সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

“সাহিত্য কি খেলাধুলা যে প্রতিযোগিতা হয়, এরপর ট্রফি তুলে দেওয়া হবে বিজয়ীর হাতে? এই পুরস্কার তুলে দেওয়ার সংস্কৃতিও উচ্চমন্য ও হীনমন্যকুলের জন্ম দেয়। যাকে বলে এলিটিজম। এ ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর।” (ট্রিনকোয়ান লেকচার, জেমস জয়েস)

জেমস জয়েস এখনো বিশ্বসাহিত্যে লেখকদের লেখক। কিন্তু তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। পাননি লিও তলস্তয়, জোসেফ কনরাড বা হেনরি জেমস, মার্সেল প্রুস্ত, পল ভ্যালেরি, মিলান কুন্ডেরাসহ অসংখ্য সাহিত্যিক। আবার এমন অনেকে পেয়েছেন নোবেল যাদের এখন আর কেউ চেনেই না। কালজয়ী হয়ে ওঠেনি তাদের সৃষ্টি। নাম বললেই ভাববেন, এরা কারা? নামই তো শোনেননি আগে। অথচ পড়েননি তো কম। শোনেন তবে সাহিত্যে নোবেলজয়ী চার নাম আপাতত—হেনরিক শিয়েঙ্কেভিচ, রুদলফ ইউকেন, এলভিন্দ জনসন, জয়েস হ্যারিহননি।

আসলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে নোবেল অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য হলেও পান না। আবার দেখা যায় রাজনৈতিক বিবেচনায় কেউ কেউ পান না, পেলেও পরে নোবেল লরিয়েটের কাছ থেকে পুরস্কার কেড়ে নেওয়া হয়। এ এক মজার রাজনীতি। তবে অপ্রকাশ্য। নোবেল পুরস্কার নিয়ে যে অনিয়ম হয় সে বিষয়ে ২০১৯ সালে বড় স্বীকারোক্তি করেছেন নরওয়েজিন নোবেল কমিটির সেক্রেটারি লিন্ডস্ট্যাড। তিনি বলেন, “১০৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাদ পড়াটা (গ্রেটেস্ট অমিশন) হলো নিঃসন্দেহে মহাত্মা গান্ধীর কখনো নোবেল পুরস্কার না-পাওয়া।” পাঁচবার নোবেল পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছিলেন গান্ধীজি। ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দুবার। শতাব্দীকাল ধরে নোবেল কমিটি যে ঘরে বসে পুরস্কারপ্রাপকদের নাম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে সেই ঘরে বসেই লিন্ডস্ট্যাড জানালেন, “তবে এটা ঐতিহাসিক একটা সত্যি হয়ে থেকে গিয়েছে যে গান্ধী কখনো নোবেল পুরস্কার পাননি।” তাঁর মতে, এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ ছিল নোবেল কমিটির সদস্যদের ইউরোপ-কেন্দ্রিক মনোভাব।

আরো পড়ুন ➥ সৃষ্টিশীলদের খেয়ালিপনা

আক্ষেপের সুরে লিন্ডস্ট্যাড বলেছেন, “নোবেল প্রাইজ ছাড়াও চলে যায় গান্ধীজির। তবে গান্ধীজিকে ছাড়া নোবেল কমিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।” নোবেল পাননি স্টিফেন হকিং। কিন্তু তিনিই কসমোলজিতে কিংবদন্তি। তো, তিনি স্বীকার করে নিলে সাহিত্যেও যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে রাজনীতি হয় সেটি আমাদের না বোঝার কথা না। মিলান কুন্ডেরা ২০১৩ সালে এক ইন্টারভিউতে বলেন, “কেন যে আমার নাম আসে বারবার নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময়। আমি কি নোবেল না পেলে আর মিলান কুন্ডেরা থাকব না?”

কিন্তু নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দুজন খ্যাতিমান। একজন জ্যাঁ পল সার্ত্রে অন্যজন বরিস পাস্তের্নাক। আর বব ডিলানও প্রথমে নিতে চাননি। বেকায়দায় পড়েছিলেন নোবেল কমিটি। পরে অবশ্য বব ডিলান পুরস্কারটা নেন।

ফ্রান্সের জ্যাঁ পল সার্ত্রে বিশ্বখ্যাত ফিলোসফার ও সাহিত্যিক। ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সময় তার নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এবং অন্য কারণে। সার্ত্র মূলত দার্শনিক হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাটক, উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখেছেন। রোডস টু ফিড্রম, আইরন ইন দ্য সোল কার বিখ্যাত উপন্যাস। লিখেছেন আত্মজৈবনিক। তাই তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান সাহিত্যিকদের একজন বলে বিবেচনা করা হয়। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগেই সার্ত্র জানতে পারেন ওই বছরের মনোনীত সাহিত্যিকদের তালিকায় তাঁর নাম আছে। জানার পরপরই চিঠি লিখে তিনি যোগাযোগের চেষ্টা করেন সুইডিশ একাডেমির সঙ্গে। কিন্তু তাঁর চিঠি গিয়ে পৌঁছানোর আগেই ঘোষিত হয় পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্তি ঠেকাতে না পেরে প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেন সার্ত্র। কমিটিকে নিজের অপারগতা জানান তিনি বেশ বিনয়ের সঙ্গে। নোবেল কমিটি বা পুরস্কারকে কোনোরূপ দোষারোপ না করে এই প্রত্যাখ্যানকে একেবারেই ‘ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত’ বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু অনেকে বলেন যে সার্ত্রর এই প্রত্যাখ্যানের নেপথ্যে কারণ তাঁর আগে আলবেয়ার কামুর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। আলবেয়ার কামু ফিলোসফিক্যালি সার্ত্রে দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল গুরু শিষ্যের। আলবেয়ার কামুর মৃত্যু সংবাদে সার্ত্রের চোখে কান্না দেখা গিয়েছিল। কামু পুরস্কারটি পেয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে এবং খবরটি পাওয়ার পর খুব উচ্ছসিত হয়ে নোবেল কমিটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন সার্ত্রে। কিন্তু এরপর সার্ত্র আর কামুর মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়। আগে পুরস্কার পেয়ে কামু এগিয়ে গেলেও কয়েক বছর পর ওই একই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে সার্ত্র হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন নোবেল প্রাপ্তি আদতে তেমন মহান কিছু নয়। কিন্তু সার্ত্রের বন্ধু প্লেভে সেসময় জানিয়েছিলেন, সার্ত্রের মধ্যে আলবেয়ার কামুকে নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। থাকলে তিনি কামু মারা যাওয়ার পর কান্না করতেন না। তিনি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখান করেন নীতিগত কারণেই। নিচে সার্ত্রের চিঠিটি দেওয়া হলো:

১৪ অক্টোবর , ১৯৬৪, প্যারিস
প্রিয় সচিব মহোদয়,
আমি আজই জানতে পেরেছি, কোনো কোনো সূত্র অনুসারে আমি এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেতে পারি। পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার আগে তা নিয়ে কথা বলা অবিবেচনাপ্রসূত মনে হতে পারে, কিন্তু কোনো ভুল বোঝাবুঝি ঠেকানোর জন্য এই চিঠি লিখছি। আপনাকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই যে সুইডিশ একাডেমি, যা অনেক খ্যাতিমান লেখককে সম্মানিত করেছে, তার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ও বস্তুগত কারণে আমি সেসব লেখকের তালিকাভুক্ত হতে চাই না। শুধু ১৯৬৪ সালে নয়, এর পরে কোনো সময়েই এই সম্মান আমার কাঙ্ক্ষিত নয়।
বিনম্র শ্রদ্ধাসহ,
জ্যাঁ পল সার্ত্র

২২ অক্টোবর সুইডিশ ও ২৩ অক্টোবর ফ্রান্সের একটি পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা। এখানে দীর্ঘ বিবৃতিতে তিনি ব্যাখ্যা করেন পুরস্কার গ্রহণে নিজের অনীহার কথা:
“আমি ১৯৪৫ সালের পর থেকে সব ধরনের অফিশিয়াল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে আসছি। আমি জ্যাঁ পল সার্ত্র লিখে স্বাক্ষর করা আর নোবেলজয়ী জ্যাঁ পল সার্ত্র লিখে স্বাক্ষর করা এক নয়। একজন লেখক যখন এই ধরনের কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেন, তিনি আদতে পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।”

সার্ত্রের বন্ধু প্লেভে জানান, “বিশ্বযুদ্ধের পর সার্ত্রে নিউটন বোমার আবিষ্কারকের ‘নোবেল’ নিতে অনাগ্রহী ছিলেন এবং মনে করতেন এ পুরস্কার নেওয়া মানেই নৈতিকভাবে তার মানবিকতার পরাজয় ঘটবে।”

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন

বরিস পাস্তের্নাক রাশিয়ার জনপ্রিয় কবি, ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক। জন্ম মস্কোতে, ১৮৯০ সালে। মাই সিস্টার, লাইফ (১৯১৭) তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু উপন্যাস লিখেই খ্যাতিমান হন। জীবনের শেষ ভাগে এসে লেখেন উপন্যাস ডক্টর জিভাগো (১৯৫৭) রাশিয়ার সর্বকালের সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর মধ্যে একটি। এটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট শাসনকে ব্যঙ্গ করে লেখা। বইটি প্রকাশের পরের বছর ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে সুইডিশ একাডেমি। তবে এ বইটির জন্য নয়। পুরস্কার দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হয় তার কাব্যকে। পুরস্কারের সাইটেশনে লেখা হয়, রুশ গীতিকাব্যে অবদান এবং রাশিয়ার মহাকাব্যিক ঐতিহ্যকে জারি রাখার কারণে তাঁকে এই পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি জানতেন যে পুরস্কারটি পেতে যাচ্ছেন ড. জিভাগো লেখার জন্য। কারণ তাঁর কাব্য তাঁর বিবেচনায় আহামরি কিছু না। সেসব কথা তিনি বলেছিলেন ওই বছরই ২১ ডিসেম্বর ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত দ্য স্ক্রেপসি পত্রিকায়। তিনি পুরস্কার প্রত্যাখান করেন। তিনি মনে করতেন তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন কিন্তু এটি যেন পুঁজিবাদী সমাজ লুফে না নেয় এ পুরস্কার দিয়ে। কিন্তু তাঁর পুরস্কার প্রত্যাখানের বিষয়ে অন্য গল্পও রয়েছে। নোবেল পুরস্কারের ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে নাকি আনন্দিত হন পাস্তের্নাক। সৌজন্যবোধ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যথারীতি ২৫ অক্টোবর তিনি টেলিগ্রাম করেন সুইডিশ একাডেমিকে। কিন্তু এই পুরস্কারে তখনকার সোভিয়েত সরকার মোটেও খুশি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের সময় তখন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঠান্ডা দ্বন্দ্ব চলছে ইউরোপ, আমেরিকার অধিকাংশ পুঁজিবাদী দেশগুলোর। আর নোবেল পুরস্কারকে সমাজতান্ত্রিক শাসকেরা বরাবরই দেখে এসেছেন পুঁজিবাদের প্রকাশ হিসেবে। ফলে ২৫ তারিখেই পাস্তের্নাকের পুরস্কারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। ‘মস্কো লিটারেরি সোসাইটি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের দাবি তুলে স্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচি শুরু করে। পাস্তের্নাক-বিরোধী আন্দোলন ও প্রচারণাও জমে ওঠে। একপর্যায়ে সেটি বড়ো আকার ধারণ করে। পাস্তের্নাককে ‘রাষ্ট্রদোহী’, ‘শত্রুর সঙ্গে আঁতাতকারী’ ইত্যাদি বলে আক্রমণ করতে থাকেন উত্তপ্ত ছাত্র-জনতাসহ সোভিয়েতের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী। পগুঞ্জন রয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে তাঁকে বলা হয়, একবার স্টকহোমে পুরস্কার আনতে গেলে আর কোনো দিন নিজ দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। এ কারণে ভয় পেয়ে নাকি লেখক পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সত্য ছিল তিনি ক্যাপিটেলিজমকে কোনো ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না।

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হ্যান্ড। কিন্তু লক্ষ করুন তিনি নোবেল বিজয়ী হওয়ার পর থেকে তার পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক। বিতর্ক এমন পর্যায়ে চলছে যে অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাও সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন। অবশ্য পিটার হ্যান্ডকেও এর জন্য কম দায়ী নন বলে অনেকে মনে করছেন। বর্তমান দুনিয়ায় কিংবদন্তিতুল্য দার্শনিক জিজেক স্লাভক সিএনএনকে বলেছেন বলেছেন, “এবারের নোবেল পুরস্কার এটাই প্রমাণ করে যে, পিটার হ্যান্ডকে অতীতে ঠিক কথাটাই বলেছিলেন।” পিটার হ্যান্ডকে অতীতে কী বলছিলেন সেটি জানা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে অস্ট্রিয়ান নিউজপেপার ‘ডাই প্রেস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের দিকে নজর দিলে।

তিনি তখন বলেছিলেন, “নোবেলপ্রাইজ শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত।” তিনি আরো বলেছিলেন, “সাহিত্যের মিথ্যা সিদ্ধ ঘোষণা।” ‘গার্ডিয়ান’-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ লেখক হারি কানজু বলেছেন, “যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের এমন বুদ্ধিজীবী দরকার, যাঁরা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অবহেলা ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের মুখে মানবাধিকার রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবেন। হান্ডকে তেমন ব্যক্তি নন।” আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এদি রামা বলেছেন, “কখনো ভাবিনি নোবেল পুরস্কারের কথা ভেবে আমার বমিভাব হবে।”

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

কসোভোর প্রেসিডেন্ট হাশিম থাচি টুইটে বলেছেন, “নোবেল পুরস্কারের এই সিদ্ধান্ত ভুক্তভোগীদের জন্য অপরিমেয় বেদনা হয়ে দাঁড়াবে।” বিশ্বজুড়ে লেখকদের সংগঠন পেন আমেরিকার সভাপতি জেনিফার ইগান টুইটারে লেখেন, “এমন একজন লেখক যিনি তাঁর কণ্ঠকে ঐতিহাসিক সত্যকে মুছে ফেলতে ব্যবহার করেছেন, তাঁকে নির্বাচিত করা খুবই বিস্ময়কর।” কেন পিচার হ্যান্ডকে এত তোপের মুখে পড়েছেন এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, নব্বই দশকে বসনিয়া যুদ্ধে সার্বদের সমর্থন দেওয়ার কারণে হ্যান্ডকে অত্যন্ত বিতর্কিত ছিলেন। পিটার হান্ডকের বিরুদ্ধে আলোচিত স্রেরেব্রেনিৎসা গণহত্যাকে অস্বীকার করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি যুদ্ধাপরাধী স্লোভেদান মিলোসোভিচেরও ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। বসনিয়া যুদ্ধে সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোভেদান মিলোসোভিচের নেতৃত্বে সার্ব বাহিনী ১৯৯৫ সালের ১১ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত মাত্র ১২ দিনে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেরেব্রেনিৎসা শহরের আট হাজারের বেশি মুসলিম পুরুষ ও ছেলেশিশু হত্যা করে। নারীদের বন্দীশিবিরে রেখে ধর্ষণ করা হয়। ২০০৬ সালে পিটার হ্যান্ডকে সার্বিয়ার নৃশংসতার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন এবং সার্বিয়ার ভাগ্যকে ইহুদিদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যদিও তিনি পরে ওই মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “মুখ ফসকে বেরিয়েছে।” সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব ম্যাটস ম্যালম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, “কমিটি কেবল সাহিত্যিক ও নান্দনিক গুণাবলির ভিত্তিতেই বিজয়ীকে বাছাই করেছে এবং একাডেমির জন্য এরকম বাধ্যবাধকতা নেই যে, তাকে রাজনৈতিক বিবেচনার বিপরীতে সাহিত্যমূল্যের সমন্বয় করতে হবে।”

নোবেল কমিটি যাই ব্যাখ্যা দিক, লক্ষ করুন কারা পিটার হান্ডকের সমালোচনা করেছেন? নিপীড়িত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরাই।

আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিকেই যদি তাকাই তবে দেখি তাঁর জীবনেও আছে অনেক বিতর্কিত অধ্যায়। তিনি হিন্দু মৌলবাদী ফাদার সংগঠন ‘হিন্দু মহাসভা’র নেতা বালগঙ্গাধর গ্রেফতার হলে চাঁদা তুলেছিলেন জামিনের জন্য। ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসক বেনিতো মুসোলিনির প্রশংসা করেছিলেন। অবশ্য তার আগেই ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পেয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইতালিতে যান। সেবার মুসোলিনির এক কাছের জন ফরমিচি রবীন্দ্রনাথের জন্য জাহাজভর্তি বই পাঠান। পরের বছর আবার যান রবীন্ত্রনাথ। দেখা হয় এবার মুসোলিনির সাথে। মুসোলিনি জানান, ইতালীয় ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রনাথের সব লেখা তিনি পড়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে আর পায় কে? খুশি হয়ে যান। মুসোলিনির চাল বুঝতে পারেন না।

পরের দুই সপ্তাহে রবীন্দ্রনাথ ইতালির রাজাসহ রোমের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। দেন কয়েকটি বক্তৃতাও। একটিতে মুসোলিনি উপস্থিত ছিলেন। সেবার সফরের শেষদিকে রবীন্দ্রনাথ ফের দেখা করেন মুসোলিনির সঙ্গে। তখন রবীন্দ্রনাথ যত্রতত্র ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির প্রশংসা করে বেড়াচ্ছেন। পরে নিজে নিজের ভুলটা বুঝতে পারেন। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদসহ সব ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবল বিরোধিতা করেছেন।

আরো পড়ুন ➥ তবু সে দেখিল কোন ভূত

আর্জেন্টাইন হোর্হে লুই বোর্হেসের চিলির অগাস্তো পিনোশে, স্পেনের ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, আর্জেন্টিনার হোর্হে রাফায়েল ভিদেলারের প্রশংসায় মুখর ছিলেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী হিটলারের বিরোধিতা করেন। আবার পেরন শাসনের বিরোধীতায় আর্জেন্টিনার কমিউনিস্ট পার্টির দোদুল্যমানতা দেখে বোর্হেস কমিউনিজমের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেন। শুধু আস্থা হারিয়ে ফেলা নয়, সমর্থন করেন সামরিক জান্তাকে। বোর্হেসের সেই বিখ্যাত উক্তি জানেন তো! তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্রে তাঁর আর আস্থা নেই। অন্য দেশের জন্য ভালো হলেও হতে পারে, কিন্তু চিলি বা আর্জেন্টিনায় এটি কার্যকর কোনো পদ্ধতি নয়।

অবশ্য একদা কমিউনিস্ট সমর্থক ছিলেন বলেই হয়তো নোবেল কমিটি তার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। বোর্হেসকে আর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তবে তিনি তাদের মনোনীত সংক্ষিপ্ত তালিকায় দুবার ছিলেন। ১৯২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন ন্যুট হামসুন। ২৫ বছর পর আডলফ হিটলারের মৃত্যুতে শোকবার্তা লিখেছিলেন, “হিটলার ছিলেন মানবজাতির যোদ্ধা। সব জাতির জন্য ন্যায়বিচারের বার্তা প্রচারক।” এরপর ন্যুট হ্যামসনের নোবেল পুরস্কারের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে নেয় নোবেল কমিটি। শেষ জীবনে ন্যুট হ্যামসন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। তখন স্যানাটোরিয়ামে শুধু বিড়বিড় করে নাকি বলতেন, “আমার হিটলারের পক্ষ নেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি।”

নোবল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একজন লেখক সম্পর্কে আলোচনা করলেই এ বিষয়ে রাজনীতিটা পরিষ্কার হয়ে যায়; তিনি চিনুয়া আচেবে। পশ্চিমের অনুসারী না হবার কারণেই এই পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন নাইজেরিয়ান এই মহান লেখক। তিনি একজন মৌলিক ও অত্যন্ত শক্তিমান ঔপন্যাসিক। ম্যানবুকার প্রাইজপ্রাপ্ত লেখক চিনুয়া আচেবে আঙুল দিয়ে দেখান পশ্চিমের আফ্রিকা দেখার চোখকে: “মানুষ আফ্রিকা যায়। সেখানে তাদের চোখ তা-ই দেখে, যা তাদের মন ইতোমধ্যেই বিশ্বাস করে বসে আছে। ফলে প্রকৃতই চোখের সামনে যা আছে, ব্যর্থ হয় তা দেখতে। পশ্চিমারা আফ্রিকাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মহাদেশ হিসেবে গণ্য করে না। তাদের কাছে, আফ্রিকা দুনিয়ার যত আজগুবি, অবিশ্বাস্য আর অযৌক্তিক বস্তুতে ভরপুর।” 'আর কিছু বলার দরকার আছে কি? আছে আছে। ভারসাম্য রাখার জন্য অবশ্য নাইজেরিয়ারই ওলে সোয়েনকাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ঠিক আছে তো!

   

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত



নাজমুল হাসান
কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩২৮ সালের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বৎসর ৬ মাস বয়সে আড্ডার ফাঁকে একটুখানি সময়ের মধ্যে ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি গানের সুরে রচনা করেন। 'ভাঙার গান' শিরোনামেই কবিতাটি 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী বাংলা পৌষ-মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতা হলেও এটি ছিল মূলত একটি বিদ্রোহাত্মক গান; কবিতাটির শিরোনামের মধ্যেই সেটি প্রকাশ পেয়েছে।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩৩১ সালে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যায় কবিতাটির সাথে আরও ১০টি কবিতা যোগ করে মোট ১১টি কবিতা নিয়ে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের দুই মাস পর ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত শাসনাধীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার আর কখনো এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। ফলে পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতে গ্রন্থটি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

পটভূমি:

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলাকালীন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার। ব্রিটিশ বিরোধী এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত সরকার ব্যাপকভাবে তরুণদেরকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। ওই সময় 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার হাল ধরেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী।

একদিন বাসন্তী দেবী 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি কবিতা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দাশ পরিবারের সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। এ সময়ে নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজাফফর আহমদ কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়ির নিচ তলায় একই রুমে ভাড়া থাকতেন। 'ভাঙার গান' শীর্ষক এই গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন- "আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গলার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম।‌ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল।”

পড়া শেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুকুমাররঞ্জন দাশের হাতে দেন, যা 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাসন্তীদেবীর অনুরোধে পরবর্তীতে নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুরারোপ করে সে গানের স্বরলিপিও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন বলে জানা যায়। ফলে এ গানের সুরকার নজরুল ইসলাম নিজেই। এই কবিতাটি লেখার দুই/তিন সপ্তাহ আগে ওই বাড়িতে থাকার সময়েই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ হুগলী জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনিসহ সেখানে বন্দি থাকা অন্যান্য স্বদেশী আন্দোলনের বন্দিরা একত্রে কোরাস আকারে কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া সুরে সর্বপ্রথম ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি জেলখানার ভিতরেই গেয়েছিলেন।

ব্রিটিশ রাজরোষের কারণে কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। ১৯২২ সালে নজরুল 'ধূমকেতু' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতু'র দ্বাদশ সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমন' নামে নজরুলের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে এ মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরেরদিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নজরুল ইসলামকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ এই এক বছর জেলে রাখা হয়। জেল-জীবনে কয়েদিদের সঙ্গে কোরাস কণ্ঠে তিনি বহুবার এ গানটি গেয়েছেন। যদিও সে গানের কোনো রেকর্ড নাই। পরবর্তীতে গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া এ গানটি সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া সুরই ছিল নজরুল ইসলামের নিজের করা সুর।

মূলভাব:


‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জন্য একটি উদ্দীপনামূলক গান। গানটির মাধ্যমে কবি যে দ্রোহের প্রকাশ করেছেন তা হলো—প্রতিবাদ-ধ্বংসের মধ্য দিয়েই জাগ্রত হবে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার নতুন পতাকা, স্বাধীনতার নতুন সূর্য স্বাধীন জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলো ছড়াবে। গানটির মাধ্যমে নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিপ্লবীদের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পরাধীনতার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার আমিয় বাণী।

কবিতাটির প্রকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. পত্রিকা: বাঙলার কথা, শিরোনাম: ভাঙার গান, ২০ জানুয়ারি, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ, শুক্রবার, ৭ মাঘ ১৩২৮।
২. কাব্যগ্রন্থ: ভাঙার গান, প্রথম সংস্করণ- শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, আগস্ট ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ, কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’। দ্বিতীয় সংস্করণ- ন্যাশনাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম স্ট্রিট, কলিকাতা- ১২। খ্রিষ্টাব্দ ১৯৪৯ । কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’ (গান) ১। পৃষ্ঠা: ১-২।
৩. নজরুল-রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩/মে ২০০৬। ভাঙার গান। গান-১। পৃষ্ঠা: ১৫৯-১৬০।

গানটির রেকর্ড সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. Columbia Records- কলাম্বিয়া রেকর্ডস, প্রখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি কলাম্বিয়া’র তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত রেকর্ড। জুন ১৯৪৯, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫৬, জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
২. এইচএমভি (HMV), হিজ মাস্টার’স ভয়েস- His Master's Voice, জানুয়ারি ১৯৫০, পৌষ-মাঘ ১৩৫৬, এন. ৩১১৫২। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
৩. ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতারা ভোট দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের যে তালিকা করেছে তার মধ্যে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি ১৬তম।

গানটির চলচ্চিত্রে রূপদান সংক্রান্ত ইতিহাস:

১. চলচ্চিত্র: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। কাহিনীকার- চারুদত্ত। চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক- নির্মল চৌধুরী। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্টুডিওর ব্যানারে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর, রবিবার ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৬। গানটির চলচ্চিত্রের স্বরলিপিকার ও স্বরলিপিতে করেছিলেন- রশিদুন্‌ নবী। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (বিংশ খণ্ড)। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, পঞ্চম গান। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী ও সহ-শিল্পীবৃন্দ। সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
পর্যায়: বিষয়াঙ্গ- স্বদেশ, সুরাঙ্গ- সামরিক মার্চ, তাল- দ্রুত দাদরা, গ্রহস্বর: সা।
লিঙ্ক: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন https://www.youtube.com/watch?v=F1StxYnf-yU

২. চলচ্চিত্র: জীবন থেকে নেয়া। জহির রায়হান নির্মিত শেষ কাহিনী চিত্র। চলচ্চিত্রটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী: খান আতাউর রহমান। শিল্পী: অজিত রায়, খন্দকার ফারুক আহমেদ ও অন্যান্য। চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির এই চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
লিঙ্ক: জীবন থেকে নেয়া https://www.youtube.com/watch?v=4gOJVlb_9-A

‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ উভয় চলচ্চিত্রেই শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী এবং অজিত রায় ও খন্দকার ফারুক আহমেদ গানটিকে কাজী নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছেন। দুটি চলচ্চিত্রের গানের সুরের মধ্যে সামান্য একটু ভিন্নতা থাকলেও উভয় ক্ষেত্রেই গানটির বিপ্লবী মূলভাব ফুটে উঠেছে। চেতনার সাথে মিল রেখে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটিকে বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। মূল গানটি জেলখানায় বসে কয়েদিরা কোরাস কণ্ঠে গেয়েছিলেন বলে দুটি চলচ্চিত্রেই গানটিকে জেলখানার কয়েদিদের দ্বারা কোরাস কণ্ঠে গাওয়ানো হয়েছে।

কবিতাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।


ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

এখানে ‘কারা’ মানে কারাগার, তৎকালীন পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতের যে কারাগারে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত তরুণ বিপ্লবী বীরদের গ্রেপ্তার করে আটক করে রাখছিল। সেই কারাগারের শক্ত লোহার দরজা তথা লৌহকপাট ভেঙে ফেলে তাকে লোপাট অর্থাৎ ভেঙেচুরে গুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘পূজার বেদী’ হলো যেখানে পূজা করা হয়, সে শ্রদ্ধা-সম্মানের স্থান। পূজার বেদীতে মানুষের মনের গভীর থেকে উঠে আসা পরম ভক্তির আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। কবি এখানে স্বদেশকে পূজার বেদীর সাথে তুলনা করেছেন। যে পূজার বেদীতে ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য থাকার কথা সে বেদীতে আজ ব্রিটিশ সরকার দ্বারা অত্যাচারিত ভারতের বীর সন্তান, স্বাধীনতাসংগ্রামী, বিপ্লবীদের রক্ত জমাট বেঁধে আছে, সে বেদীতে আজ পরাধীনতার শিকল পরানো। এ বেদী আজ বেদী নেই, একে নির্মমতার পাষাণে পরিণত করা হয়েছে। এ শিকল ভেঙে, জমাটবাঁধা রক্ত সরিয়ে পাষাণময় পূজার বেদীকে মুক্ত করে মায়াময় ও পবিত্র করতে হবে, অর্থাৎ পরাধীন দেশের শোষণ-নির্যাতন থেকে দেশকে মুক্ত-স্বাধীন করে তাকে উপভোগ্য ও আত্মনির্ভর করতে হবে।

ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ঈশান শব্দের অর্থ শিব, মহাদেব, মহেশ্বর। এর আরেকটা অর্থ উত্তরপূর্ব কোণ। হিন্দুমতে শিব প্রলয়ের দেবতা এবং ধ্বংসের রাজা বা নটরাজ। এখানে কবি ‘তরুণ ঈশান’ বলতে শিবশক্তির প্রলয়ের সাথে তুলনীয় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী তরুণ বীর সন্তান ও বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। ‘প্রলয়’ অর্থ ধ্বংস, ‘বিষাণ’ শব্দের অর্থ শিঙা। ইসলামি মতে ইসরাফিল শিঙায় ফু দিলে যেভাবে পৃথিবীর প্রলয় বা ধ্বংস শুরু হবে সেভাবে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে তাদের ‘প্রলয় বিষাণ’ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদের সক্ষমতাকে কবি প্রলয়ের দেবতা মহাদেবের মহাশক্তির সাথে তুলনা করে তাদেরকে পরাধীনতার শিকল ভাঙতে প্রলয় বিষাণ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

‘নিশান’ মানে পতাকা,‘ধ্বংস নিশান’ মানে যে পতাকা ধ্বংসের প্রতীক, ধ্বংসের নির্দেশনা দেয়। ‘প্রাচীর’ অর্থ দেওয়াল, ‘ভেদি’ মানে ভেদ করা বা ভেঙে-ফুড়ে বেরিয়ে আসা। কবি স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে এমনভাবে ‘ধ্বংস নিশান’ বা ধ্বংসের পতাকা ওড়াতে বলেছেন যেন তা স্বাধীনতাকামী সূর্যসন্তানদেরকে যে কারাগারে আটক রেখেছে সে কারাগার ভেদ করে ফুড়ে বেরিয়ে আসে, পরাধীনতার প্রাচীর বা দেওয়াল ভেদ করে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসে। সে পতাকা দেখে যেন সমগ্র পরাধীন ভারতবাসী স্বাধীন-মুক্ত হবার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়।


গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘গাজন’ সনাতনধর্মীদের একটা সামাজিক উৎসবের নাম। চৈত্র মাসের শেষ দিকে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের মিলিত বাজনা বাজিয়ে গাজন উৎসব পালন করা হয়। মিলিত বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজায় গাজন উৎসবের বাজনা খুব প্রকট হয়। কবি এখানে গাজনের বাজনার মতো প্রবল শব্দে বাজনা বাজিয়ে লড়াইয়ে নেমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হওয়ার তীব্র আহ্বান জানিয়েছেন।

কবি এখানে ব্যঙ্গ করে ব্রিটিশ শাসকদের স্বরূপ প্রকাশ করার নিমিত্তে পরাধীন ভারতবাসীকে প্রশ্ন করেছেন—কে মালিক, কে রাজা, কে সাজা দেয়, কে মুক্ত, কে স্বাধীন, কে সত্য? অর্থাৎ ওরা বিদেশি, ভিনদেশি, ওরা আমাদেরকে শাসন করার অধিকার রাখে না। এ দেশ আমাদের, এ দেশের মালিক আমরা, এ দেশের রাজা আমরা, এখানে আমরা মুক্ত-স্বাধীন, এখানে আমাদেরকে কেউ সাজা দেওয়ার অধিকার রাখে না। এখানে আমরাই সত্য, ওই ব্রিটিশরাই এখানে মিথ্যা। ওরা মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতে পারে না।

হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ভগবান মানে সর্বশক্তিমান, সর্বমুক্তমান, সর্বমালিক মহাশক্তি। কবি এখানে ভগবান বলতে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীরদের বুঝিয়েছেন। তারাই এ দেশের মালিক। ভগবানকে যেমন বন্দি রাখা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বন্দি করা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বেঁধে রাখা তথা ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব, ভগবানকে যেমন ধ্বংস করা অসম্ভব—তেমনি এ দেশের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীর, যারা এ দেশের মালিক তাদেরকেও বেঁধে রেখে তথা বন্দি রেখে ফাঁসির দড়ি পরানো অসম্ভব। সুতরাং এই বীরদেরকে জেলে আটকে রেখে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি দেওয়ার যে পায়তারা ব্রিটিশরা করছে তা দেখে কবির হা হা হা কোরে অট্টহাসি পাচ্ছে। কারণ, স্বাধিকারের জন্য যেভাবে প্রতিরোধ-সংগ্রাম চলছে তাতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভগবান অর্থাৎ এ দেশের বিপ্লবী-বীরদেরকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব।

ব্রিটিশ শাসকেরা বিপ্লবী-বীর ও স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দেরকে প্রচণ্ড শাস্তি দেওয়ার কথা প্রচার করে মানুষকে বিপ্লব-বিরোধী করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। তাদের এ চক্রান্তে যাতে মানুষ ভয় পেয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে যায় সে জন্য কবি প্রচণ্ড আস্থার সাথে প্রশ্ন রেখেছেন—বিপ্লবী-বীরদের ফাঁসি দেওয়া যায়, এমন হীন অর্থাৎ নীচ ও জঘন্য তথ্য কে শেখাচ্ছে? কে ছড়াচ্ছে এমন অসম্ভব কথা? অর্থাৎ কবি মানুষকে অভয় দিচ্ছেন যেন ব্রিটিশ শাসকদের এমন চক্রান্তে ভয় পেয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ আন্দোলন থেকে সরে না যায়। কারণ, এই বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী শক্তিকে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।


ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

প্রলয় বা ধ্বংসের দেবতা এবং ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টির দেবতা দুটোই শিব বা মহাদেব। অর্থাৎ মহাদেব ইচ্ছে করলে যেমন সৃষ্টি করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছে করলে আবার প্রলয় বা ধ্বংসও করতে পারেন; এটা নিতান্তই তাঁর খেয়াল। এজন্য শিবকে বলা হয় ‘পাগলা ভোলা’। কবি এখানে জেলখানায় বন্দি স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদেরকে ‘পাগলা ভোলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবির মতে ব্রিটিশ সরকার এই পরাধীন ভারতের পুরোটাকেই কারাগার বানিয়ে রেখেছে। ফলে এই কারাগারে বন্দি প্রতিটি মানুষই আসলে ‘পাগলা ভোলা’। পরাধীনতার কারাগারে বন্দি স্বাধীনতাকামী মানুষকে কবি আহ্বান করছেন তাঁরা যেন মহাশক্তিধর ‘পাগলা ভোলা’ তথা মহাদেবের ধ্বংস বা প্রলয় ক্ষমতার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করে পুরো ভারতবর্ষকে দোলা দিয়ে কাঁপিয়ে তাঁদের ক্ষমতার জানান দেয়। তাঁরা যেন এই কারাগার বা গারদের লোহার শিক জোরসে ধরে হেচ্‌কা টান দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে মুক্ত হয়ে আসে।

মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘হায়দার’ অর্থ শক্তিশালী, তরবারি বা সত্যের তলোয়ার। আব্রাহামিক ধর্মের শেষ নবি হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর আপন চাচাত ভাই ও জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর প্রচণ্ড শক্তি ও শৌর্য-বীর্য থাকার কারণে তাকে ‘হায়দার’ বলা হয়। ‘হাঁক’ শব্দের অর্থ হুংকার। কবি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীকে হজরত আলীর সেই হায়দারী হাঁকের মতো প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে ব্রিটিশরাজের ভিত কাঁপিয়ে পদানত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

‘দুন্দুভি ঢাক’ হলো একপ্রকার বৃহৎ ঢাক বা দামামা জাতীয় প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, রণবাদ্যবিশেষ। বন্দি-জীবন আসলে মৃতপ্রায়-জীবন; কবি বন্দিদশাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন এবং সেই মৃত্যুদশা থেকে জীবনকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশে সজীব হয়ে গৌরবের সাথে বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সে সাহস সঞ্চার করেছেন।


নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বাংলা বৈশাখ মাস এবং এর কাছাকাছি মাসগুলোতে যে প্রচণ্ড ঝড় হয় তাকে ‘কালবোশাখী’ বলে। পরাধীন ভারতবাসীর মনের ভিতরে ব্রিটিশবিরোধী যে ভয়ঙ্কর আক্রোশ ক্রমাগত তোলপাড় করে চলেছিল তাকে কবি কালবোশাখীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি মুক্তিকামী দ্রোহী ভারতবাসীকে কালবোশাখীর ভয়ঙ্কর প্রলয় শক্তি নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, এখন বৃথা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়। এভাবে কাল বা সময় হরণ করা খুবই অনুচিত। সময় নষ্ট না করে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়।

মহাভারতের কাহিনী অনুসারে ভীম হলো পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় পাণ্ডব। ভীম অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন। ভারতবর্ষের বিপ্লবী বীরদের উপরে ব্রিটিশরাজ ভীমের শক্তি প্রয়োগ করে অত্যাচার-নির্যাতন করছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ভীমের মতো শক্তিশালী কারাগারে বন্দি করে রাখছে। কবি ভারতবাসীকে আহ্বান করছেন যেন তারা তাদের সংগ্রামী শক্তি প্রয়োগ করে ওই ‘ভীম কারা’ বা শক্ত কারাগারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে তা উপড়ে ফেলে মুক্তি-সংগ্রামীদের মুক্ত করে আনে।

লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!
যত সব বন্দী শালায়-
আগুন-জ্বালা,
-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বল প্রয়োগ করে যারা ভারতবর্ষকে দখল করেছে তাদের কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কবি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী নন, তিনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করেই অধিকার ছিনিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বন্দিরা কবে মুক্তি পাবেন অথবা আদৌ পাবেন কি না সে অপেক্ষায় তিনি বসে থাকতে রাজি নন। তিনি জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে একত্র করে এখনই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সকল বন্দিশালা বা কারাগার ভেঙে সকল বন্দিকে মুক্ত করতে চান। এই শক্তি প্রয়োগকেই কবি ‘লাথি’র সাথে তুলনা করেছেন এবং মুক্ত হওয়াকে ‘তালা ভাঙা’র সাথে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন “লাথি মার ভাঙ্গরে তালা”।

‘আগুন-জ্বালা,ফেল উপাড়ি’ শব্দগুলি দিয়ে কবি স্বদেশীদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন যেন তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের সকল অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনকে ভারতবর্ষের মাটি থেকে চিরতরে উপড়ে ফেলেন, উচ্ছেদ করেন। এ দেশের মালিক হবে এ দেশেরই জনগণ, এ দেশকে শাসন করবে এ দেশেরই জনপ্রতিনিধি, ভারতবর্ষ হবে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম শোষণ-নির্যাতনমুক্ত দেশ।

গানটি বিকৃতির ইতিহাস:

রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত, আরএসভিপি মুভিজ এবং রায় কাপুর ফিল্মস প্রযোজিত, ইশান খাট্টার, মৃণাল ঠাকুর, প্রিয়াংশু পাইনুলি ও সোনি রাজদান প্রমুখ অভিনীত ‘পিপ্পা’ ছবিটি ১০ নভেম্বর ২০২৩ সালে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। ছবিটিতে নজরুলের গান 'কারার ঐ লৌহকপাট'-এর রিমেক করা হয়েছে। অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রাহমানের রিমেক সংস্করণে গানটি গেয়েছেন ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী।

এ আর রাহমান বাংলা গান নিয়ে আগেও কাজ করেছেন। ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: আ ফরগটেন হিরো’ সিনেমার জন্য রবীন্দ্রসংগীত ‘একলা চলো রে’-এর সংগীতায়োজন তিনি করেছিলেন। এ ছাড়া ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গানটির সুরারোপও তিনি নিজের মতো করেছেন। তবে নজরুল সংগীত নিয়ে এটাই তাঁর প্রথম কাজ। দক্ষিণ ভারতীয় এ সুরকার তাঁর রেমিক সংস্করণে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির মূল সুরের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট রাখেননি। বিপ্লবী-বিদ্রোহী চেতনার ভাব ও সুরের গানটিকে তিনি লোকগীতির রোমান্টিক ঢংয়ে পরিণত করে নষ্ট করে ফেলেছেন। এমন একটি রুদ্র চেতনার গানকে হত্যা করে তিনি জঘন্য অপরাধ করেছেন যা ক্ষমাহীন।

মূল গানটি কারাগারে মধ্যে গাওয়া হলেও ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে- ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়ে নাচগান করে রীতিমতো উৎসব করে গানটি গাইছেন। গানটি গাওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। গানটি রচনার প্রেক্ষাপট এবং এর বিপ্লবী চেতনা এমন উত্সবপূর্ণ দৃশ্যের সাথে যায় না।

চলচ্চিত্রে দৃশ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য বুঝে সেই দৃশ্যের উপযোগী গানের সুর সৃষ্টি করা সুরকারের কাজ। ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানের যে পরিবেশ দেখানো হয়েছে ওই পরিবেশে এই বিপ্লবী গানটি খাটে না। সিনেমার দৃশ্যে নরম সুরে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি গাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে আনন্দরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে সেটি মানানসই ও যুতসই হয়নি, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ অসংগতির দায় স্ক্রিপ্টরাইটার ও পরিচালককে বহন করতে হবে। ফলে এ বিকৃতির জন্য এ আর রহমানের সাথে তারাও দোষী।

ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী এরা প্রতিষ্ঠিত গায়ক এবং সম্ভবত সবাই বা অধিকাংশই বাঙালি। এই গানের সুর তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ফলে এরা সবাইও বিকৃত সুরে গানটি গাওয়ার জন্য অপরাধী।

২০২১ সালে নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ ও তাঁর মা কল্যাণী কাজী ‘পিপ্পা’ সিনেমা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেন। চুক্তিনামায় প্রথম সাক্ষী ছিলেন অনির্বাণ কাজী। কাজী অনির্বাণ স্বীকার করেন—মা গানটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন সুর এবং কথা না বদলে রিক্রিয়েট করার জন্য। মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা তা শোনায়নি। ছবির নির্মাতারা এ দায় এড়াতে পারে না।

উপসংহার:
সব সৃষ্টি কালজয়ী হয় না, সবাই কালজয়ী সৃষ্টি করতে পারে না। যারা কালজয়ী সৃষ্টি করেন তারা তাদের সৃষ্টির সাথে সাথে নিজেরাও কালজয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম হলেন সেই কালজয়ী স্রষ্টা; তিনি নিজেও অমর, তাঁর সৃষ্টিও অমর। 'ভাঙার গান' শিরোনামে লেখা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নজরুলের সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও এক অনন্য সৃষ্টি। এ সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এ আর রহমান রাখে না। অনেকে বলেন—সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ হওয়াটা স্বাভাবিক। কথাটা হয়তো সত্য কিন্তু সৃষ্টিকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করা এবং তাকে বিকৃতরূপে প্রকাশ করা এককথা নয়। মানুষ যদি পুরনো সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ সানন্দে গ্রহণ করে তবেই তাকে পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয়, একেই বলে সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ।

‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির সুর পরিবর্তন বাঙালি গ্রহণ করেনি, এটাকে বিকৃতি হিসেবে নিয়েছে। ফলে এ পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়।

নাজমুল হাসান: লেখক ও চিকিৎসক।

;

কবি সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রদূত জননী সাহসিকাখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। 

মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সমস্ত প্রগতিশীল আন্দেলনে ভূমিকা পালনকারী সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের এই দিন (২০ নভেম্বর) সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বিকেল ৩টায় বরিশালের শায়েস্তাবাদস্থ রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এই আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন।

পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন এবং তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন।

১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ কার্ফু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেন।

সুফিয়া কামালের লেখা কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, দিওয়ান, অভিযাত্রিক, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী ইত্যাদি। ‘কেয়ার কাঁটা’ নামে একটি গল্পগ্রন্থ ছাড়াও তিনি ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতি কথা, শিশুতোষ এবং আত্মজীবনীমূলক রচনাও লিখেছেন। সোভিয়েতের দিনগুলি এবং একাত্তরের ডায়েরী তার অন্যতম ভ্রমণ ও স্মৃতিগ্রন্থ।

সুফিয়া কামাল দেশ-বিদেশের ৫০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সোভিয়েত লেনিন পদক, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক।

;

গৌরীপুরে হুমায়ুন ভক্তদের পাখির আবাস তৈরি 



উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,গৌরীপুর,ময়মনসিংহ
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিনে পাখির নিরাপদ আবাসের জন্য গাছে গাছে পাখির বাসা ঝুলিয়েছেন ভক্তরা।

সোমবার (১৩ নভেম্বর) দুপুরে ভক্তদের সংগঠন হুমায়ুন আহমেদ স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।

গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফৌজিয়া নাজনীন উপজেলা পরিষদ চত্বরে হাড়ি-কলস ঝুলিয়ে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। পরে বন, বন্য প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষায় পৌর শহরে প্রচারাভিযান চালান ভক্তরা। এর আগে সোমবার হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফৌজিয়া নাজনীন বলেন, ‘গাছপালা ও বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় এখন আগের মতো পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায় না। পাখি আমাদের প্রাণবৈচিত্রের অংশ। পরিবেশে পাখি বেঁচে থাকা খুবই জরুরি। পাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকাও জরুরি। বন, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়। এ জন্য সাধারণ জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।'

এ সময় হুমায়ুন আহমেদ স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পদক প্রভাষক স্বপন কুমার ঘোষের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন শ্যামগঞ্জ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হারুন আলী বারী, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য এইচএম খায়রুল বাসার, বোকাইনগর ইউপি চেয়ারম্যান আল মুক্তাদির শাহীন, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু কাউছার চৌধুরী রন্টি, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রহিম, মোঃ শেখ সাদী সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পীযুশ রায় গণেশ, প্রচার সম্পাদক হারুন মিয়া প্রমুখ।

;

‘খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত ছিলেন আবুল হাসনাত’



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
‘বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনে বিশিষ্টজনরা

‘বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনে বিশিষ্টজনরা

  • Font increase
  • Font Decrease

কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক আবুল হাসনাত ছিলেন খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত এবং সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে নিরলস একজন মানুষ। প্রয়াত আবুল হাসনাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সংকলন 'বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য' এর প্রকাশনা উৎসব ও স্মরণ আলোচনায় যোগ দিয়ে বিশিষ্টজনরা তাকে নিয়ে এই মূল্যায়ন তুলে ধরেন।

রোববার (১২ নভেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে অনুষ্ঠিত হয় এই মোড়ক উন্মোচন ও স্মরণ আলোচনা অনুষ্ঠান। গ্রন্থটি ছিলো আবুল হাসনাতের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। তবে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান বুকস। বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী।

আবুল হাসনাত ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। সঞ্চালক প্রজ্ঞা লাবণীর কণ্ঠে তার কবিতা ‘স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া সহজ নয়’ আবৃত্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এর পর গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন পর্বে অংশ নেন- প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী ও আবুল হাসনাতের স্ত্রী সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক।  

আবুল হাসনাতের অগ্রন্থিত এই সংকলনে রয়েছে ১৫টি প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ-সমালোচনা। এই বইয়ের প্রবন্ধ অংশে- বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীরকে নিয়ে যে প্রবন্ধাবলি রয়েছে, তাতে মূর্ত হয়েছে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে তার ভাবনার স্বরূপ। আর পাবলো নেরুদা ও ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ দুটিতে ফুটে উঠেছে তার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বইটি পাঠককে আবুল হাসনাতকে বুঝতেও সাহায্য করবে।

গ্রন্থটির ওপর আলোচনা ও লেখকের স্মরণে বক্তারা তার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা এবং স্মৃতিচারণা করেন। আলোচনায় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'আবুল হাসনাত ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী। তিনি মানুষের ভেতরে সততা ও সংস্কৃতি বিকাশের স্বপ্ন দেখতেন। জাতির সাহিত্য–সংস্কৃতির বিকাশে যারা নীরবে কাজ করে গেছেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম।

সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাতের ভূমিকা উল্লেখ করে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, কার ভেতরে কোন ধরনের মেধা ও সৃজনশীলতা আছে, তা তিনি চট করেই বুঝতে পারতেন। তাদের দিয়ে সেই ধরনের কাজ করিয়েছেন। তিনি বহু লেখককে প্রতিষ্ঠিত হতেও সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে নিজেও ছিলেন উঁচু মানের কবি, প্রাবন্ধিক ও শিল্প সমালোচক। তার বিভিন্ন রচনায় নান্দনিক ভাবনা, পরিশীলিত মেজাজ, পরিমিতিবোধ ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।'

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, 'আবুল হাসনাতের সঙ্গে পুরান ঢাকার নবাবপুর স্কুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা করেছি। এছাড়া ক্রিকেট খেলা, কবিতা লেখা, সাহিত্যচর্চা, ষাটের দশকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছি। আবুল হাসনাত নেই, এটা বিশ্বাস করতে মন চায় না। পরবর্তী জীবনে আবুল হাসনাত দেশের সব লেখক, শিল্পীর ঘনিষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তার নিজের লেখালেখিও অনেক। ২১টি মৌলিক গ্রন্থ, এককভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ২১টি আর যৌথভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ২২টি। তার লেখায় শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, ভাবনা উপস্থাপনা উচ্চ মানের। মৃত্যুর পর নির্মোহ মানুষটিকে আমরা যেনো আরও গভীরভাবে জানতে পারছি।  

লেখা ছাপানোর ক্ষেত্রে তিনি লেখক নন, বরং লেখার গুণমানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম থেকে তিনি ডাকে সংবাদের সাহিত্য পাতার জন্য লেখা পাঠাতেন। লেখাগুলো সাময়িকীতে গুরুত্বের সঙ্গেই ছাপা হতো। কিন্তু তখন আবুল হাসনাতের সঙ্গে তার সরাসরি পরিচয়ই ছিল না। আবুল হাসনাত স্বল্পভাষী, নেপথ্যচারী লাজুক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল খোলামেলা। গুণীর কদর করতে কার্পণ্য করেননি।'

আবুল হাসনাতের সঙ্গে কাজ করার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, 'এটি আবুল হাসনাতের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। তবে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে তিনি সারা জীবন নিরলস কাজ করেছেন। খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত এই মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত প্রচারবিমুখ। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই মানুষটি মৃত্যুর আগেও কালি ও কলমের বিদ্যাসাগর সংখ্যা নিয়ে কাজ করে গেছেন। বারবার সেটি সম্পন্ন করার কথাই বলেছেন। নতুন প্রজন্মের প্রতি তার ছিলো গভীর আস্থা। তিনি মনে করতেন দেশের নতুন প্রজন্মই সব সংকটে জাতিকে উত্তরণের সঠিক পথ দেখাবে।

সভাপতির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এতে ১৫টি প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ সমালোচনা রয়েছে ৬টি। প্রতিটি লেখা সুলিখিত, প্রাণবন্ত। গভীর পাণ্ডিত্য আর বিষয়গুলোতে লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রকাশ রয়েছে। লেখা দুর্বোধ্য নয়। সব শ্রেণির পাঠকই লেখাগুলো পড়ে যেমন অনেক বিষয়ে জানতে পারবেন, তেমনি আনন্দও পাবেন। স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তিনি নিজেও ছিলেন নবাবপুর স্কুলের ছাত্র। তবে আবুল হাসনাতের চেয়ে পাঁচ বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন।প্রচারবিমুখ আবুল হাসনাতের লেখা ভালোভাবে সংরক্ষণ এবং সেগুলো পরের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তার প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে- এমনটাই জানান তিনি।

আবুল হাসনাতের স্ত্রী সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, আবুল হাসনাতের স্মৃতিরক্ষা ও তার কাজ সংরক্ষণের জন্য আবুল হাসনাত ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। গত ১ নভেম্বর ছিল আবুল হাসনাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সে উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জানান, পর্যায়ক্রমে তার সব রচনা ও সম্পাদিত গ্রন্থ নিয়ে রচনাসমগ্র প্রকাশের পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।

আবুল হাসনাত কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান ছদ্মনামে। কবিতা, উপন্যাস, চিত্র-সমালোচনাসহ সাহিত্যের নানা বিভাগে তিনি পদচ্ছাপ রেখেছেন। দেড় দশকের বেশি সময় সাহিত্য ও শিল্প–সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা কালি ও কলম এর সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। এর আগে তিনি দুই যুগের বেশি সময় দৈনিক সংবাদ–এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’ সম্পাদনা করেন। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর সাহিত্যিক ও শিল্প সমালোচক আবুল হাসনাত রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে মারা যান। একজন বিচক্ষণ ও সংবেদনশীল সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন আবুল হাসনাত। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী দীর্ঘদিন তার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন ছায়ানটের অন্যতম সংগঠক ও সদস্য ছিলেন। ছায়ানটের কার্যকরী সংসদের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন সাংবাদিক আবুল হাসনাত।

;