এই ‘শঙ্খনীল কারাগারে’ এখনও আমরা যাকে খুঁজে ফিরি

  • অসীম নন্দন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গ্রাফিক্স: নাছরিন আক্তার উর্মি

গ্রাফিক্স: নাছরিন আক্তার উর্মি

একজন গল্পের চরিত্রের ফাঁসির আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করতে জনগণ রাস্তায় নেমেছে। মিছিল করে গল্পের চরিত্রের মৃত্যু ঠেকাতে চাওয়ার মতন ঘটনা কি আরো ঘটেছে? না, ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা। মিছিল করে কি লেখকের গল্পের পরিণতি ঠেকানো যায়? জীবনের নিয়তি যেমন ঠেকানো যায় না, ঠিক তেমনি গল্পের নিয়তিও ঠেকানো অসম্ভব। কখনো কখনো তো লেখক নিজেও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের নিয়তি পরিবর্তন করতে পারে না। তাই বাকের ভাইকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছিল। তাঁর নিয়তি খন্ডন করা যায় নাই। হ্যাঁ, আমি 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের বাকের ভাইয়ের কথাই বলছি। নব্বইয়ের দশকের সেই আইকনিক চরিত্র; যার ফ্যাশন, স্টাইল এবং চরিত্রে মুগ্ধ হয়েছিল বাঙলার তরুণ সমাজ।

আজ সেই আইকনিক চরিত্রের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদের ৭৩ তম জন্মদিন। বাংলা ভাষাভাষী কথাসাহিত্যে তিনি একজন প্রবাদ-পুরুষ। তাঁর লেখা বই প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম্যবধূর কাছেও পৌঁছে গিয়েছে। যে বধূ হয়তো দুপুরের সব কাজ সেরে বিকেলবেলাটায় হুমায়ূন আহমেদের লেখা কোনো গল্পের বইয়ে অবসর খুঁজে পায়। এখনও বইমেলাগুলোতে তাঁর লেখা বইগুলোই বেশি বিক্রি হয়। পাঠকেরা ভিড় করে সেই সব প্রকাশনা'র সামনে, যাদের কাছে হুমায়ূন আহমেদের বই আছে। কোনো কোনো পাঠক হয়তো এখনও তাঁর একটা অটোগ্রাফের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু তিনি তো এই শঙ্খনীল কারাগার থেকে চলে গেছেন অনেক অনেক দূরের কোনো দেশে। যে দেশের ভাষা আমরা জানি না।

বিজ্ঞাপন

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'নন্দিত নরকে'। প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। যে গল্পে তিনি এঁকেছেন একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ-দুঃখ-হাসি-কান্নার ছবি। যে গল্পে ফুটে উঠেছে মধ্যবিত্ত পরিবারের টিকে থাকার লড়াইয়ের গল্প। যদিও 'নন্দিত নরকে' প্রথম প্রকাশিত বই, তবে লেখকের প্রথম লেখা উপন্যাস ছিল 'শঙ্খনীল কারাগার'। ১৯৭৩ সালে এই বইটি প্রকাশিত হয়। বই দুইটার চরিত্রের নামগুলো যদিও অভিন্ন, তবে গল্পের ট্রাজেডি ভিন্ন। হুমায়ূন আহমেদের লেখা এই উপন্যাস দুইটা ক্লাসিকের পর্যায়ে চলে গেছে। তাঁর লেখা অন্যতম মাস্টারপিস বই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা 'জোছনা ও জননীর গল্প'।

হুমায়ূন আহমেদ, যিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা। যিনি শিল্পের যে শাখাতেই হাত দিয়েছেন, সেই শাখাতেই ফলিয়েছেন সোনা। তিনি বাংলা সাহিত্যে সংলাপধর্মী কথাসাহিত্যের জনক। সহজ সরল ভাষায় পাঠকের হৃদয়ের মনিকোঠায় তিনি পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট অমর চরিত্র হিমু এবং মিসির আলী'র গল্পে গল্পে পাঠককে বারবার তিনি বিভ্রান্ত করেছেন। আরেক অমর চরিত্র শুভ্র'র মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষের ছবি এঁকেছেন। যে শুভ্র হাই-মাইওপিয়া রোগে আক্রান্ত। যে শুভ্র চশমা ছাড়া চোখে দেখে না। সেই দুর্বল চোখে হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন পৃথিবীর শুদ্ধতাকে।

বিজ্ঞাপন

কথাসাহিত্যের সংলাপধর্মী বৈশিষ্ট্যকে বলা যায় হুমায়ূন আহমেদের একই সাথে শক্তি এবং দূর্বলতার জায়গা। সমালোচকদের মতে, কথাসাহিত্য আরো বেশি বর্ণনার দাবি রাখে। অথচ হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখায় অনেক বেশি সংলাপ ব্যবহার করে কথাসাহিত্যের সেই বর্ণনাধর্মী বৈশিষ্ট্যকে উপেক্ষা করেছেন। যে কারণে সমালোচকরা বলে থাকেন, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়েছেন।

তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্র হিমু; যে চরিত্র খুব সহজেই তরুণ পাঠকদের আকর্ষন করে। অথচ হিমু চরিত্রের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হচ্ছে এই চরিত্র অতিমাত্রায় খামখেয়ালি, বাস্তবতাহীন এবং বিভ্রান্তিকর। সমালোচকদের মতে সংলাপধর্মী লেখার কারণে তিনি যেমন সহজেই নতুন পাঠকদের আকর্ষন করেছেন, ঠিক একইভাবে পাঠকদের ক্ষতির মুখেও ফেলেছেন। কেননা বহুসংখ্যক নতুন পাঠকই সংলাপধর্মী সহজ-সরল গদ্য পাঠের পর বর্ণণাধর্মী গদ্যের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে। যার ফলে হুমায়ূন আহমেদের নতুন পাঠক হয়তো সৃষ্টি হয় ঠিকই, কিন্তু সেই পাঠক অন্যান্য মহান সাহিত্য পাঠের প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করে। যা সত্যিকার অর্থেই সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর।

সমালোচকরা বলে থাকেন, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দিককার লেখাগুলো বেশ খানিকটা সাহিত্যগুণসম্পন্ন থাকলেও, জনপ্রিয় হয়ে উঠার পরের দিককার লেখাগুলো আর তেমন সাহিত্যগুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে নাই। হুমায়ূন আহমেদের রাজনীতি-সচেতনতা নিয়েও সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলে থাকেন।

হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্টি করে গেছেন জনপ্রিয় অসংখ্য নাটক। জনপ্রিয় নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে 'আজ রবিবার', 'বহুব্রীহি', 'নক্ষত্রের রাত' ইত্যাদি। তবে এখানে 'পুষ্পকথা' নাটকের কথা উল্লেখ না করলে হয়তো এই এত এত কথা বলাটা বৃথা হয়ে যাবে। তিনি এই নাটকে সকল নেগেটিভ চরিত্রের মাথার ভিতর পোকা ঢুকিয়ে দেন। যে পোকা সেই খারাপ মানুষটাকে ভালো হতে বাধ্য করে। এই যে হাস্য-পরিহাসের মাধ্যমে প্রতীকীভাবে তিনি পুষ্পের পোকা'র চরিত্রকে সৃষ্টি করেছেন তা তো আসলে মানুষেরই বিবেক। মানুষের বিবেকের চেয়ে বড় কোনো আদালত তো এই পৃথিবীতে নাই।

যাই হোক, হুমায়ূন আহমেদ চলে যাবার পর এখনও একটা দশক পুরো শেষ হয়নি। তিনি এখনও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন। আর আগামী দিনের সময়ই বলে দেবে কতদিন পর্যন্ত তিনি বাংলাসাহিত্যে প্রাসঙ্গিক থাকতে পারবেন। সাহিত্যে কতদিন প্রাসঙ্গিক থাকবেন তা বলা না গেলেও বাংলা-নাটকের জন্য তিনি হয়তো বহুকাল প্রাসঙ্গিক থেকে যাবেন।

তবু এ কথা অনস্বীকার্য, হুমায়ূনের মৃত্যুর শূন্যতা কাটিয়ে বাংলা সাহিত্য-নাটক এখনও আপন ছন্দে ফিরতে পারেনি। তার জন্য জমে থাকা সেই প্রেম, সেই মোহগ্রস্ত পাঠ এখনও অন্য কারো জন্য হয়তো তৈরি হয়ে ওঠেনি। মানুষকে বদলে দেয়ার সুক্ষ সেই কারুকাজ, সাধারণের মনকে বদলে দেয়ার, প্রভাবিত করার সেই জাদুকরী ক্ষমতা নিয়ে এখনও হয়তো কেউ আসেনি তারপর। কথার সেই জাদুকরের প্রস্থান এখনও বাঙালির জন্য হাহাকারের কারণ।

জাগতিক সংকট ও জটিলতাগুলোকে সহজ করে দেখাবার মানুষটা নেই। কিন্তু আমরা জানি তিনি এসেছিলেন, ছিলেন আমাদের মাঝেই, এই শঙ্খনীল কারাগারে আমরা এখনও আপনাকে খুঁজে ফিরি।