়ান বিয়ার এখানে খুব জনপ্রিয়। একটু কড়া। কিন্তু স্বাদের। আর দাম? পানির বোতলের চেয়ে বিয়ার খানিকটা সস্তা!
তখনো বুঝতে পারিনি পার্টির যে সবে শুরু! আরো দু’বগি পার হতেই পাশ থেকে শুনতে পেলাম- ‘ওলে, ওলে, ভিভা মেক্সিকো।’ গলায় থাকা অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখেই বুঝতে পারছি সবাই এই বিশ্বকাপের আনন্দযাত্রী।
চেনাজানা নেই কিন্তু হাই ফ্রেন্ড বলে গলা জড়িয়ে ধরল মোটা সোটা দশাসই শরীরের এক লোক। মেক্সিকান ভাষায় হড়বড় করে একগাদা কি যেন বলল। ‘ইংলিশ প্লিজ’- বলতেই বিশাল বপুধারী লুইস আদেলফো স্যানতিজো আরেক দফা শরীর কাঁপিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। দ্রুতগতির ট্রেন তার হাসিতে আরো বেশি দুলতে শুরু করল। ক্রেট থেকে বিয়ারের কাঁচের বোতল বাড়িয়ে দিলো।
-আমার কাছে ওপেনার নেই।
বোতলটা দুই দাঁতের ফাঁকে চেপে হেঁচকা টানে খুলে ফেলল গুয়েতেমালা ল্যাটিচুইড টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান লুইস। গলায় বিয়ার ঢালছে আর থেমে থেমে সববেত সঙ্গীত চলছে -‘ওলে, ওলে। ভিভা মেক্সিকো।’ ট্রেনের মেঝেতে বসা আশপাশের সবাই হাততালি দিয়ে তাল দিচ্ছে। টেবিল না পেয়ে পিঠের ব্যাগটাকে ঢোল বানিয়ে পেটাচ্ছে। ঐটুকু জায়গার মধ্যেও একজন ফুটবল নিয়ে পায়ে পায়ে কারিকুরি শুরু করে দিলো! হাঁটুতে, কাঁধে, হেডে বা ভুঁড়ি দিয়ে বলের ভারসাম্য ঠিক রাখছে, নিচে পড়তেই দিচ্ছে না!
ফুটবলের আনন্দ যে কতভাবে নেওয়া যায়- সেদিনের ট্রেনের এই বিশ্বকাপ পার্টিতে অংশ না নিলে তা আর জানা হতো না। টাকিলা মেক্সিকানদের খুব প্রিয়। বুড়ো আঙ্গুল সমান পুঁচকে গ্লাসে গলায় ঢেলে মুখের ভেতর লেবুর রস চিপে একঢোকে পুরোটা গিলতে হয়। তীব্রতায় মুখ কুঁচকানো দেখে আশপাশ থেকে হাসির ফোয়ারা উঠে। এই আনন্দের ছটায় বিন্দুমাত্র কপটতা নেই। বল্গাহারা প্রাণোচ্ছ্লতা। নির্ভেজাল গোলের আনন্দ! সারারাতের সেই আনন্দ যাত্রায় কখন যে সাড়ে ছ’ঘণ্টা কেটে গেল টেরই পেলাম না। বুঝলাম, যখন সকালে হামবুর্গে ট্রেন এসে থামল তখন!
সেদিন আরেকবার বুঝলাম, ফুটবল বিশ্বকাপ শুধু মাঠের খেলা নয়। শুধু নব্বই মিনিটের ম্যাচই সব নয়!
পরের গল্প: ইন্টারভিউ নেওয়ার আগে, দিতে হলো!
আরও পড়ুন: তিমি’র সঙ্গে ছবি তোলা!
শচীন’স সসেজ, গাঙ্গুলি’স গ্রিল, মিয়াঁদাদ ম্যাজিক ম্যাঙ্গো জুস...
মার্টিন বিক্রেমাসিংহের বাড়িতে নিমন্ত্রণ
ক্যান্ডির মন খারাপ করা সৌন্দর্য!