দারাশিকোহ: মুঘল ইতিহাসে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব
কর্ম ও চিন্তার দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক মানুষ ছিলেন দারাশিকোহ, যাকে চিহ্নিত করা যায় মুঘল ইতিহাসে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রূপে। প্রথাগত মুঘল দরবারের মূলস্রোতের সঙ্গে ছিল তার চিন্তা-ভাবনা-কর্মের বিশেষ পার্থক্য। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আমত্য ও যুবরাজগণ যখন দেখলেন, ব্যতিক্রমী চিন্তা ও বিশ্বাসের একজন মানুষ ক্রমশ সম্রাটের সহানুভূতি পেয়ে ক্ষমতাবান হচ্ছেন এবং তাকেই মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নির্বাচিত করা হয়েছে, তখন তার বিরুদ্ধে একটি মতাদর্শিক বলয় তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় সম্রাট শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় দারাশিকোহ একদিকে যেমন ক্ষমতাবান হচ্ছিলেন, অন্যদিকে তেরি হচ্ছিল তার রাজনৈতিক, আদশিক প্রতিপক্ষ ও শত্রুগোষ্ঠী।
ঐতিহাসিকদের মতে, দারাশিকোহ তার প্রপিতামহ, বিখ্যাত মুঘল সম্রাট আকবরের ধর্মীয় নীতি ও চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন। সম্রাট আকবর তার রাষ্ট্রনৈতিক নীতিতে ভারতের সকল ধর্ম ও মতের বিশ্বাসীদের একই মঞ্চে এনে একটি আলাদা ধর্ম বা বিশ্বাস প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ‘দ্বীন-ই-এলাহি’ নামে একটি বিধান জারি করে কিছুটা সাফল্যও প্রাপ্ত হন। কিন্তু এটিকে একটি ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অধিকাংশ মানুষ অনীহা প্রকাশ করেন। খোদ রাজা ভগবান দাস, আকবরের শ্বশুর ও সেনাপতি মান সিংহ, তার শ্যালক প্রমুখ এই মতাদর্শ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। আকবরও কাউকে চাপ প্রয়োগ করে তার ধর্মনীতি গ্রহণে বাধ্য করন নি। জানা যায়, আকবরের ‘নবরত্ম সভা’ বা নয় জন উপদেষ্টা ম-লীর একমাত্র বীরবলই ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনিই ছিলেন একমাত্র হিন্দু, যিনি আকবরের ধর্মমত গ্রহণ করেন। যদিও সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর ‘দ্বীন-ই-এলাহি’ নামক মতবাদের বিলুপ্তি ঘটে।
কিন্তু কয়েক প্রজন্ম পরে দারাশিকোহ সম্রাট আকবরের ধর্মমত অনুসরণে প্রবৃত্ত হন এবং মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে দারা একজন ‘সর্বেশ্বরবাদী’তে পরিণত হন। সর্বেশ্বরবাদ ও অদ্বৈতবাদ নামক ধর্মীয় দর্শনে তার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তিনি তালমুদ, ইঞ্জিল, মুসলিম সুফি ও হিন্দু বেদান্ত সাহিত্য গভীরভাবে পাঠ ও চর্চা করেন। তিনি তার শাসনক্ষেত্র এলাহাবাদ বা প্রয়াগের হিন্দু ধর্মীয় পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে একদল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সাহায্যে ‘উপনিষদ’র একটি ফারসি অনুবাদও সম্পন্ন করেন।
দারা তার প্রধান গ্রন্থের নাম রাখেন ‘মাজমা-উল-বাহরাইন’ বা ‘দুই মহাসাগরের সঙ্গমস্থল’। এই দুই মহাসমুদ্র বলতে তিনি হিন্দু ও মুসলিম ধর্মকে শনাক্ত করেন। তার মতে, হিন্দু ও মুসলিম ধর্মানুসারীদের চিন্তাধারা এক স্থানে এসে মিলিত হয়েছে, সে স্থানের নাম ‘দ্বীন-ই-এলাহি’ বা ‘তৌহিদ-ই-এলাহি’। তদুপরি দারা হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের উপদেশমূলক বক্তব্যগুলো একত্রিত করে একটি নতুন বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেন, যা কারো কারো মতে, নতুন ধর্মমতের প্রচারণা স্বরূপ এবং প্রপিতামহ আকবরের ধর্ম বিশ্বাসের সম্প্রসারণ।
তবে ঐতিহাসিক বিশ্লেষকদের মতে, আকবর ও দারার পদক্ষেপসমূহ আপাত একই মনে হলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ছিল। মূল পার্থক্য হলো, আকবর তা করেছিলেন রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য ও সংহতির কারণে আর দারা তা প্রসারের চেষ্টা করেন তার নিজস্ব মতবাদ ও বিশ্বাস আকারে। সম্রাট আকবর তার প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিলেন এবং সকল ধর্মের মানুষকে তার সামনে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তিনি সমন্বয়ের চিহ্ন স্বরূপ একজন রাজপুত নারীকে বিবাহ করেছিলেন এবং পরস্পর বিরোধী নানা ধর্ম ও বিশ্বাসকে তার অধীনস্থ করতেও সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু দারাশিকোহ তেমন সাফল্য লাভ করেন নি। বরং তার মত গোড়া ও কট্টরপন্থীদের কাছে সন্দেহের কারণ হয়েছিল। আকবর যেখানে ধর্মীয় সংস্কার ও সমন্বয় করে অনেক বিরোধী পক্ষকে কাছাকাছি আনতে এবং নিজের আনুগত্য ও প্রাধান্য মানতে বাধ্য করেছিলেন, তেমনটি দারাশিকোহ পারেন নি। পক্ষান্তরে দারাশিকোহ নিজের মতকে সর্বমহলে জনপ্রিয় করতেও সফল হন নি। বরং তার পদক্ষেপ মুঘল রাজনীতিতে ও ক্ষমতার বলয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে, যা তার প্রতিপক্ষ তারই বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে সমর্থ হয়। তিনি হয়ে পড়েন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের সামনে কোণঠাসা ও বিচ্ছিন্ন। দারাশিকোহর চিন্তা ও কর্মের ভিত্তিতে যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেন,তাতে মহামতি সম্রাট আকবরের ছায়া দেখা গেলেও সাফল্য দেখা যায় নি।
আরও পড়ুন:দারা ও আওরঙ্গজেব: অভিন্ন শৈশব, বিপরীত চরিত্র