পূর্ববঙ্গের সংবাদপত্রে ইত্তেহাদের ছায়া ও আবুল মনসুর আহমদ



ড. কাজল রশীদ শাহীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

(পূর্বপ্রকাশের পর) আবুল মনসুর আহমদের সক্রিয় ও পেশাদার সাংবাদিকতা জীবনের চতুর্থ ও শেষ অধ্যায়ের শুরু ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে। এক হাজার টাকা বেতনে ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে নেন। এখানকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘আমার গোটা সাংবাদিক জীবনের মধ্যে এইটাই আমার সবচেয়ে সুখ, আরাম ও মর্যাদার মুদ্দত ছিল। বরাবরের মতো পূর্ণ সাংবাদিক স্বাধীনতা এখানে ছিলই, তাঁর উপর ছিল অর্থ-চিন্তার অভাব এবং নবাবযাদা ও ফারুকুল ইসলামের সুষ্ঠু পরিচালনা।’

লক্ষণীয়, আবুল মনসুর আহমদ যেন গল্পের সেই পরশ পাথর যার স্পর্শে সকলেই কেবল সোনা হয়ে ওঠে। তাঁর সাংবাদিকতা ও সম্পাদক জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মিলবে তারই প্রামাণ। তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন, শুরুর সেই ‘ছোলতান’, ‘মোহাম্মদী’, ‘দি মুসলমান’, ‘খাদেম’ থেকে ‘কৃষক’ ও ‘নবযুগ’ অবধি সর্বত্রই তিনি সোনা ফলিয়েছেন। হয়েছেন প্রশংসিত। শ্রম-নিষ্ঠা-মেধা ও দায়িত্বশীলতা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন কর্তৃপক্ষকে। চিত্ত জয় করেছেন পাঠকের। ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে হয়েছেন জয়ী। বিনিয়োগ বিচারে, সুযোগ-সুবিধার মানদণ্ডে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় নিজের প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তারপরও উনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন, সহ-সম্পাদক হিসেবে একবার এবং সম্পাদক (প্রধান সম্পাদক ও শ্যাডো এডিটর) হিসেবে দুইবার। এ কি অমোঘ নিয়তি! নাকি জীবন ঘষে ’আগুন’ হয়ে ওঠার শিক্ষা?

রবীন্দ্রনাথ যে ‘আগুন’কে ‘পরশমণি’ সম্বোধন করে বলেছেন, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। আবুল মনসুর আহমদের জীবন, কর্ম, সাধনা, লক্ষ্য ও অভিপ্রায় ছিল সত্যি সত্যিই ‘আগুনের পরশমণি’ তুল্য। যার ছোঁয়ায় আলোকিত হওয়ার অপার সুযোগ রয়েছে সকল প্রজন্মের। তিনি চাকরি করেছেন সাতটি প্রতিষ্ঠানে, তিনটার অভিজ্ঞতা মন্দ ও গভীরতর বেদনার। এইসব হতাশা, অপমান, অন্যায়-অবিচারে তিনি ভেঙ্গে পড়েননি, নিজেকে গুটিয়ে নেননি, অবশ্য এটা উনার স্বভাবের মধ্যেও পড়ে না। কারণ ওইসব চাকরিচ্যুতি, বরখাস্তের যৌক্তিক কোনো কারণ ছিল না। উনার অযোগ্যতা-অপারগতাও এতে প্রমাণিত হয় না। উল্টো তাঁর সাংবাদিকতা-সম্পাদক জীবনের চারটা পর্যায়ের প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তিনি নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করেছেন এবং সাংবাদিকতার কৌলিন্য বজায় রেখে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। নিজের প্রতি পূর্ণ আস্থা বা বিশ্বাস না থাকলে এই দুর্লভ গুণ অর্জন করা যায় না। আবুল মনসুর আহমদের এই কর্মনিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠান প্রেম, ও সাংবাদিক-মানস থেকে যথার্থ-যুক্তি ও প্রয়োজনীয় বার্তা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক-সম্পাদকদের।

মোহাম্মদী, কৃষক ও নবযুগে যেভাবে চাকরি হারান আবুল মনসুর আহমদ

ইত্তেহাদ ছিল আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল এক অধ্যায়। পূর্বের প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা, নিরলস পাঠ, গবেষক-মানস, দূরদর্শী দৃষ্টি, ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সক্ষমতা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন এখানে। এককথায় আবুল মনসুর আহমদ যাকে বলেছেন ‘সাংবাদিক চেতনা।’ তিনি সাংবাদিকতা ও সম্পাদকের দায়িত্বকে নিয়েছিলেন সাধনা হিসেবে। যেখানে মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্রের কল্যাণই ছিল মুখ্য। সাংবাদিকতা-সম্পাদকের দায়িত্বকে ব্রতরূপে, পবিত্র জ্ঞানে সর্বোচ্চ নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। যে দায়িত্ববোধের মধ্যে দিয়ে তিনি নাগরিক সমাজ, মানবতাবাদ ও বাক স্বাধীনতার প্রশ্নকে সমুন্নত করতে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে গেছেন। যা বাংলা সংবাদপত্র ও বাঙালি মুসলমানের সাংবাদিকতাকে যেমন করেছে উচ্চকিত, তেমনি তাঁকে দিয়েছে বাংলাদেশের নবজাগরণের দার্শনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার মহিমা ও মর্যাদা।
আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের কারণেই ইত্তেহাদ স্বল্প সময়ের মধ্যে পাঠকপ্রিয় পত্রিকায় পরিণত হয়। এর নেপথ্যের যৌক্তিক কারণ কী ছিল, সেকথা উল্লেখ করেছেন, ‘আত্মকথা’য়। তিনি লিখেছেন, ‘‘ইত্তেহাদ’ অল্পদিনেই খুব জনপ্রিয় হইয়া উঠে। ইহার প্রচার সংখ্যা অনেক-পুরাতন দৈনিকের দুই তিন গুণ হইয়া যায়। প্রায় পঁচিশ বছর সাংবাদিকতার সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিয়া এবং এ সম্পর্কে বিদেশি বই পুস্তক ও সংবাদপত্র পড়িয়া সাংবাদিকের দায়িত্ব সম্পর্কে আমার সামান্য যা কিছু জ্ঞান লাভ হইয়াছিল, তার সবটুকু ‘ইত্তেহাদে’ প্রয়োগ করিবার চেষ্টা আমি করিয়াছিলাম।’’

দৈনিক পত্রিকা ‘ইত্তেহাদ’ সত্যিকারার্থে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা তথা সম্পাদক জীবনকে পূর্ণতা দান করে। কিন্তু সেটাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এর মধ্যে অখণ্ড ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক দেশের জন্ম হয়। উপনিবেশ গুটিয়ে নিয়ে ইংরেজরা ইংল্যান্ডে ফিরে যায়। ইত্তেহাদ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও তার পাঠক ছিল মূলত পূর্ববঙ্গের মানুষ। সে কারণে ইত্তেহাদকে বারংবার স্বাধীন পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অফিসের জন্য একটু জায়গা দেওয়া হয়নি। এমনকি পূর্ববঙ্গে প্রবেশাধিকারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। নাজিমউদ্দীন সরকারের রোষানলে ইত্তেহাদের প্রকাশ হুমকির মুখে পড়ে। নানামুখী সংকট-বৈরিতা ও বাধায় ইত্তেহাদের অকাল মৃত্যু হয় ১৯৫০ সালের গোড়ায়। যার মধ্যে দিয়ে আবুল মনসুর আহমদের সক্রিয় সাংবাদিকতা তথা সম্পাদক জীবনেরও ঘটে যবনিকাপাত।

পরবর্তী দুই যুগ তিনি একজন কলাম লেখক হিসেবে সাংবাদিকসত্তাকে সচল ও অর্থবহ করে রাখেন। ইত্তেহাদ পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি না পেলেও পূর্ব পাকিস্তানে বিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশকে যে সাংবাদিকতার চর্চা শুরু হয় তাতে এর প্রভাব রোধ করা যায়নি। ইত্তেহাদের দেখানো পথেই সকলে হেঁটেছেন। সমৃদ্ধ সব পত্রিকার নামকরণ থেকে শুরু করে এর পরিচালন কৌশল, উন্নয়ন পরিকল্পনা, অঙ্গসজ্জা, বিভাগ-বিন্যাস, ভাষার প্রয়োগ, সম্পাদকীয় নীতি নির্ধারণ, পত্রিকার কাগজ ও আঙ্গিক, প্রকাশনা ও বিতরণ ব্যবস্থা সর্বত্র ইত্তেহাদের ছায়া এসে পড়ে।

একটা মানসম্পন্ন, প্রভাবশালী, পাঠকপ্রিয় ও ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক পত্রিকার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী কী হওয়া উচিৎ তার মানদণ্ড ও চর্চার যে নমুনা হাজির করেছিল ইত্তেহাদ তার অনুশীলন ও অনুসরণ জারি আছে আজ অবধি। এবং এসবের মধ্যেই নীরবে-নিভৃতে দেদীপ্যমান রয়েছে বলিষ্ঠ সাংবাদিক ও যশস্বী সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের প্রাসঙ্গিকতা। তিনি মনে করতেন একটা পত্রিকা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অন্যতম শর্ত হল,

এক. জনপ্রিয় রাজনৈতিক মতবাদের সমর্থন।

দুই. সু-সম্পাদন।

তিন. সুন্দর ছাপা ও ভালো মানের কাগজের নিয়মিত যোগান নিশ্চিত করা।

চার. সর্বাধিক পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য সাইজে কাগজ প্রকাশ।

পাঁচ. নিয়মিত প্রকাশ ও সময়মতো সুষ্ঠু সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।

এতো গেল সাংবাদিকতা নিয়ে তাঁর বহিরঙ্গের ভাবনা। একইভাবে তিনি অভ্যন্তরীণ ভাবনার কথাও বলেছেন। অভ্যন্তরীণ ভাবনার সাত দফাকে তিনি সাংবাদিকতার ক, খ জ্ঞান করেছেন। এগুলো হল:

১. সাংবাদিকতা নিছক সংবাদ সরবরাহ নয়, সংবাদের সুষ্ঠু ব্যাখ্যাও বটে।

২. সাংবাদিকতার সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাজনীতিতে পার্টি-গত শ্রেণি-গত মতভেদ অপরিহার্য। কিন্তু এই মতভেদ সত্ত্বেও সাধু সাংবাদিকতা সম্ভব।

৩. বিরুদ্ধ পক্ষকে অভদ্র কটূক্তি না করিয়াও তাঁর তীব্র সমালোচনা করা যাইতে পারে ভদ্র ভাষায়। বস্তুত সমালোচনার ভাষা যত বেশি ভদ্র হইবে, সমালোচনা তত তীক্ষ্ণ ও ফলবতী হইবে।

৪. প্রত্যেক মতবাদের সুষ্ঠু, উদার, বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ আলোচনার দ্বারা নিজের মতের পক্ষে এবং বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে জনমত তৈয়ার করা অধিকতর সহজসাধ্য।

৫. মরহুম মৌলবি মুজিবর রহমান বলিতেন: সংবাদ-পত্রের কেবলমাত্র সম্পাদকীয় কলমটাই সম্পাদকের; বাকি সবটুকু পাবলিকের। চিঠি-পত্র কলমটা টাউন হল, সম্পাদকের বৈঠকখানা নয় অতএব সংবাদ প্রকাশে নিরপেক্ষতা চাই। স্বয়ং সম্পাদকের নিন্দা-পূর্ণ পত্রও চিঠি-পত্র কলমে ছাপিতে হইবে।

৬. সাংবাদিকতা সাহিত্য, আর্ট, সায়েন্স, ইন্ডাস্ট্রি ও কমার্সের সমবায়। এর একটার অভাব হইলে সাংবাদিকতা ত্রুটিপূর্ণ এবং পরিণামে নিষ্ফল হইবে।

৭. বিখ্যাত সাহিত্যিক থেচারে বলিয়াছেন, ‘‘ছাপার মেশিনের মতো সংবাদপত্র নিজেও একটা ইঞ্জিন। সকল যন্ত্রপাতির ঐক্য ও সংহতি অন্যান্য ইঞ্জিনের মতো প্রেস ইঞ্জিনেরও অত্যাবশ্যক বটে, কিন্তু তার উপরেও প্রেস ইঞ্জিনে দরকার ‘ইনটেলেকচুয়াল ইউনিটি’।’’

সাংবাদিকতায় শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদ: নবযুগ এনেছিলেন যিনি

একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই সময়ে এসেও যদি কেউ একটা জনপ্রিয় ও লাভজনক পত্রিকা করতে চান এবং সংবাদপত্রকে প্রতিষ্ঠান ও ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ার অভিপ্রায় রাখেন উপরোক্ত এই শর্ত পূরণ ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। সুতরাং এই পাঁচ/সাত দফাকে আমরা একটা পত্রিকার প্রাণ-ভোমরা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সময়ের পরিক্রমায় ও প্রযুক্তির বিকাশের কারণে এর সঙ্গে হয়তো আরও নতুন বিষয় যুক্ত হতে পারে, কিন্তু তাঁর এই পাঁচ/সাতদফাকে উপেক্ষা করা প্রায় অসম্ভব।

সংবাদপত্র একটা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং এখানে যা কিছুই উৎপাদিত কিংবা সংঘটিত হোক তার সবটাতেই বুদ্ধির ছাপ ও চর্চা থাকা জরুরি। এর চর্চা ব্যতীত কোনো সংবাদপত্রই সমাজ-রাষ্ট্রে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সমাদৃত হয়ে উঠতে পারে না। একারণে আবুল মনসুর আহমদ যে ‘ইন্টেলেকচুয়াল ইউনিটি’র কথা বলেছেন সেটা একটা সংবাদপত্রের জন্য ‘চাবিকাঠি’ বিশেষ। যা তাঁর কালে সত্য ছিল, আজও সত্য রয়েছে, আগামীদিনের সাংবাদিকদের জন্যও সত্য হিসেবে থেকে যাবে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশের নবজাগরণ, বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাঙালি মুসলমানের বিকাশের পরম্পরা ও বাঁক বদলের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও চেতনাকে বুঝতে হলে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা-সম্পাদকতা ও কলাম লেখক ভূমিকা সম্পর্কে পঠন-পাঠন ও গবেষণা জরুরি। ২০২৩ সালে এসে আমরা যদি আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা জীবনের শতবর্ষের প্রতি চোখ রাখি, তাহলে এই প্রজন্মের একজন সাংবাদিক-সম্পাদক হিসেবে কেবল বিস্ময় উদ্রেক করে না, ভক্তি ও শ্রদ্ধাও জাগ্রত হয়।

শ্রেণিকক্ষে যা মেলার নয়, বিদ্যায়তনিক পুস্তকরাজিতেও যা অনুপস্থিত, তাই রয়েছে তাঁর সাংবাদিকতা-সম্পাদক জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। যা সদর্থক অর্থেই আগুনের পরশমণি তুল্য। যার পরশে দীক্ষিত হলে আজকের প্রজন্মের একজন সাংবাদিক-সম্পাদকেরও সুযোগ রয়েছে নিজের প্রতিভা ও অভিপ্রায়কে বিকশিত করে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছবার। আর এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে আবুল মনসুর আহমদের শতবর্ষী সংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা। (সমাপ্ত)

কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক
[email protected]

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;