ইপিজেড বন্ধ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, করোনার ঝুঁকিতে শ্রমিকরা
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসপ্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত সারা পৃথিবী। এ ভাইরাস দমনে এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মতে আপাতত জনসমাগম এড়িয়ে চলাই এ রোগ প্রতিরোধের উপায়। এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু নীলফামারী'র উত্তরা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে।
বুধবার (২৫ মার্চ) সকালে জেলার সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নে অবস্হিত উত্তরা ইপিজেডে গিয়ে দেখা যায় কর্মরত শ্রমিকরা দলবেঁধেই কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছেন। কর্তৃপক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি সতর্কতামূলক কোনো উদ্যোগ। তাই কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে মুখে মাস্ক পরে বাধ্য হয়ে কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে তাদের। তাদের এ জনসমাগম থেকে করোনার সংক্রমণ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্যমতে, বিদেশ ফেরত সকল প্রবাসী বা নাগরিককে বাড়িতে সঙ্গরোধে রাখা হয়েছে। জনসমাগম এড়াতেই টানা ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হয়েছে। জনসমাগম হয় এমন সকল অনু্ষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। করোনা প্রতিরোধের অংশ হিসেবে সরকার গতকাল মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) থেকে সারাদেশে সেনাবাহিনী মাঠে নামিয়েছে।
ইপিজেডের মূল প্রবেশ পথে দেখা যায়, ইপিজেড কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা বাজারের দোকানগুলো বন্ধ থাকলেও পূর্বের মতোই নারী-পুরুষ শ্রমিকরা সাইকেল,মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা করে দলবেধে আসছেন, ইপিজেডের প্রবেশ করছেন একে অপরের গায়ে ঘেঁষে। ন্যূনতম দূরত্বও বজায় রাখছেন না শ্রমিকরা।
দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার ফারজানা কাজ করেন সেকশন সেভেন কারখানায়। তিনি বলেন, 'শোনা যাচ্ছে সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে সব কর্মস্থল বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। তবে ফ্যাক্টরি বন্ধ হলে আমাদের অসহায় জীবনযাপন করতে হবে। এজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করে আমাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ করুক। আমরা যেন খেয়ে থাকতে পারি’।
এভারগ্রীন প্রোডাক্ট বিডি লিমিটেড কোম্পানিতে কাজ করেন সৈয়দপুর উপজেলার ইয়াকুব আলী। তিনি জানান, 'আমরা গরীব মানুষ, পেটের দায়ে চাকরি করছি হঠাৎ করোনা ভাইরাসের মহামারি শুরু হওয়ায় বেশ চিন্তায় আছি। ছুটি না দিলে কিছু করার নেই।'
নীলফামারী সদর উপজেলার হাজারী হাট এলাকার আদর ইসলাম কাজ করেন ইপিজেডের উত্তরা সোয়েটার কারখানায়।করোনা ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন,'পেটের দায়ে এখনও কাজ করছি, তবে যত তাড়াতাড়ি বন্ধ করা যায় ততই ভালো।'
শিল্প-কারখানা বন্ধে সরকারি কোন সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে উত্তরা ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ এনামুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'এই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি বন্ধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান লে-অফ (শ্রম আইন অনুযায়ী অর্ধেক বেতন অগ্রিম প্রদান করা সাপেক্ষে শ্রমিকদের ছুটি প্রদান) করার পরিকল্পনা করছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে চালু রাখার পরিকল্পনায় আছে।'
তিনি জানান, 'শ্রম আইন অনুযায়ী নো ওয়ার্ক নো পে'র সুযোগ নেই, শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এতো বেতন দেবে কেমন করে। প্রোডাকশন নাই, কাঁচামাল নাই এগুলো নিয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো চিন্তিত।'
নীলফামারী জেলার সিভিল সার্জন রণজিৎ কুমার বর্মণ বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'উত্তরা ইপিজেড নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত কারণ এখানে যারা বিদেশ থেকে আসে তারা হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে চলে না, আমাদের সাথে যোগাযোগও করছে না। বিদেশি বিশেষত চীনের নাগরিকদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন সময়ে আমি এবং আমার স্টাফদের মাধ্যমে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করেছি। তারা কো-অপারেট করে নি। এখন যোগাযোগ হচ্ছে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে।'
সিভিল সার্জন জানান, 'সর্বশেষ যে ১৫ জন চীনা নাগরিক এসেছে। তার ১৪ জন কোয়ারেন্টাইন শেষ করেছে। এখনও একজন কোয়ারেন্টাইনে আছেন।
নীলফামারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীলফামারীতে উত্তরা ইপিজেড স্হাপনের পর এই অঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণে এবং নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য রেখে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে উত্তরা ইপিজেডের ৩৫ হাজার শ্রমিক তথা নীলফামারীকে রক্ষা করতে ইপিজেড বন্ধ রাখা কিংবা সীমিত আকারে পরিচালনা করা উচিত।'
স্বাস্থ্য বিভাগের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ডাঃ আমিন আহমেদ খান জানায়, 'আমরা বলছি পাশাপাশি দুজন থাকলে ৩ ফিট দূরত্বে থাকতে হবে। একসাথে অনেক লোক কাজ করছে, দূরত্ব মেইন্টেইন করছে কিনা, তাছাড়াও ওখানে বিদেশিরা কাজ করছে, তারা ঠিকমতো কোয়ারেন্টাইন মানছেন কি না সবমিলেই উত্তরা ইপিজেডের শ্রমিকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন।'
জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান চৌধুরী জানান, 'এ বিষয়ে ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রী পরিষদকে অবগত করা হয়েছে। যেকোন মুহূর্তে সিদ্ধান্ত আসবে।'
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে ২১৩ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত উত্তরা ইপিজেডে দেশী-বিদেশি ১৮ টি কোম্পানিতে প্রায় ৩৪ হাজার শ্রমিক কাজ করেছেন। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের নিয়ন্ত্রিত চারটি কোম্পানির প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এভারগ্রীন প্রডাক্ট ফ্যাক্টরী বিডি লিঃ, ম্যাজেন বিডি লিঃ, সনিক বাংলাদেশ লিঃ ও ভ্যানচুরা লেদার অয়্যার বিডি লিঃ এ চার কোম্পানিতে কাজ করেন ৪২৬ জন চীনা নাগরিক।