মুক্তিযুদ্ধের বিস্মৃতপ্রায় গীতিকার গোবিন্দ হালদার
গত এক বছর ধরে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করে চলেছে। একাত্তরের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি সেমিনার, সম্মেলন ও আলোচনা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছে। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অগাধ অবদান থাকা সত্ত্বেও ‘জয় বাংলার গীতিকার’ গোবিন্দ হালদারের কথা ও অবদান (১৯৩০-২০১৫) বাংলাদেশ ও ভারতের নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে।
১৯৩০ সালের ৬ জুন ব্রিটিশ বাংলার যশোর জেলার বনগাঁয়ের একটি মালো (মল্ল ক্ষত্রিয়) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন গোবিন্দ হালদার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে ভারত সরকারের আয়কর বিভাগের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। শৈশব থেকেই গোবিন্দ হালদার কবিতা এবং আধা-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত (পদাবলি) রচনায় খুব আগ্রহী ছিলেন।
অদ্বৈত মল্ল বর্মণের (১৯১৪-১৯৯১) সাহিত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত গোবিন্দ হালদার জেলে এবং কৃষকসহ সাধারণ মানুষের সমস্যা ও জীবসংগ্রামের প্রতি অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ মৎস্যজীবী সমিতি স্থাপনের (১৯৬৯) সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন । এই সমিতির মুখপত্র 'ভাগীরথী'র সম্পাদকও ছিলেন তিনি।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে তিনি বাংলার জেলেদের অধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন। যমুনা-পদ্মা-মেঘনা-ভাগীরথী বিধৌত বঙ্গভূমির জেলেদের জীবনের দুঃখদুর্দশা ও গভীর যন্ত্রনার কথা গোবিন্দ হালদারের কলমে ও কথামালায় ফুটে উঠেছিল 'ভাগীরথী'র পাতায় পাতায়।
তবে গোবিন্দ হালদার যথাযথ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের (২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) একজন প্রেরণাদায়ক ব্যক্তি রূপে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি গান রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলবনা’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি', ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল’, ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা'য় গোবিন্দ হালদার লিখেছেন:
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে,
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলবনা।
দু:সহ বেদনার কন্টক পথ বেয়ে
শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা
আমরা তোমাদের ভূলব না।।
যুগের এ নিষ্ঠুর বন্ধন হতে
মুক্তির এ বারতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না।।
কিষাণ কিষাণীর গানে গানে,
পদ্মা, মেঘনার কলতানে,
বাউলের একতারাতে আনন্দ ঝঙ্কারে
তোমাদের নাম ঝংকৃত হবে।
নতুন স্বদেশ গড়ার পথে
তোমরা চিরদিন দিশারী রবে
আমরা তোমাদের ভুলব না।।
একইভাবে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’ গানটিও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যুগিয়েছিল। অন্যদিকে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল’ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামী শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতো। এই গানটিতে তিনি লিখেছিলেন:
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল,
জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল ।।
বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল
হয়েছে কাল হয়েছে কাল হয়েছে কাল
জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল।
শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে
অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাস।।
রক্তে আগুন প্রতিরোধ করে
নয়া বাংলার নয়া সকাল নয়া সকাল নয়া সকাল।
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে।।
আর দেরি নয় উড়াও নিশান
রক্তে বাজুক প্রলয় বিষাণ ।।
বিদ্যুৎ গতি হোক অভিযান
ছিঁড়ে ফেলো সব শত্রু জাল শত্রু জাল, শত্রু জাল।
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে।
‘জয়বাংলার গান’ রূপে পরিচিত গোবিন্দ হালদারের সঙ্গীতগুলো 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' থেকে প্রচারিত হত। এই রেডিও স্টেশনটির নিয়ম অনুসারে কোনও বিদেশীকে এর জন্য গান রচনা করতে দেওয়া হত না। সুতরাং গোবিন্দ হালদারের নামটিও এই গানগুলির গীতিকার রূপে প্রথমদিকে প্রচারিত হয়নি । যাইহোক, ১৯৭২ সালে গোবিন্দ হালদার ঢাকা পরিদর্শনে গেলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অধিকর্তা তাঁকে উল্লিখিত গানগুলোর গীতকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে, বাংলাদেশ সরকার তাঁর অবদানের জন্য গোবিন্দ হালদারকে ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’ রূপে সম্মানিত করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতকালে বলেছিলেন: ‘আপনি বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু। আপনি অনেক গান লিখেছেন, আপনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। আপনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দুর্দান্ত ভূমিকা রেখেছিলেন।’
গোবিন্দ হালদার মারা যাওয়ার পরে (১৭ জানুয়ারি ২০১৫), বাংলাদেশ সরকার তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বাংলাদেশের সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে একটি শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি যথাযথভাবে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় গোবিন্দ হালদার রচিত গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে, জাতি একজন প্রকৃত বন্ধুকে হারিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সর্বদা তাঁকে স্মরণ করবেন।’
তবে বাংলাদেশের জনস্মৃতিতে গোবিন্দ হালদারের উপস্থিতি ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। যদিও 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে,বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা'-এর মতো তাঁর রচনা বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়, তথাপি বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের এই গানটির রচয়িতা সম্পর্কে প্রায় সম্পুর্ণ নীরব।
একইসঙ্গে এটাও দুর্ভাগ্যজনক যে, কলকাতার মানুষও গোবিন্দ হালদারকে পুরোপুরি ভুলতে বসেছেন।
লেখক: ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক।