মাহফুজ পারভেজের গুচ্ছ কবিতা
১.
পদক্ষেপ
পদক্ষেপ দীর্ঘ হতে হতে দীর্ঘতম পথ হয়ে যায়।
পথে:
বিদীর্ণ আয়না
হাফটোন ছবি
নিজের ছায়ারা
কুয়াশা ভেজা শীত রাত
নিঃসঙ্গ আকাশ
মায়া পিছু পিছু আসে অনেকটা পথ।
পদক্ষেপ স্মৃতির পথে মায়ায় প্রলম্বিত!
যত মোলায়েম ও মসৃণ হচ্ছে
এই ডিজিটাল যাপন, বিপণন ও ব্যবস্থাপনা ততই ছিঁড়ে যাচ্ছে
মানুষে মানুষে মুখোমুখি সংযোগের সুতো:
রয়েছে পথ ও এলোমেলো পদক্ষেপ কেবলি!
২.
মুঠোফোন
গোটা দিন
দিনের পর দিন
কাটছে এই জগতের অংশীদার হয়ে।
আর আমি, আমরা
মুঠোফোন-সর্বস্ব হচ্ছি।
এক অদ্ভুত আকর্ষণে
অজানতেই চোখ আঙুল মন চলে যাচ্ছে
সেই দূরবর্তী দুনিয়ার টানে।
মুঠোফোন-মনা মানুষের অস্তিত্ব ও সত্তা
নির্ধারণ করছে অফুরন্ত কনটেন্ট
অগুনতি আপডেট
ডিজিটাল যোগাযোগ
মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন হলেই মন আনচান
এই বুঝি কিছু ফস্কে গেল:
তীব্র এক অস্থিরতা ও উদ্বেগ
যদি বাদ পড়ে যাই
যদি চোখ এড়িয়ে যায় কিছু!
প্রযুক্তির থেকে আজ এতই বেশি চাইছি
সামনের রক্তমাংসের মানুষটার থেকেও তত নয়!
অহরহ নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে আছি
মানুষে মানুষে গভীরতম দূরত্বে!
পাশে-বসা অপরিচিতার সঙ্গে
এ কথা-সে কথায় না গিয়ে
ডুবে আছি ডেটিং অ্যাপের ভার্চুয়াল বাছাইয়ে পাশের সিটের লোকটির সঙ্গে আলাপে না গিয়ে বরং দেখে নিচ্ছি স্টেটাস আপডেটে
ক’জনের চোখে পড়ল
ক’টা লাইক বাড়ল
কে কী লিখলেন?
ব্যাঙ্কের কর্মী
পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান
পাড়ার মুদি
মাছওয়ালা
সেলুনের নাপিত
ট্যাক্সিচালক
এগরোলের দোকানের ছোকরা
আরও বহু মানুষের থেকে দূরে চলে যাচ্ছি আদানপ্রদান আজ মানবশূন্য
অনলাইন-প্রক্রিয়ায় বা অ্যাপ-মারফত
কোনও অচেনা ব্যক্তির দ্বারা
যাকে বা যাদের চেনার বা জানার
কোনও আগ্রহ বা প্রয়োজন নেই আমাদের
আমাদের মুঠোফোন আছে
আমরা মুঠোফোন-সর্বস্ব আছি
একাকীত্বে সবার সাথে
অন্তর্জগতের কুহক মায়ায়।
৩.
কাটআউট
মাতিসের পেপার কাটিং জগদ্বিখ্যাত
আসলে তা কাটআউট চিত্র এবং দ্বিমাত্রিক।
কাগজ, বোর্ড বা ওই জাতীয় দ্বিমাত্রিক
যে কোনও মাধ্যম হতে পারে শিল্পীর আশ্রয়
‘এসেনশিয়াল ফর্ম’।
একটি কাটআউট চিত্র
তার মাধ্যম ও বর্ণসমূহ
একটি পরিপূর্ণ পেন্টিং
তথাপি বিস্তর ফারাক।
শিল্পের পরিসরে ভাবনার সঙ্গে মনের মিলন:
কাটআউটের অপরিহার্য দৃশ্যরূপ।
৪.
নবান্ন
ধানেরগুঁড়ো খড়বিচুলির কুচো উড়ছে চারপাশে
তারই সোনা-ঘষা রঙে মাখামাখি ঘর-বাড়ি-রাস্তা-বাজার
দু’পাশে গোল, চতুষ্কোণ মরাই আর পালুইয়ের মধ্যে দিয়ে
হেঁটে যাওয়ার সময় কানে দলে দলে চড়াই, পায়রার শোরগোল
খড়ের তৈরি বিনুনি-দড়িতে বাঁধা খড়েরই দেওয়ালের বিশাল আকারের কুয়োর মতো আধার মরাই
ধান ঝেড়ে নেওয়ার পর পড়ে থাকা গাছ
যা গুছিয়ে আঁটি বেঁধে ছোট ছোট টিলার মতো
তৈরি করা হয়েছে, তা পালুই
প্রায় সব বাড়িরই আশপাশে সর্বত্র হয় মরাই নয়তো পালুই
ধানের মরাই হল গোলা আর খড়ের পালুই গাদা
অঘ্রানের বসন্তে রঙিন গ্রামবাংলায়
চোখ-ধাঁধানো সাজ এখন অচেনা লাগে
ধানটা ভাল হলে আগত বসন্তের রঙে
চোখে ঘোর-লাগা সুখি মানুষেরা অপসৃত।
শীতের ঝিম-ধরা দুপুরে ঘোর ভাঙল মোবাইল রিংটোনে
স্ক্রিনে নবান্নের নিথর ওয়ালপেপার শব্দহীন।
৫.
দুর্গ
স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো ছাড়া দুর্গের বাকি অংশ ফাঁকা নৈঃশব্দ্য
যুদ্ধের ঝনাৎ সবুজ ঘাসে মোড়া
লোহার রেলিং পর্যটকের হাতের মুঠোয়।
দুর্গ দেখছি আর ভাবছি
অতীতেও কি এরকমই ছিল?
নাকি ধ্বংস হতে হতে টিকে আছে এইটুকুই
দুর্গের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখার নিরাপদ জায়গা
দুর্গকে বেষ্টন করে রাখা পরিখা
বিভিন্ন স্তরে প্রাচীর
গোপনে পালিয়ে যাওয়ার পথ
কোনও কিছুই তো বিদ্যমান নেই আর!
দুর্গের টিকে থাকা স্থাপত্যের কোথায় যেন দুর্গ থেকেও দুর্গ নেই।
শুধু একটি কক্ষের চারিদিকে নিস্তব্ধতা
কেউ কোথাও নেই
দূরে, বহু দূরে দুর্গের বর্তমান রক্ষী
ইতিহাস ফিসফিস করে কথা বলতে চায়
কান পেতে শুনি
শুনতে পাই আজানের ধ্বনি
আরও একটু পিছিয়ে যাই
কানে আসে শিবপুজোর মন্ত্র
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে
ছায়াগুলো হয় দীর্ঘায়িত
অস্তরাগের ছটায় রক্তিম হয় মাঁকড় পাথরের সৌধ
বাঁশি বেজে ওঠে রক্ষীর
ঘরে ফেরার তাড়া তার
ফিরতে হবে আমাকেও।