কোলাজ মন্তাজ
সৃষ্টিশীলদের বন্ধুত্ব ও বিবাদ
আমার কাছে এখনো জগতের সেরা বন্ধু কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। তাদের বন্ধুত্বের বড় কারণ মনে হয় দুজনেই জগতের সব মেহনতি মানুষের শোষণ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। তাদের বন্ধুত্বের বড় ভিত্তি বৃহত্তর। শুধু ‘আমি কেন্দ্রিক’ না।
কিন্তু বন্ধুত্ব নিয়ে আপনার কী ভাবেন? যেমন ধরুন একটা উদাহরণ দিই—
বন্ধু কে ?
অসুস্থ মানুষ ও চিকিৎসক বন্ধু।
কেন?
অসুখ।
কেন? অসুখ কেন হবে বন্ধুত্বের সেতু?
কারণ, বিপদে বন্ধুর পরিচয়। রোগীকে রোগমুক্ত করেন ডাক্তার। তাই।
তাহলে অসুখ মানে খারাপ। বিপদ। বিপদ দিয়ে শুরু হয় বন্ধুত্ব?
সে তো বটেই।
তবে স্বাস্থ্য কী?
স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য যা কিছু উপকারী সেও বন্ধু।
স্বাস্থ্য ভালো রাখে সুইমিং, জগিং, অষুধ । সেসবও তবে বন্ধু?
কেন নয়? তারাও বন্ধু।
কিন্তু তারা কি আমার প্রাণের ভাষা বুঝবে?
না বুঝলে বিপদে তাদেরই লাগে কেন?
তাহলে আমার স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে তবে তো সুইমিং, জগিং, অষুধ বা অসুখ বন্ধু নয়?
না তখন অসুখ তোমার এনিমি। তোমার বন্ধু স্বাস্থ্য।
এরমানে বন্ধুত্বও পরিবর্তনশীল?
অবশ্যই।
এতটুকু পড়ে কী মনে হচ্ছে আপনার? বন্ধুত্ব আসলে কী? উপরের যে কথাগুলো পড়লেন সেসব আমার না। এরকম ডায়লগের ভেতর দিয়ে উত্তর খুঁজেছিলেন ফিলোসফার প্লেটো। বইটির নাম, ‘ক্রাইসিস অব ফ্রেন্ডশিপ’। লেখা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে। তবে কার্ল মার্কস এমন বন্ধুত্বের বাহাসে আস্থা রাখতেন না। তিনি ‘এথনোলজিক্যাল নোটবুক’-এ ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের মতো মতাদর্শিক বন্ধু না পেলে শ্রেণীসংগ্রামের লড়াইয়ের পথ খুঁজে পেতে কষ্ট হতো বলে স্বীকার করেছেন।
ফের ঝামেলা দেখা দিল, লক্ষ করুন। মতাদর্শ মালটা আবার কী? মানে ইজম মানেই তো কারাগার। এখন একই কারাগারের বাসিন্দা হয়ে বন্ধু হলে তো সে বড় সীমাবদ্ধ। আপনি অন্য কারাগারের বাসিন্দাদের বন্ধু করতে রাজি নন। বন্ধুত্বের দরজা আটকিয়ে দিলেন—এ হয় কিছু?
ব্রার্টান্ড রাসেলের মত ছিল এমন—“সব মতাদর্শই একেকটি কারাগার। তাই মতাদর্শিক বন্ধুত্ব কোনো বন্ধুত্বই না।” এসব তর্ক শেষ হবার নয়। তবু বন্ধুত্ব হয়। কখনো আজীবনের জন্য স্থায়ী হয়। কখনো বন্ধু শক্রুতে পরিণত হন। বন্ধুত্বের দুটি তত্ত্ব আছে। একটি হলো, উপযোগিতাভিত্তিক অন্যটি আনন্দভিত্তিক। আমার ধারণা উপযোগিতাভিত্তিক বন্ধুত্বই ছিল কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের মধ্যে। আর আনন্দভিত্তিক বন্ধুত্ব ছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও গারট্রুড স্টেইনের মধ্যে। ১৯২০-এর দশকে প্যারিসে গারট্রুড স্টেইন ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’। হেমিংওয়ে দম্পতিকে প্রবাসজীবনে অনেক সাহায্য করেছেন গারট্রুড স্টেইন। কারণ নিছকই হেমিংওয়ের সঙ্গতা তিনি উপভোগ করেন। ১৯২৪ সালে হেমিংওয়ে বিয়ে করবেন তখন তিনি গারট্রুড ও তাঁর নারীসঙ্গী এলিস টোকলাসকে তাঁর ‘গডপ্যারেন্টস’ হতে বলেন। তাঁরা সানন্দে রাজি হন। লেসবিয়ান গারট্রুড স্টেইন ছিলেন প্যারিসের সবচেয়ে পরিচিত বিত্তশালী নারী। তিনি পরে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, “হেমিংওয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিছক আনন্দের জন্যে। আমাদের মধ্যে অনেক অমিল ছিল। যেমন আমি সমকামী। আর সে সমকামিতা পছন্দই করত না।”
নারী সমকামী বন্ধুর কথা যখন এসেই গেল তখন সমকামী বিট প্রজন্মের দুই প্রধান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ও জ্যাক ক্যারুয়াকের কথা বলি। এখানে বলে রাখি গিন্সবার্গ যদিও পরে তার পুরুষ সঙ্গী অরলভস্কির সাথে ঘর বেঁধেছিলেন এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাদের বাসায় বেড়াতে গেলে গিন্সবার্গ অরলভস্কিকে ‘নিজের স্ত্রী’ পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তারও আগে গিনসবার্গের সাথে জ্যাক ক্যারুয়াকের ভালো বন্ধুত্ব ছিল। এবং তারাও দুজনেই সমকামী ছিলেন। তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে একসময় রগরগে আলোচনা হতো সাহিত্যআড্ডায়। ট্রুম্যান ক্যাপোট ও হারপার লি-কে নিয়েও কম আলোচনা হয়নি সাহিত্যমহলে। একটি গল্প বলি, হারপার লি তখনও বিখ্যাত লেখক হিসেবে যশ কুড়াননি। সেসময়ই বিখ্যাত তার বন্ধু ট্রুম্যান ক্যাপোট। তারা ছিলেন শৈশবের বন্ধু। আদি ও অকৃত্রিম। মারা যাওয়ার আগে পর্যন্তও তাই ছিলেন। তো হলো কী, একসময় হারপার লি-র অসাধারণ জনপ্রিয় উপন্যাস ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ প্রকাশিত হলো। সেসময় বাজারে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে দুজনেরই পরিচিতরা রটিয়ে দিল বইটি আসলে ট্রুম্যানের লেখা। কেউ বললেন, তা নয়, ট্রুম্যান ভালোভাবে সম্পাদনা করেছেন। হারপার লি এ বিষয়ে কিছুই বললেন না। ট্রুম্যান সত্য ঘটনা বলতে চাইলেও কেউ বিশ্বাস করলেন না। এ ঘটনার পর হারপর লি আর লেখেননি। কিন্তু সত্যটি জানা গেল অনেক পরে। নিজের খালাকে লেখা ট্রুম্যানের একটি চিঠি অনেক বছর পর ছাপা হলো কাগজে। চিঠিটি ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ প্রকাশের আগে লেখা। তিনি লিখেছেন, হারপার লি-র উপন্যাসটি পড়ে তিনি মুগ্ধ। তিনি আরো লিখলেন, “হারপার লি আসলেই একজন শক্তিশালী লেখক।”
আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে ‘নারীবাদ’
এমন বন্ধুত্বকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? ফ্রেডরিখ নিৎসে বলেছেন, বন্ধু হচ্ছে ‘আমি’ এবং ‘আমাকে’র মাঝখানের একটি সত্তা। মানে বন্ধুর আয়নায় নিজের মুখ দেখা। মানে রিলেশনশিপের সমঝোতা। মানে নিজের ভেতরে বন্ধুকে দেখা। কিন্তু নিৎসে তেমন রাজনৈতিকভাবে হয়তো বন্ধুত্ব বা যে কোনো রিলেশনকে ব্যাখ্যায় যাননি। যেমনটি কার্ল মার্কস দেখেছেন বা জ্যাক দেরিদা দেখেছেন। দেরিদার একটি বইয়েরই নাম, ‘দ্য পলিটিকস অব ফ্রেন্ডশিপ’, বন্ধুত্বের রাজনীতি। ‘ও মাই ফ্রেন্ড, দেয়ার ইজ নো ফ্রেন্ড’—এই বক্তব্য সামনে রেখে দেরিদা বন্ধুত্বের রাজনীতি কেমন সেটি দেখাতে চেয়েছেন। তিনি এই বইতে বলছেন, “বন্ধুত্বেরও একটা রাজনীতি থাকে। সহবস্থানে থেকে অন্যপক্ষকে গুরুত্বহীন করার। এখানেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে রাজনীতি ক্রিয়াশীল।” কথাটি তো মন্দ বলেননি। এমন কথা বহু বহু বছর আগে এরিস্টোটল বলেছিলেন। এরিস্টোটল বলেছেন, “বন্ধুত্ব ও গণতন্ত্র সাংঘর্ষিক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র বন্ধুত্বকে সন্দেহের চোখে দেখে। এবং চূড়ান্ত গণতন্ত্র বা ন্যায়বিচারসহ অন্য উপাদানগুলা তাদের শক্তিতে সক্রিয় হয়ে উঠলে বন্ধুত্বের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়। নাগরিকরা কোনো বিষয় আর আপোষে, দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বের সূত্রে নিষ্পত্তি করতে চান না। তখন তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ন্যায়বিচারের কথা বলে বিচারক হয়ে ওঠে। গণতন্ত্রে আইনের চোখে সবাই সমান। কেউ কারো বন্ধু হলে অন্য আরেকজনের চেয়ে তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া গণতন্ত্রে কঠিন।” (সূত্র: এরিস্টোটলের রাজ্যে বন্ধু: গোপিকানাথ বসু, এক্ষণ প্রকাশন)
কিন্তু দেরিদা তার বইতে বলছেন, “বন্ধুত্ব শক্রু তৈরি করে। আর এটাই বন্ধুত্বের রাজনীতি।”
দেখা যাচ্ছে এরিস্টোটল ও জ্যাক দেরিদার চিন্তার মধ্যে মিল রয়েছে। রাজনীতিগতভাবে না দেখে একটা প্রতিক্রিয়া দেখব এখন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের। ২০১০-এ মারিও ভার্গাস য়োসার সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তিতে প্রতিক্রিয়া হিসেবে লাতিন আমেরিকার আরেক নোবেলজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের টুইটার বার্তা ছিল “এবার আমরা সমকক্ষ”। দেরিদাপন্থীদের কাছে এই টুইট বার্তার মাজেজা অন্যরকম হলেও গণমাধ্যমগুলো অবশ্য এ মন্তব্যের পেছনের কারণটুকু বুঝে নিয়েছিল সাধারণভাবেই। পেরুর মারিও ভার্গাস য়োসা এবং কলম্বিয়ার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মধ্যে একসময় যেমন তুমুল বন্ধুত্ব ছিল, তেমনি ঘটনাচক্রে তারা পরস্পর মুখদর্শন পর্যন্ত স্থগিত রাখেন। যদিও নিজমুখে এরা কেউই একে অন্যের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত করেননি, তথাপি অনেকেই ধারণা করে থাকেন য়োসার স্ত্রীর প্রতি নজর দেওয়াই ছিল মার্কেজের চোখে কালো দাগ বসিয়ে দেওয়া য়োসার ঘুষির কারণ। সম্পর্কের ইতি বস্তুত সেদিন থেকেই এবং তা জারি ছিল শেষ পর্যন্ত। এরকম একটি মুখরোচক ঘটনার কারণেই মারিও ভার্গাস য়োসার নোবেল প্রাপ্তির পরপরই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নামও উঠে এসেছে গণমাধ্যমগুলোতে। সেসব জটিল হিসেবনিকেশে না গিয়ে বন্ধুত্ব ও বন্ধু থেকে শক্রতে পরিণত হওয়া চরিত্রগুলো আসেন দেখি।
ফরাসি কবি গিওম আপোলিনেয়ারের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল শিল্পী পাবলো পিকাসোর। মাঝেই মাঝেই তারা বিভিন্ন দেশ ঘুরতে বেরুতেন। হোটেলের এক রুমেই থাকতেন। প্যারিসের রাস্তায় একই রঙের পোশাক পরেও হাঁটতে দেখেছেন অনেকে যারা তাদের চিনতেন। এমনই গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল ফিলোসফার সক্রেটিসের সঙ্গে এক যৌনকর্মীর। নাম, থিওজেট। থিওজেট যাতে ওই পেশা ছেড়ে দেন এজন্য সক্রেটিস অনেক চিঠি লিখেছেন তাকে। কিন্তু থিওজেট বারবারই প্রশ্ন করতেন, “এই পেশা ছেড়ে দিলে আমি কিভাবে চলব? আমার আয়?” সক্রেটিস এর ফয়সালা করতে পারেননি। থিওজেট বন্ধু সক্রেটিসকে বলেছিলেন, “বন্ধু, আপনিই আমার ব্যবসায়ে একমাত্র ক্লায়েন্ট হন তবে?” সক্রেটিস ছিলেন নিরুত্তর। যদিও এমন কথাও শোনা যায় যে সক্রেটিস বলেছিলেন, যেভাবে তাঁর জ্ঞানপিপাসু শিষ্যরা নিয়মিত তাঁর কাছে ভিড় জমায়, থিওজেট যদি তা করতে রাজি থাকেন, তাহলে তিনি তাঁর বন্ধু ও ব্যবসায়ের অংশীদার হতে সম্মত থাকবেন। কিন্তু সক্রেটিসের চরিত্র বিবেচনায় বন্ধু হিসেবে তিনি থিওজেটের কাছে নিরুপায়ই ছিলেন। নিরুপায় ছিলেন বন্ধুত্ব রক্ষায় রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন। তবু বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন আজীবন হেনরি ডেভিড থোরিও-র সাথে। কারণ হেনরি ডেভিড থোরিও একসময় নেশাসক্ত হয়ে পড়েন। নেশার জন্যে আড্ডা থেকে সামান্য জিনিসও চুরি করতেন। সেসবের জন্য বন্ধুরা তাকে বয়কটেরই ঘোষণা দিল। কিন্তু বাধ সাধলেন রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন। তিনি অন্য বন্ধুদের মিথ্যা বললেন, “সে (হেনরি ডেভিড থোরিও) যা কিছু চুরি করে সেটি তো আমার জন্য। আমার খরচাপাতিতে সে আমাকে আর্থিক সাহায্য করে। অতএব তাকে বয়কট করলে আমিও আর তোমাদের বন্ধু নেই।” রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন তার অন্যসব বন্ধুকে ত্যাগ করলেন হেনরি ডেভিড থোরিও-র সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করার জন্যে। পরে ডেভিড থোরিও তার কাছে জানতে চাইলেন, “তুমি এমন করলে কেন, আমি নেশা করি। তুমি তো করো না। কেন এক নেশাখোর বন্ধুর বদনামকে প্রশ্রয় দিলে।” এমার্সন মুখ ফিরিয়ে শুধু বলেছিলেন, “জানি না, আমি তোকে ভালবাসি। তুই কেন নেশা করিস সেটি স্পর্শ করে আমাকেও। তোর বেদনা বন্ধু হিসেবে আমারও।” দুজনেরই কথা হচ্ছিল নিচারা পাহাড়ের উঁচু ঢালে। কথাগুলো এমার্সন মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলেন। তার গাল বেয়ে পড়ছিল ফোঁটা ফোঁটা কয়েক বিন্দু কান্না।
এছাড়া বন্ধু হিসেবে সেরা জুটি ছিলেন শার্লট ব্রন্টি ও এলিজাবেথ গাসকেল, জে আর আর টেলেকিচ এবং সিএস লিউইস, ক্রিস্টোফার আইশারহুড ও ডব্লিউ এইচ আডন, গুন্টার গ্রাস এবং জন আরভিং। গুন্টার গ্রাস মারা যাওয়ার পর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তার বন্ধু জন আরভিং বলেছিলেন, “আমি হয়তো লেখালেখি করতাম না। আমাকে লেখায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন চার্লস ডিকেন্স আর হাতে ধরে বলা যায় শিখিয়েছিল আজ যে মারা গেল, আমার বন্ধু গুন্টার গ্রাস। আজ থেকে আমি বন্ধুহীন। আমার ভেতরের কথাগুলো শেয়ার করার আর কেউ থাকল না।”
টি এস এলিয়ট এবং এজরা পাউন্ড। এই দুই কবি ইংরেজিতে মর্ডানিজমের প্রারম্ভিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন কাব্য জগতে। তাদের বন্ধুত্ব ছিল অন্যতম। এজরা পাউন্ড একটু দক্ষিণপন্থী রাজনীতির পক্ষে ছিলেন। উল্টোদিকে এলিয়ট রাজনীতিবিমুখ ছিলেন, কিন্তু মানবতাবাদী, ফ্যাসিস্টদের বিপক্ষেই তিনি ছিলেন সোচ্চার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এক রূপান্তরিত পৃথিবীতে মানুষের অসহায়ত্বকে এলিয়ট তুলে এনেছেন ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড, দ্য হলৌ মেন’সহ তার বিভিন্ন কবিতার বইয়ে। জন্ম তাঁরও এজরা পাউন্ডের মতো আমেরিকায়। পরিচয়ও দুজনেরই ওখানেই। পরে দুজনেই স্থায়ী হন ব্রিটেনে। পরিচয়ের দিন তাঁরা ওয়াশিংটন ডিসির একটা কফিশপে বসে কফি খাচ্ছিলেন। পাশাপাশি। তখন এজরা জানতে চান, “কী করেন আপনি?” এলিয়ট জবাবে বলেন, “কবিতা লেখি।” এজরা মজা করে বলেন, “এটা কোনো করা হলো? পেশা তো না আর।” এলিয়ট ফের জবাবে বলেন, “আমি পেশাদারী না। আমি কবিতার নোশাখোর একটা মানুষ।” সেকথা শুনেই এলিয়টকে জড়িয়ে ধরেন পাউন্ড। এরপর বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব এমনই যে এলিয়ট ব্রিটেনে স্থায়ীবসবাস শুরু করলে পাউন্ডও সেখানে স্থায়ী।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ, টনি মরিসন এবং অ্যাজিলা ডেভিস, পল ভ্যালেরি ও আঁতুর রেবো; হেনরি মিলার এবং লরেন্স ভারেল, ভ্লাদিমির নবোকভ, এডমুন্ড উইলসন নরম্যান নেইমার ও জ্যাক অ্যাবট, ভিক্টর হুগোর সঙ্গে পিয়ানোবাদক ফ্রানৎস লিজ, ফ্রানৎস কাফকা ও ম্যাক্সেব্রড এমন অনেক বন্ধুত্বের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
জীবনে বন্ধুত্ব ও শিল্পের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন প্রখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন। তিনি কবি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সঙ্গে প্রখ্যাত রোমান্টিক কবি পার্সি বিশি শেলির বন্ধুত্ব হয় কাকতালীয়ভাবে। বায়রনের সঙ্গে শেলির বন্ধুত্ব হয়ে গেল প্রথমবারের আলাপচারিতায়। যদিও এর আগে শেলি বায়রনের ভক্ত ছিলেন, কিন্তু তাদের দেখা সেবারই প্রথম। এরপর শেলি এবং বায়রন দুজন একসঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন লেক জেনেভার পাড়ে। তারা নতুন নতুন জায়গা ও ঘটনার খোঁজে বেরিয়েছেন। শেলি লিখেছেন, বায়রনের সাহচার্য তাকে কবিতা লেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছিল। শেলির ‘হেইম টু ইন্টেলেকচুয়াল বিউটি’ তাদের দুজনের নৌ-ভ্রমণ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই লেখা। অপর এক বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে শেলি বায়রন সম্পর্কে লিখেছেন: “সে খুবই মজার মানুষ, কিন্তু অপমান ও অন্যায়ের শিকার।” বায়রনের বন্ধুত্ব শুধু শেলির সঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তাঁর পরিবারের সঙ্গেও হয়েছে। এক বৃষ্টির রাতে ভৌতিক গল্পের আসরে বায়রন সেখানে উপস্থিত অন্যদের একটি করে ভূতের গল্প লেখার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সেখানে পার্সি বিশি শেলির স্ত্রীও ছিলেন। সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই ম্যারি শেলি লিখে ফেললেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’।
আলবেয়র কামু ও জাঁ পল সার্ত্রে দুজনই প্রভাবশালী দার্শনিক ও সাহিত্যিক। কিন্তু তাদের মধ্যে চিন্তার অমিলও ছিল অনেক। যেমন, মানুষের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে দুই জনের দুই মত। দুজনেই অস্তিত্ববাদী হলেও সার্ত্রে শেষে সমাজতান্ত্রিক হন। কামু হননি। এভাবেই দুজনের বিরোধের শুরু। নোবেল পুরস্কার জেতার পর কামু একবার বলেছিলেন, “সার্ত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অসাধারণ। কারণ আমরা কেউ কারো মুখ দেখি না।” আবার সার্ত্রেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কামুকে আগে দেওয়া হয়েছে বলেও রটনা রয়েছে। কিন্তু গাড়ি দুর্ঘটনায় কামু মারা গেলে সার্ত্রে ধীরে ধীরে অনুধাবন করেন, কামুই ছিল তার শেষ বন্ধু। সার্ত্রে ও কামুর মতো চার্লস ডিকেন্স ও হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের বন্ধুত্ব টেকেনি শেষঅব্দি। দুজনের প্রথম দেখা ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে। এরপর নয় বছর দেখা হয়নি তাদের। ডিকেন্স বন্ধুকে লেখেন: “নয় বছরে ভেবো না তুমি ইংরেজদের মন থেকে হারিয়ে গেছো। তোমার অবস্থান তাদের অন্তরে আরো পোক্ত হয়েছে। এসেই একবার দেখে যাও।” হ্যান্স চলে যান। ডিকেন্সের বাড়িতে তাঁর জন্য বরাদ্দ কক্ষটিতে থাকলেন। থিয়েটারে গিয়ে ডিকেন্সের অভিনয় করা নাটক দেখে চোখের পানি মুছলেন। তবে দ্বিতীয় দিনই ঘুম থেকে উঠে তাঁর দাড়ি কামিয়ে দেওয়ার মতো কাউকে না পেয়ে অসন্তুষ্ট হলেন তিনি। ডিকেন্সের বড় ছেলেকে দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি আনিয়ে শহর থেকে শেভ করে এলেন। ডিকেন্স ও হ্যান্সের বেড়ে ওঠা এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতি ভিন্ন ধরনের হওয়ায় প্রতিদিনই জমা হতে থাকল অসন্তোষ। ওদিকে দুই সপ্তাহের জন্য এসে হ্যান্স রয়ে গেলেন পাঁচ সপ্তাহ। যেদিন তিনি বিদায় নিচ্ছেন, দেখলেন, দরজায় একটি কাগজে ডিকেন্স লিখে রেখেছেন—“এই কক্ষে হ্যান্স পাঁচ সপ্তাহ ছিলেন। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে কয়েক যুগ।”
আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে চুরি
বন্ধুত্বে ফাটলও ধরেছে এমন উদাহরণ কম নয়। কম হওয়ার কথাও নয়। যেমন, জন কিটস ও লর্ড বায়রন। তাদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিল। বায়রন ছিলেন উন্নাসিক ও উচ্চবিত্ত। অন্যদিকে কিটস ছিলেন নিতান্তই মধ্যবিত্ত। ফলে বায়রনের সফলতা কিটসকে ঈর্ষান্বিত করত সবসময়। কেউ কারো কাজের প্রশংসা করতেন না। জন লে কার ও সালমান রুশদি ভালো বন্ধু ছিলেন। সালমান রুশদির ১৯৮৯ সালে ‘দি স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইসলামপন্থী উগ্রবাদীরা তার মুণ্ডু চেয়েছিল ‘নাস্তিক’ ঘোষণা দিয়ে। এরপর ১৯৯৭ সালে যখন গার্ডিয়ান-এ তার বন্ধু লে কার একটি লেখায় রুশদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, তিনি কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারেন না। অভিযোগের জবাব দেন সালমান রুশদি। তিনি বলেন, “তিনি এত উদারপন্থী আমার জানা ছিল না। যতটুকু জানি সে তো বেশ্যাগমন করে এবং উপাসনালয়ে যায় না।” এর উত্তরে লে কার জানান, “রুশদির ওপর করা আক্রমণের বৈধতা নিয়ে আমার কোনো সমর্থন ছিল না। আমি ছিলাম ধর্মের পক্ষে। কোনো আইনই বৈধতা দেয় না এমন মহৎ ধর্মকে অপমান করার।”
ড্যারেক ওয়ালকট ও ভি এস নাইপল ভালো বন্ধু ছিলেন। কিন্তু খ্যাতির বিড়ম্বনার কারণে কিনা জানা যায়নি একসময় ওয়ালকট নাইপলের বিরুদ্ধে অনেক বিরূপ সমালোচনা করেন। ২০০৮ সালে এক আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে ড্যারেক ওয়ালকট একটা কবিতা ‘দি মনগুজ’ পাঠ করেন। কবিতাটি শুরু হয় এভাবে:
“আমাকে কামড়েছে। আমার ইনফেকশন এড়াতে হবে
নয়তো আমি মরে যাব; নাইপলের উপন্যাসের মতোই।
তার শেষ উপন্যাসটা পড়লেই বোঝা যাবে যা বলছি আমি।”
নাইপল কী এমন করেছেন যে জন্য ওই কবিতা দিয়ে আঘাত করলেন ওয়ালকট? কেন এত ক্ষেপেছিলেন ওয়ালকট বন্ধু হয়ে? কারণ নাইপল তার উপন্যাস ‘অ্যা রাইটার্স পিপল’-এ ওয়ালকটের উদ্দেশ্যে বলেন, “একজন মানুষ যার অনেক প্রতিভা থাকলেও তিনি উপনিবেশিক ধারণা দ্বারা বেষ্টিত।”
রবীন্দ্রসংগীতে সখী মানে (বন্ধু)কে এভাবেই বলা হয়েছে—“ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে।” এই বন্ধু, সখা, ও সই নিয়ে বাংলা গান ও কবিতার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কবি জসীমউদদীন আহমেদ ‘আমার বাড়ি’ কবিতায় বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছেন এভাবে—
“আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা
গামছা বাঁধা দই।”
বাংলা ভাষায় সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি হিন্দু কলেজে পড়ার সময় ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, ভোলানাথ চন্দ্র, বঙ্কুবিহারী দত্তরা তার সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। কখনো ফারসি গজল গান গেয়ে, কোনোদিন বিলেতি দোকানে চুল কাটিয়ে, কখনো শেক্সপিয়র-বায়রন আবৃত্তি করে তিনি বন্ধুদের চমকে দিতেন। আবার শিক্ষকের প্রতি সরব অশ্রদ্ধা, মদ্যপান, অমিতব্যয়িতা সবই ছিল তার নাটকীয়। গুঞ্জন রয়েছে বন্ধু গৌরদাস বসাকের সঙ্গে সমকামী রিলেশনও গড়ে তুলেছিলেন। এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘সেইসময়’-এ। মাইকেলের বিদেশ থেকে ফেরার পর এবং অতিরিক্ত মদ্যপানসহ আর্থিক সংকটে যখন তার বিপর্যস্ত অবস্থা তখন বন্ধুর মতো তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন একজন ঈশ্বরচন্ত্র বিদ্যাসাগর। তিনি টাকা পয়সা দিয়ে মাইকেলকে সবসময় সাহায্য করতেন। পঞ্চানন নামের একজন একদিন বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, “আপনি মাইকেলের মতো মদ্যপকে টাকা দেন বিপদে পড়লে, কই আমাদেরকে তো সাহায্য করেন না?” জবাবে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “আগে মাইকেলের মতো যোগ্যতা অর্জন করে এসো, তবে সাহায্য করব।”
আমাদের দেশে একসময় ভালো বন্ধু ছিলেন কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ। কিন্তু একসময় তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে মতাদর্শিক কারণে। শামসুর রাহমান মনে করতেন তার বন্ধু আল মাহমুদে ‘ইসলামী মৌলবাদী’ হয়ে গেছেন। কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব নিয়ে রয়েছে অনেক কাণ্ড-কীর্তি। তারা দুজনে একসাথে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। রাতে মদ খেয়ে শক্তি বন্ধু সুনীলের বাসায় গিয়ে বন্ধুপত্নী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়কে ম্যানেজ করার জন্য বলতেন, “আপনার সামনে এলেই আমার সব মাতলামি ছুটে যায়।” (শক্তিকে নিয়ে স্বাতীর লেখা, আনন্দবাজার পত্রিকা) একদা রাতের কলকাতাকে শাসন করতেন তারা। তাদের বন্ধু ছিলেন আমাদের দেশের বেলাল চৌধুরী। পঞ্চাশের দশকে সৈয়দ শামসুল হক-কাইয়ুম চৌধুরীর মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব টিকে ছিল দীর্ঘদিন। আবার ষাটের দশকে এসে আবুল হাসান-নির্মলেন্দু গুণ, নাট্যজন মামুনুর রশীদ-মহাদেব সাহা—এই চারজনের বন্ধুত্বময় জীবনের বিচিত্র গল্প কতই না মনকাড়া!
একদিনের একটা গল্প বলি, তখন কবি গুণ ও মামুনুর রশীদ বয়সে তরুণ। থাকেন তেজগাঁও পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের হোস্টেলে। এক সকালে দুই বন্ধু পুরান ঢাকায় গিয়েছেন। আড্ডা সেরে পড়ন্ত বিকেলে ফেরার পথে দুজনেই টের পেলেন অতি ক্ষুধার্ত তারা। কী করা। তো, গুণ মামুনুর রশীদকে বললেন, “আয়, একটা হোটেলে ভাত খাই। খাওয়ার পর আমি যা করি তা-ই শুধু করবি। চল।” দুজনে হোটেলে ভাত খেলেন। মামানুর রশীদ ভাবলেন গুণের কাছে নিশ্চয়ই টাকা আছে। হাত মুখ ধুয়ে গুণ এগিয়ে গেলেন ক্যাশ কাউন্টারের দিকে। পেছনে মামুনুর রশীদ। গুণ তাকে বললেন আগে যা। মামুনুর রশীদ আগে গেলেন। এবার ক্যাশ কাউন্টারের সামনে গিয়ে গুণ বললেন, “এই বিল কত হয়েছে?” ম্যানেজার বিল বলার আগেই গুণ এমন একটা ভাব নিয়ে যেন পান খাবেন হোটেলের একদম লাগোয়া পান সিগারেটের দোকানে সেভাবে এগুলেন। ম্যানেজার বিল বললেন। কত কে জানে। দে দৌড়। রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। দুজনই দৌড়ে বায়তুল মোকাররমের কাছাকাছি এসে থামলেন একটা গলিতে। মামুনুর রশীদ কবি গুণের দিকে তাকিয়ে আছেন, গুণ শুধু বললেন, “বন্ধু, জীবনটা এই দৌড়ই।”
২১ আগস্ট ১৯১১। ল্যুভ মিউজিয়াম থেকে চুরি হয়ে যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’। পরদিন শিল্পী লুই বেরুদ মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলেন, পাঁচ বছর ধরে ‘মোনালিসা’ যেখানে শোভা পাচ্ছিল, সেখানে দেয়ালে কেবল চারটি পেরেক, শিল্পজগতের সবচেয়ে আলোচিত এই নারী নেই। প্রথমে মনে করা হলো, ল্যুভের কোনো বিজ্ঞাপনী প্রয়োজনে ছবি তুলতে হয়তো ‘মোনালিসা’কে অন্য কোথাও সরানো হয়েছে; কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমন কিছু ঘটেনি বলে জানালেন। অর্থাৎ ‘মোনালিসা’ চুরি হয়ে গেছে। গোটা সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে গেল ল্যুভ মিউজিয়াম।
গিওম আপোলিনেয়ার একবার ল্যুভ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সুতরাং পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করল, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুরল জেলে। গিওম পুলিশি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে শিল্পী পাবলো পিকাসোর নাম বলে দিলেন। গ্রেপ্তার হলেন তিনিও। অবশ্য চুরির সঙ্গে তাঁদের কারোরই কোনো যোগসূত্র না পাওয়ায় একসময় ছেড়ে দেওয়া হয় দুজনকেই। উদ্ধারকৃত ‘মোনালিসা’ ৪ জানুয়ারি ১৯১৪ ল্যুভে ফিরে আসে।
গিওমের মৃত্যুর ৩০ বছর পূর্তিতে পিকাসো আবার তাঁকে স্মৃতি থেকে এঁকেছিলেন। গিওমকে এঁকেছেন অঁরি রুশো, মাতিসে, মার্ক শাগাল, মিখাইল লারিনোভ, জুয়ান গ্রিস, জ্যা ম্যাটজিঞ্জার, মার্সেল জর্জিও চিরিকো এবং অভিন্নহৃদয় বন্ধু পিকাসো তো বটেই।
‘শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়’—রবীন্দ্রনাথ শুধু বাণীতে সন্তুষ্ট থাকতে চাননি, প্রাণে তাঁর পরশও চেয়েছেন। একটা সময় ছিল সানন্দে, সগর্বে বন্ধুর কথা বলা যেত। তারপর কী যে হলো, বেশ জোর দিয়ে বন্ধুর দাবি যিনিই করুন, নারী বা পুরুষ—আমরা কিছুটা সন্দিহান হয়ে উঠি।
একালের বন্ধুত্বের যে ব্যাখ্যাই থাক না কেন, সেকালের অন্তত ১০ জন শ্রেষ্ঠ মানুষ বন্ধুত্বের গুরুত্ব ও মহিমা প্রচার করেছেন এবং বলেছেন, হীনম্মন্য মানুষের জন্য বন্ধুত্ব নয়। তাঁরা হলেন হোমার, সোপোক্লেস, হেরোডোটাস, হিপ্পোক্র্যাটস, অ্যারিস্টোফেনস, ইউরিপিডেস, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও ইউক্লিড।
আরো পড়ুন ➥ বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ
সৃজনশীল মানুষের বন্ধুত্বের কাহিনী শতসহস্র বছরের দূরত্ব ডিঙিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছায়। রোমান লেখক প্লিনি দ্য এন্ডার (মূল নাম গাইয়াস প্লিনিয়াস সেকান্দার) তাঁর লেখকবন্ধুর জন্য আক্ষরিক অর্থেই জীবন দিয়েছেন। তাঁর জন্ম ২৩ খ্রিস্টাব্দে, মৃত্যু ২৫ আগস্ট ৭৯ খ্রিস্টাব্দে। রোমান লেখক এবং প্লিনির নারী বন্ধু রেকটিনার একটি বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছে: বিসুবিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং লাভাক্ষরণ শুরু হয়েছে, রেকটিনা ও পম্পোনিয়াসকে উদ্ধার করতে হবে। প্লিনি যখন তাঁদের উদ্ধার করতে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছান, বিসুবিয়াসের অগ্নিক্ষরণ শুরু হয়। তাঁর নৌকার মাঝিরা তাঁকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। প্লিনির মুখ থেকে বের হলো সেই ঐতিহাসিক জবাব, “ফরচুন ফ্যাভার্স দ্য ব্রেভ”। তীরে নেমে তিনি পম্পোনিয়াসকে আলিঙ্গন করলেন, কিন্তু কোথাও রেকটিনাকে পেলেন না। আবার অগ্ন্যুৎপাত শুরু হলো। তিনদিন পর আগ্নেয়গিরি শান্ত হলে দেখা গেল জমাট লাভার মাঝখানে প্লিনি দ্য এন্ডার বসে আছেন, এতটুকু ক্ষতও তাঁর দেহে নেই। কিন্তু তিনি নিষ্প্রাণ। বিসুবিয়াস পম্পেই ও হারকুলিয়াম নগর দুটিকে ধ্বংস করে দেয়। রেকটিনারও কোনো হদিস মেলেনি। কোনো সন্দহ নেই, প্লিনি দ্য এল্ডার এবং রেকটিনার বন্ধুত্ব ধ্রুপদ ধরনের। পরবর্তীকালের গবেষকেরা দুজনের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেননি।
খ্রিস্টজন্মের শতবর্ষ আগের বিখ্যাত লেখক মার্কাস সিসেরো বন্ধুত্ব নিয়ে তাঁর বিখ্যাত অভিসন্দর্ভ De Amicitia তাঁর বন্ধু টাইটাস পম্পিনাস এট্টিমাসকে উৎসর্গ করেন। টাইটাস ও সিসেরোর মধ্যে বহুসংখ্যক পত্রবিনিময় হয়েছে এবং তা গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। সিসেরো দর্শন, আইন, রাষ্ট্রনীতি, প্রশাসন, সাহিত্য—প্রায় সব বিষয়েই লিখেছেন। বেন জনসন ও উইলিয়াম শেকসপিয়ারের চরিত্র হয়ে উঠেছেন মার্কাস সিসেরো।
প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও সিসেরোর পথ ধরে বন্ধুত্বের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিকের বিশ্লেষণ করেছেন সেইন্ট অগাস্টাস (৩৪৫-৪৩০), সেইন্ট থোমাস একুইনাস (১২২৫-১২৭৪), আল গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১), ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬)