স্বাধীনতা দিবস



ইভন ভেরা
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

অনুবাদ ফজল হাসান

জিম্বাবুইয়ের অন্যতম সফল ও একাধিক পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক এবং শিল্পকলার পরিচালক ইভন ভেরার জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, তৎকালীন দক্ষিণ রোডেশিয়ার বুলাওয়ে শহরে। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা বুলাওয়ের জিলিকাজি হাইস্কুলে। কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে আন্ডারগ্রাজুয়েশন, গ্রাজুয়েশন এবং পিএইচি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৫ সালে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৭ সালে জিম্বাবুইয়ের ন্যাশনাল গ্যালারির পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।

ইভন ভেরার উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য কাব্যিক গদ্য ভাষা, জটিল বিষয়বস্তু, নারী চরিত্র এবং জিম্বাবুয়ের অতীত কাহিনী। তাঁর একমাত্র ছোটগল্প সংকলন ‘হোয়াই ডোন্ট ইউ কার্ভ আদার অ্যানিমেলস্’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। তিনি পাঁচটি উপন্যাসের রচয়িতা। এগুলো হলো—‘নেহাদা’ (১৯৯৩), ‘উ্যইদআউট্ এ নেম’ (১৯৯৪), ‘আন্ডার দ্য টাঙ’ (১৯৯৬), ‘বাটারফ্লাই বার্নিং’ (১৯৯৮) এবং ‘দ্য স্টোন ভার্জিনস্’ (২০০২)। এসব উপন্যাসের জন্য তিনি একাধিক সম্মানিত পুরস্কার লাভ করেন। ‘উ্যইদআউট্ এ নেম’ এবং ‘আন্ডার দ্য টাঙ’ উপন্যাস দু’টির জন্য তিনি দু’বার কমনওয়েলথ্ রাইটার্স’ প্রাইজ (আফ্রিকা এলাকায়) পেয়েছেন। এছাড়া ‘উ্যইদআউট্ এ নেম’ উপন্যাসের জন্য জিম্বাবুইয়ান পাবলিশার্স’ লিটারেরি প্রাইজ, ‘বাটারফ্লাই বার্নিং’ উপন্যাসের জন্য জার্মান লিটারেরি প্রাইজ এবং ‘দ্য স্টোন ভার্জিনস্’ উপন্যাসের জন্য ম্যাকমিলান রাইটার্স প্রাইজ (আফ্রিকা এলাকায়) লাভ করেন।

আফ্রিকার নারীবাদী লেখিকা হিসেবে ২০০৪ সালে তাঁকে সুইডিশ পেন টাকোলস্কি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। তিনি ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘ওপেনিং স্পেসেস: অ্যান অ্যান্থলজি অফ কন্টেম্পোরারি আফ্রিকান উইমেন’স্ রাইটিং’ সংকলন সম্পাদনা করেন। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে এইডস্-সম্পর্কীয় মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০০৫ সালের ৭ এপ্রিল টরন্টো শহরে দেহত্যাগ করেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Oct/04/1538647860596.jpg

ইভন ভেরা

 

‘পিছে যান! পিছে যান!’ পুলিশ চিৎকার করে বলল।

ইংল্যান্ড থেকে আসা রাজপুত্তুরকে দেখার জন্য জনগণ আজ শহরের রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে। তাদের মাতৃভূমিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাজপুত্তুর এসেছে। মধ্যরাতে।

মহিলা দুশ্চিন্তামুক্ত সাদা মন নিয়ে দাঁড়ায় এবং অপেক্ষা করে। নির্ধারিত সময়ের আগে স্কুলের ছেলেমেয়েদের ছুটি দেওয়া হয়েছে এবং ওরা ফাঁকা রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়েছে। মুখের ওপর সামান্য ছায়ার জন্য ছাত্রছাত্রীরা মাথার উপর বই তুলে ধরেছে। সূর্যের তীক্ষ্ণ রোদ পিচঢালা পথে এসে পড়েছে। মাঝখানে মোটা হলুদ দাগের ওপর একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে এবং সে দূরের পানে তাকিয়ে একটা কিছু খুঁজছে। পুলিশের পায়ে ভারী বাদামি রঙের জুতা এবং খাকি কাপড়ের পোশাক। পুলিশ হাতের বন্দুক এবং লাঠি উঁচিয়ে ছেলেমেয়েদের পেছনে সরে যেতে বলছে। ইংল্যান্ডের রাজপুত্তুর ভিড় পছন্দ করবেন না।

রাস্তার বিপরীত দিকে উঁচু গাম-ট্রির ছায়ায় মহিলারা আঞ্চলিক গান গাইছে এবং গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করছে। ভবিষ্যতকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষারত মহিলাদের মুখমণ্ডল বেয়ে ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ হাতের বন্দুক এবং লাঠি উঁচিয়ে উপস্থিত জনগণকে পেছনে সরে যাওয়ার অথবা সারি বেঁধে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিচ্ছে। হাতে নিয়ে নাড়ানোর জন্য একজন লোক এক মহিলাকে ছোট্ট একটা পতাকা দেয়। নতুন দেশের নতুন পতাকা। যুবরাজকে তার মা, অর্থাৎ রানি, পাঠিয়েছেন। তাঁর জন্য অপেক্ষারত মহিলা ক্লান্ত মুখের ওপর জাকারান্ডা গাছের একটা ভাঙা ডাল ধরে রেখেছে এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

রাস্তার দু’পাশে বেগুনি রঙের ফুলে ভরা জাকারান্ডা গাছ। সেই রাস্তা দিয়ে একটা লিমোজিন গাড়ি এগিয়ে আসে। ছেলেমেয়েরা উল্লসিত হয়ে চিৎকারে চারপাশ মুখরিত করে তোলে। তারা ভেবেছে, তাদের মাতৃভূমিকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সেই সূদূর ইংল্যান্ড থেকে আসা আকাঙ্খিত মানুষ। রাস্তা পেরিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির দিকে মহিলা তাকিয়ে থাকে। একসময় সে উপলব্ধি করে যে, মানুষের মাঝে উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে গেছে। আসলে তা চরম উত্তেজনার মুহূর্ত ছিল না। সেটি ছিল অন্য একটা গাড়ি।

‘রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা জানব না কোন গাড়ির মধ্যে রাজকুমার আছে,’ ভিড়ের মধ্যে এক লোক বলল। ‘নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া প্রত্যেকটি গাড়িকে আমরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানাব। একটা গাড়ির ভেতর রাজকুমার থাকবেন।’

‘তাহলে আপনি কী বলতে চান, আমরা যুবরাজকে দেখতে পারব না?’ মহিলা জিজ্ঞাসা করে। তার চোখেমুখে বিহ্বলতা। যেই লোক তাদের কাছে মাতৃভূমি ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষমতার হাত বদল করবেন, তাকে একনজর দেখার জন্য সে খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগেছে। সাইরেনের শব্দ শুনতে পেয়ে সে তাকিয়ে দেখে পুলিশের মোটরগাড়ি এবং পেছনে করেকটি গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে।

‘পিছে হটো ! পিছে হটো !’ পুলিশ চিৎকার করে উল্লসিত ছাত্রছাত্রীদের বলল। তারা চলমান গাড়ির উদ্দেশ্যে ছোট্ট পতাকা নিয়ে সামনের দিকে হাত বাড়ায়।
‘কোন গাড়িতে রাজকুমার?’ মহিলা জিজ্ঞাসা করে।
‘নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই প্রথম কিংবা দ্বিতীয় গাড়িতে নেই,’ জবাবে লোকটি বলল। ‘এবং অবশ্য সঙ্গত কারণে শেষ গাড়িতে নেই।’
তাহলে নিশ্চয়ই তৃতীয় গাড়িতে। মহিলা বড় বড় চোখ করে রঙিন কাঁচের জানালা গলিয়ে গাড়ির ভেতর কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কিন্তু সে কিছুই দেখতে পায়নি। তবুও সবাই হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে এবং আনন্দ-উল্লাসে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। তারা শুধু গাড়ির জানালার রঙিন কাঁচে বেগুনি রঙের ফুলে ভরা জাকারান্ডা গাছের প্রতিবিম্বের ফাঁকে নিজেদের উত্তেজিত চেহারার প্রতিচ্ছায়া দেখতে পেল। রাজকুমার নিশ্চয়ই সেই রাস্তা পেরিয়ে চলে গেছেন। যদিও তারা তাঁকে দেখেনি, কিন্তু তিনি হয়তো তাদের দেখেছেন। ‘আপনারা কি যুবরাজকে দেখেছেন?’ বাড়ি ফেরার পথে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করে। পরবর্তীতে অনেকে তাঁকে রাতের বেলা স্টেডিয়ামে দেখতে পাবে। মহিলা সেখানে যাবে না।

***
লোকটি এক হাত দিয়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরে এবং তার অন্য হাতে শীতল পানীয়ের বোতল। লোকটির সম্মুখে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান চলছে। কিন্তু সে আগে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠান দেখতে চায়। ইতিমধ্যে মহিলাকে সে টাকা দিয়েছে। মহিলা টাকাগুলো একটা হলুদ রুমালে গিট্টু করে ব্রা’র ফিতার সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। ফুটবল খেলার জন্য নির্মিত স্টেডিয়ামের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী লোকে লোকারণ্য। প্রথমে স্টেডিয়ামের মাঝখানে প্রথাগত নৃত্য পরিবেশন করা হয়। দুশ্চিন্তামুক্ত সাদা মন নিয়ে মহিলা নিজেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয় এবং টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে।

নয়া প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ সময় নিয়ে বক্তৃতা করেন এবং উপস্থিত জনগণ করতালির সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। উল্লসিত হয়ে তারা মুষ্ঠি উপরের দিকে তুলে আনন্দ প্রকাশ করে। নয়া প্রধানমন্ত্রী মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার সময় মহিলা নাচছিল। তিনি যখন আশু পরিবর্তনের কথা বলছিলেন, তখন লোকজন পতাকা নেড়ে তাঁকে সমর্থন জানায়। চাকুরী এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে উপার্জনের আশ্বাস প্রদান করেন। জমি-জমা এবং শিক্ষার কথাও উল্লেখ করেন, এমনকি ধনধৌলত এবং খাদ্য নিয়েও কথা বলেন। মহিলা দেখে রাজকুমার নিশ্চুপ বসে আছেন। তাঁর পরনে ধবধবে সাদা পোশাক। সরকারি লোকেরা বলেছে যুবরাজের মা, অর্থাৎ রানী, আসতে পারেননি। যাহোক, এধরনের অনুষ্ঠানে তিনি রানীর মতোই সম্মানিত এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি। রাজকুমার সম্পর্কে নয়া প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রেখেছেন এবং প্রত্যেকে তুমুল হাততালি দিয়ে সমর্থন জানিয়েছে।

একসময় লোকটি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখা ছেড়ে আরেক বোতল ঠান্ডা পানীয় আনার জন্য রান্নাঘরে প্রবেশ করে। সে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে চায়—শীতল পানীয় এবং রমণী। তখন রাত বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে মহিলা পরনের কাপড়চোপড় খুলে ফেলেছে। টেলিভিশনের পর্দায় ক্রমাগত মিনিটের সংখ্যা ভেসে উঠে। স্টেডিয়ামের মাঝখানে বিশাল পতাকা স্তম্ভের দিকে নয়া প্রধানমন্ত্রী এবং যুবরাজ হেঁটে যান। স্তম্ভের উপরে পুরনো পতাকা উড়ছে এবং নতুন পতাকা স্তম্ভের নিচে ঝুলে আছে।  লোকটি ধাক্কা দিয়ে মহিলাকে মেঝেতে সরিয়ে দেয়। সে বলবান এবং সাফল্যের মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করবে। মহিলা পা মেলে ধরে। তখন মাঝরাত এবং নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরিবর্তনের অলৌকিক সময়। সবুজ, হলুদ, সাদা। খাবার, ধনধৌলত, পুনরায় সমন্বয়।

একসময় লোকটি মহিলাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। যখন সে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, তখন পুরো বাড়িটাই তার নিজের মনে হয়। জাকারান্ডা গাছের নিচে তাদের দেখা হয়েছিল। তখন তারা ইংরেজ যুবরাজের জন্য অপেক্ষা করছিল।

সকালে মহিলা দেখে ছোট্ট দুটি পতাকা ঝোপের ওপর ঝুলে আছে—একটা পুরনো পতাকা এবং একটা নতুন।

   

আলো অচেনা



কামাল হোসেন টিপু
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

তুমি কি গো সে
হেমন্তের রাতে চলে গেছে যে!
হিজলের তলে কেন আনমুখী
রয়েছ বসে আজ একাকী?

অনেক সুখের ছিল দিনগুলো সেই,
তার কিছু আছে মনে, কিছু নেই!
অনেক মায়ায় মাখা দিনগুলো
অভিমানে সবই হারালো?
তার কিছু বুঝি আজ পড়েছে মনে
তাই কি গো এলে এতো পিছনে?

আঁধারে যার রাজত্ব রোজ
তার কাছে পাবে কি আলোর খোঁজ?
অশ্রু যে ঝরাও আজ এতো
মূল্য কী পাবে তার ততো?
কতই-বা দীর্ঘ তোমার অশ্রুনদী
সইতে কী পারবে, নদী আমার দেখ যদি?

দেখ, শেষ হয়ে এলো গোধূলি বেলা
আরো কিছু পরে নামবে সন্ধ্যা খেলা।
আলোর যেটুকু রয়েছে বাকি
তারে সাথে লয়ে যাও ডাকি;

রাত্রির সব রঙ অচেনা তোমার
হারাবে পথ, পথে আবার
আঁধার ভীষণ কালো, অন্ধকার
সে নহে তোমার যোগ্য উপহার

;

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সময়ের লড়াকু বুদ্ধিজীবী



আজফার হোসেন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আজীবন বিরাজমান নিপীড়ক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছেন। আর ওই ব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের মুক্তির স্বার্থেই তিনি তাঁর লড়াকু প্রশ্ন ও চিন্তাকে অন্যের কাছে নিয়ে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। আমি মনে করি, এটাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাজে-চিন্তায় শুধু চিন্তাই থাকে না, প্রশ্ন কেবল প্রশ্নেই থাকে না, সেগুলো হয়ে ওঠে মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের হাতিয়ারও।

২৩ জুন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৯তম জন্মদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে তিনি ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। প্রথমে তাঁকে দেখেছি দূর থেকে, তারপর দেখেছি শ্রেণিকক্ষে, যেখানে তাঁর একেকটি বক্তৃতাকে মনে হতো একেকটি মহাকাব্যিক ঘটনা, যার সম্পূর্ণ তাৎপর্য বুঝে ওঠার ক্ষমতা তখনো অর্জন না করলেও পরিষ্কার বুঝতাম যে আমার এই অসাধারণ বাগ্মী শিক্ষক শুধুই বলেন না, দেখানও। আর বিষয়কে একই সঙ্গে সহজ ও সুন্দর করে উপস্থাপনও করেন, যেখানে তাঁর নিজস্বতা সব সময় স্পষ্ট হয়ে থাকে। দেশে ও বিদেশে আমি নিজেই ইংরেজি সাহিত্য পড়েছি এবং পড়িয়েছি। অবশ্যই বলতে হবে যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো মনীষাসম্পন্ন ও প্রতিভাবান ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক খুব কম দেখেছি। কিন্তু এখানে শুধু শিক্ষক হিসেবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রশংসা করা আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং তাঁর কাজের সমগ্রকে বিবেচনায় রেখেই এই রচনার সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর বিশাল কর্মকা-ের দু-একটি তাৎপর্য সামনে আনতে চাই।

ইংরেজি সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক তো বটেই, তিনি একাধারে সংস্কৃতি সমালোচক, সমাজ বিশ্লেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, ইতিহাসবেত্তা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কলামিস্ট, সম্পাদক, অ্যাকটিভিস্ট, সংগঠক। এমনকি তিনি কিশোরদের জন্য গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেছেন বিস্তর। তাদের জন্য বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদও করেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা একশত ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে তাঁর অসংখ্য অসংকলিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ-রচনা। অর্থাৎ প্রায় সারা জীবন তিনি ক্লান্তিহীনভাবে লিখে চলেছেন। তাঁর অপ্রতিরোধ্য লেখনীশক্তি তাঁর তারুণ্যকে চিহ্নিত করে রেখেছে এই বয়সেও।

পরিষ্কার যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনেক এলাকায় বিচরণ করেছেন। তবে বিষয়ের বিবেচনায় তাঁর কাজের বড় এলাকা হচ্ছে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য। কার্ল মাকর্সের প্রিয় প্রবচন ছিল, ‘যা কিছু মানুষের তা আমার অনাত্মীয় নয়।’ কথাটা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজের ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যবহার করা যাবে। বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন যে বুদ্ধিজীবী কেবল বিশেষজ্ঞ নন, সব ব্যাপারেই আগ্রহ তাঁর। হ্যাঁ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শুধু বিশেষজ্ঞ নন, চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে তিনি বুদ্ধিজীবী। জোর দিয়েই বলা দরকার তাঁর সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে যে পরিচয় স্পষ্ট হয়ে থাকে, তা হচ্ছে বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর পরিচয়। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিজীবী। আর বুদ্ধিজীবী বলেই তিনি দায়বদ্ধ। সেই দায় দেশের ও দুনিয়ার মেহনতি মানুষের প্রতি, যার পক্ষে তিনি তাঁর চিন্তায় ও কাজে, লেখায় ও কথায়, লড়ে গেছেন আজীবন। এভাবেও বলা যায়, তাঁর লেখা ও লড়াইয়ের মাঝখানে কোনো বিভাজন রেখা নেই।

বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে বিশ শতকের বুদ্ধিজীবীরাই লিখেছেন তাঁদের দায় ও দায়িত্ব নিয়ে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যাবে ইতালীয় মাকর্সবাদী আন্তোনিও গ্রামসির কথা; আরো বলা যাবে পরবর্তী সময়ের নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড সাঈদের কথা। এঁরা সবাই তাঁদের মতো করেই লড়াকু, প্রতিরোধী, দায়বদ্ধ বুদ্ধিজীবীকে আলাদা করে দেখেছেন বিশেষজ্ঞ ও এমনকি সনাতন বুদ্ধিজীবী থেকে। এই ঐতিহ্যেই আমাদের শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও লিখেছেন বুদ্ধিজীবীর দায় ও দায়িত্ব নিয়ে, তাঁর একাধিক রচনায়। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর অসাধারণ প্রবন্ধ ‘বুদ্ধিজীবীদের কাজকর্ম ও দায়দায়িত্ব’। এই প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন যে বুদ্ধিজীবী তিনি, যিনি মানুষের মুক্তির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ বলেই বিরাজমান নিপীড়ক ও আধিপত্যবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেন সেই ব্যবস্থাকে বদলাবেন বলেই; তিনি ক্ষমতাকে দাঁড় করিয়ে দেন সত্যের মুখোমুখি। শুধু তা-ই নয়, তিনি তাঁর লড়াকু চিন্তাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতেও সচেষ্ট থাকেন নিরন্তর।

বুদ্ধিজীবী নিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এসব চিন্তা তাঁর নিজের কাজের বেলায়ও খাটে বটে। তিনি আজীবন বিরাজমান নিপীড়ক ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে গেছেন। আর ওই ব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের মুক্তির স্বার্থেই তিনি তাঁর লড়াকু প্রশ্ন ও চিন্তাকে অন্যের কাছে নিয়ে গেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। আমি মনে করি, এটাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর কাজে চিন্তা শুধু চিন্তাই থাকে না, প্রশ্ন শুধু প্রশ্নই থাকে না, সেগুলো হয়ে ওঠে মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের হাতিয়ারও।

কিন্তু কোন ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী? এখানেও তিনি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেন বিরাজমান ব্যবস্থাকে। বলা দরকার, স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা শুধু তাঁর অনন্ত পাঠযোগ্য গদ্যের শৈলীগত বৈশিষ্ট্যই নয়, তা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রশ্নও। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজ বারবারই প্রমাণ করে যে শৈলীর প্রশ্নও রাজনৈতিক প্রশ্ন। সরাসরি যাঁরা বিরাজমান ব্যবস্থাকে স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে পারেন না, তাঁরা তো কোনো না কোনোভাবে ওই ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান নেন। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথার চরকিবাজিতেও যাঁরা সত্য বলতে চান এবং ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে চান, তাঁরা আসলে সত্যের প্রতি অবিচারই করেন এবং পরোক্ষভাবে হলেও বিরাজমান ব্যবস্থার পক্ষেই থাকেন। এঁদের বিপরীতে দাঁড়িয়েই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিরাজমান ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে এসেছেন দীর্ঘসময় ধরেই। এসব ব্যবস্থা হচ্ছে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ/উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পিতৃতন্ত্র/পুরুষতন্ত্র।

স্পষ্ট করেই বলা দরকার যে আমাদের সময়ের প্রধান পুঁজিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, উপনিবেশবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও পিতৃতন্ত্রবিরোধী লড়াকু লেখক ও বুদ্ধিজীবীর নাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যিনি মনে করেন যে এসব নিপীড়ন ও শোষণের ব্যবস্থাকে বদলানো ছাড়া এবং সেগুলো থেকে মুক্তি ছাড়া জনগণের মুক্তি সম্ভব নয়। এও স্পষ্ট করে বলা দরকার যে তাঁর প্রায় সব কাজের কেন্দ্রে থাকে জনগণের মুক্তির প্রসঙ্গ, যে কারণে বিপ্লবী রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে অংশগ্রহণ অক্ষুণœ থেকেছে আজীবন। আর এই বিপ্লবী রাজনীতি মানে শুধু বিরাজমান ব্যবস্থাকে বিরোধিতা করা নয়, তার অর্থ পক্ষাবলম্বনও। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্পষ্টত সমাজতন্ত্রের পক্ষে। সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার অটুট থেকেছে আজীবন, যিনি মনে করেন, সত্যিকার গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। সমাজতন্ত্রী বলে তিনি গণতন্ত্রীও; গণতন্ত্রী বলেই তিনি সমাজতন্ত্রীও।

সমাজতন্ত্র নিয়ে বস্তাপচা ভুল ধারণার আধিপত্যের সময়ে এবং তথাকথিত বামপন্থিদের সুবিধাবাদের এই দুঃসময়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের অনেকের জন্য নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা। আর যাঁরা সমাজতন্ত্রী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে না চেনে বা সেই পরিচয়কে বাদ দিয়ে তিনি যে কত ভালো শিক্ষক বা কত ভালো লেখক এই প্রশংসায় গদগদ করেন, তাঁরা আসলেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রতি অবিচার করেন বলেই আমি মনে করি। আর গ্রামসির মতোই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর কাজের ভেতর দিয়েই বুঝিয়ে দেন যে আমরা কোন বিষয়ের ওপর জোর দিই আর কোন বিষয়ের ওপর দিই না, কোন বিষয়কে উহ্য রাখি আর কোন বিষয়কে যুক্ত রাখি, তা রাজনৈতিকভাবে বা মতাদর্শিকভাবে মোটেই নিরীহ বা নিরপেক্ষ নয়।


ফিরি জনগণের মুক্তি প্রসঙ্গে, যা আগেই বলা হয়েছে, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজের কেন্দ্রীয় বিষয়। শুধু বিষয়ই নয়, নিরিখও বটে। অর্থাৎ জনগণের মুক্তির নিরিখেই তিনি সাহিত্য সমালোচনা করেন, সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেন, সমাজকে বিচার-বিশ্লেষণ করেন, যেমন তা করেন রাজনীতির ও ইতিহাসের পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও। এসব প্রসঙ্গে পরে ফেরা যাবে। তবে ওই প্রশ্নটা এখন তোলা জরুরি : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্য জনগণ কারা? সবাই তো জনগণের নামে কথা বলতে চান। আমাদের শাসক শ্রেণি জনগণের নামে কথা বলে, ব্যবসায়ীরাও জনগণের নামে কথা বলেন, এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও জনগণের নামে কথা বলে থাকে। উদারনৈতিক মানবতাবাদের ঐতিহ্যেও ‘জনগণ’ বা ‘মানুষ’ কথাটা বারবার ফিরে আসে মানবপ্রেমের নামে, যে প্রেম আমরা দেখেছি, বিরাজমান অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক বা অসম শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতি সম্পর্ককে ধোঁয়াশা করে থাকে। বলাই বাহুল্য, এই উদারনৈতিক মানবতাবাদ জনগণের বিপ্লবকে ভয় পায় এবং সে কারণেই তার কোনো সম্ভাবনাকে সে প্রশ্রয় দেয় না।

ঠিক এই ধারার বিপরীতেই ‘জনগণ’কে বা ‘মানুষ’কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ফাঁকা বুলি হিসেবে না নিয়ে উদারনৈতিকতাকে শুধু তুমুল সমালোচনাই করেন না; তিনি বিভিন্ন রচনায়; বরং জনগণকে বা মানুষকে দেখেন বিরাজমান অসম উৎপাদন-সম্পর্ক ও ক্ষমতা-সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে; তাঁদের দেখেন তিনি শ্রেণি-লিঙ্গ-বর্ণ-জাতির অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের নিরিখে, যাতে সাম্যবাদী বিপ্লবী রাজনীতির স্বার্থেই বিরাজমান অসমতাকে চিহ্নিত করা যায় এবং তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। অন্য কথায়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্য ‘জনগণ’ বা ‘মানুষ’ তারাই, যারা বাংলাদেশে ও বিশ্বে অধিকাংশ মানুষÑযারা শোষিত ও নিপীড়িত, যারা পুঁজি ও সাম্রাজ্যের সবচেয়ে নির্মম শিকার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই জনগণ হচ্ছে কৃষক, শ্রমিক, নারী, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা। সিরাজুল ইসলাম এঁদের পক্ষেই আজীবন লিখেছেন, বলেছেন, লড়াই করেছেন। কেননা তিনি বুঝে গেছেন এবং বুঝিয়েও দিয়েছেন যে এদের মুক্তি ছাড়া মানবতার সার্বিক মুক্তি সম্ভব নয়।

মুক্তির বিষয়টা কেন্দ্রীয় বলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য নিয়ে প্রচুর লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আমাদের জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের অর্জনগুলোকে চিহ্নিত করেই অনেকের আগেইÑসেই সত্তরের দশক থেকেই বলে এসেছেন যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অসমাপ্ত। এ কারণে ১৯৯৩ সালে জাহানারা ইমাম এক কথোপকথনে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজ আমাদের দিকনির্দেশনা দেয় এবং আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে। আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ঘোষিত নীতি ছিল।

সেগুলো হলো সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সেই প্রথম দিককার বই নিরাশ্রয় গৃহী (১৯৭৪) থেকে শুরু করে তাঁর স্বাধীনতা স্পৃহা ও সাম্যের ভয় (১৯৮৮)-এর ভেতর দিয়ে বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি (২০১৪) পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে মুক্তিযুদ্ধের ওই তিনটি ঘোষিত নীতি কখনো হয়ে উঠেছে সরাসরি বিষয়বস্তু এবং প্রায়ই থেকেছে বিচার-বিবেচনার লিপ্ত নিরিখ। এদিক থেকে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে একজন সার্বক্ষণিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও গণ্য করা চলে।


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথমত ও প্রধানত বাংলাদেশের লড়াকু বুদ্ধিজীবী বলেই বাংলাদেশের মেহনতি মানুষের সমস্যা ও সংগ্রাম তাঁর অসংখ্য রচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও পিতৃতন্ত্র ছাড়াও তাঁর প্রিয় বিষয় হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। এখানে তাঁর জাতীয়তাবাদ-সংক্রান্ত ধ্যানধারণার বিশদ মূল্যায়ন পরিসরের স্বল্পতার কারণে সম্ভব নয়। তবে অবশ্যই বলা যাবে যে তিনি আমাদের সময়ে জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক। তিনি যেমন ঐতিহাসিক কারণে জাতীয়তাবাদের ভেতরে ক্ষেত্রবিশেষে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও উপনিবেশবাদবিরোধী উপাদান শনাক্ত করেছেন, তেমনি তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনাও করেছেন, এটা বুঝিয়ে যে সব জাতীয়তাবাদ এক ধরনের নয়।

কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আন্তর্জাতিকতাবাদীও। ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনা বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব, ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তির লড়াইসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই নিয়েও লিখেছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন যে বিপ্লব ও সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা ব্যতিরেকে বিপ্লবী রাজনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পথ শনাক্ত ও প্রশস্ত করা সম্ভব নয়। তবে শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ স্পষ্ট হয়ে থাকে, যেমন তা থাকে ইংরেজি সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তাঁর বিস্তর আলোচনায়। এ ক্ষেত্রে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেছেন বটে।

এবার তাঁর কাজের বিষয় নিয়ে আরো কয়েকটা কথা বলে নেওয়া যাক। আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে অসংখ্য বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি। এখানে তাঁর কিছু প্রিয় বিষয়বস্তুর একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া যেতে পারে এভাবেÑবাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি, সাম্য ও স্বাধীনতা, বামপন্থী রাজনীতি, বিপ্লবী রাজনীতি, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পিতৃতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন, সমাজ ও সংস্কৃতি, শ্রেণি ও সাহিত্য ইত্যাদি।

যদিও বর্তমান রচনার প্রধান বিষয়বস্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সাহিত্য সমালোচনা ও সংস্কৃতি সমালোচনা নয়, তবু এ বিষয় নিয়ে দু-একটা কথা না বললেই নয়। তিনি সমান দক্ষতায় বিচরণ করেছেন বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের সমালোচনার এলাকায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি বিশিষ্ট প্রশ্ন তোলার জন্য। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি প্রধান সাহিত্যিকদের নিয়ে তিনি লিখেছেন প্রচুর। লিখেছেন তিনি বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দসহ অসংখ্য লেখককে নিয়ে। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রায় সমান্তরালবিহীন। কিন্তু তিনি আরো বিশিষ্ট এই কারণে যে সাহিত্যিক মহারথীদের বন্দনা করা বা আনুগত্যের সংস্কৃতিতে তিনি সাহিত্যিক এস্টাব্লিশমেন্টকে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন করেছেন সাহস নিয়ে।

কিন্তু তিনি প্রশ্ন করার জন্যই শুধু প্রশ্ন করেননি। প্রশ্ন করেছেন বঙ্কিমকে, শরৎচন্দ্রকে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে রবীন্দ্রনাথকেও, জনগণের সমষ্টিগত মুক্তির আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের পরিপ্রেক্ষিতেই। ইংরেজি সাহিত্যের সমালোচনার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। যখন ইংরেজির ডাকসাইটে অধ্যাপকরা আইরিশ-ইঙ্গ-মার্কিন আধুনিকতাবাদীদের, অর্থাৎ ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়ট, লরেন্স, জয়েস্ প্রমুখকে বন্দনা করতে ব্যস্ত, ঠিক তখন বিস্ফোরণের আকারে প্রকাশিত হয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বই ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যে’, যেখানে তিনি অসাধারণ দক্ষতাসহকারে ওই সব সাহিত্যিক মহারথীর ফাঁক ও ফাঁকি চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাঁদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক অবস্থানের সমস্যাগুলো চিনিয়ে দেন। হ্যাঁ, তিনি ‘ক্রিটিক’-এর পর ‘ক্রিটিক’ হাজির করেছেন, সেগুলো বাংলাদেশে সাহিত্য সমালোচনার শুধু ‘নতুন দিগন্ত’ই উন্মোচন করেনি, সেগুলো জনগণের মুক্তির সংগ্রামে হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

জনগণের মুক্তির সংগ্রামের স্বার্থেই আমাদের সময়ের অন্যতম প্রধান লড়াকু বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আরো দীর্ঘ জীবন কামনা করি। তাঁকে জানাই লড়াকু অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা তাঁর ৮৯তম জন্মদিনে।

আজফার হোসেন: কবি, লেখক-গবেষক, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক 

;

কোরবানি



শাহেদ শফিক
কোরবানি

কোরবানি

  • Font increase
  • Font Decrease

আমি তো হাজির হে আমার রব
তোমার প্রিয় ঘরে
উজাড় করে দিতে পারি সব
প্রভু তোমার তরে।

নত মনে আজ তোমার চরণে
সঁপেছি এই শির
তুমি তো মহান, চির অম্লান,
মালিক ধরিত্রীর।

আজ দূর হয়ে যাক মনের পশু
ধুয়ে যাক সব জিদ
জাগ্রত হোক কণ্ঠে সবার
বাজুক তোমার গীত।

তুমি তো আমায় দিয়েছিলে রব
জগতের সব কিছু।
আমি তো ছুটেছি জীবন জুড়ে
পাপের পিছু পিছু।

কী দিয়ে তোমার, সুধিবো ঋণ
নেই যে কিছু আর
তাই তো প্রভু তোমার সকাসে
ছুটি বারং বার।

আজ দূর হয়ে যাক সব ভেদাভেদ
পড়রে কালিমা
হিংসা বিভেদ, ফাসাদ ভুলিয়া
ছড়াক মহিমা।

১৭ জুন ২০২৪।
লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

;

কদম



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ঋতুটি শরৎ এখন পঞ্জিকার পাতায়।
বর্ষার আমেজ কাটেনি বুঝি, সারাটি আকাশ
কালো করে নামে বৃষ্টি।
একটানা ভিজে শালবন, মহুয়ার কিশলয়। সতেজ হয়-
লতানো পুঁইয়ের ডগা।

এ বর্ষণ দেখার সৌভাগ্য আমার নেই। দূর পরবাসে
বসে আমি ভাবি- আহ, কি সহজেই ভুলে গেলাম, ভুলে গেলাম
প্রিয় ফুল কদমের কথা...!
পড়ার টেবিলে দুটো কদম, আষাঢ় শ্রাবণে তরতাজা দুটো কদম
জিইয়ে রেখেছি কতো-
কাচের বোতলে। ভেজা বাতাসে কদমের হালকা সুবাস।
তিনটে বছর, মাত্র তিনটে বছর
ভুলিয়ে দিলো চব্বিশ বছরের বর্ষার স্মৃতি, যেন চব্বিশ বছর
পরাজিত তিন বছরের পাল্লায়।

পরিজন ফোন করে খবর নিতে- ‘কি পাঠাবো বল...?
কাঠালের বিচি ভাজা, চিনে বাদাম, ঝুনা নারকেল
নাকি আমের আচার...?’-ওদের তালিকায়
আমার পছন্দ অনুপস্থিত।

সাহেবদের বিলেতী ফুলের ভীড়ে
ঠাঁই নেই কদমের-
যেমন আছে কাঁদা মাটির সুঁদাগন্ধ ভরা বাংলায়।
ক্যালেণ্ডারের পাতায় দেখি
ফুটফুটে কদমের শ্বেত রেণু বিনিময়, আর অন্তরে অনুভবে
রূপ-রস-গন্ধ।

;