কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৫)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
বার্তার নিজস্ব অলঙ্করণ

বার্তার নিজস্ব অলঙ্করণ

  • Font increase
  • Font Decrease

ঈশ্বর আমাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন

[পূর্ব প্রকাশের পর] সাড়ে এগারোটার দিকে বাতি নেভানোর উদ্যোগ নিতেই শুরু হয় গোলাগুলি। প্রথমে এর শব্দটা ছিল অনেকটা পপ-পপ-পপ ধরনের। আমি দেখার চেষ্টা করলাম শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণাকে লোকজন পটকা ফুটিয়ে উদযাপন করছে কিনা। রাস্তাঘাট তখন জনশূন্য ছিল। আমি যখন জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম তখন গুলির শব্দ ও পরিমাণ ক্রমে বাড়ছিল। আমি লিনের রুমে দৌড়ে গিয়ে দেখি সেও কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। আমরা সাবধানে এক জানালা থেকে আরেক জানালায় ছোটাছুটি করি। এটা যদি বাজি ফোটানোর শব্দই হয় তাহলে লোকজন সব গেল কোথায়? প্রতিটি বিস্ফোরণের মাঝখানে বাইরে কেবল অন্ধকার আর মৃত্যুর নিস্তব্ধতা। আমরা আমাদের পর্দাটানা খাবার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শহরকেন্দ্রের দিকে দেখার চেষ্টা করছিলাম। আর ঠিক তখনই আমাদের পেছনের দুটো বাড়ির মাঝখান দিয়ে চারটি বিশাল আগুনের গোলা উড়ে যায় আকাশে। অবশেষে, আমরা অনুধাবন করি যে, ওগুলো স্বাধীনতার ঘোষণা উদযাপনের বাজি ফোটানোর শব্দ নয়।

আমরা তখন আমাদের বিছানাপত্র বাড়ির সবচেয়ে মাঝখানে অবস্থিত বসার ঘরের মেঝেতে পেতে ঘুমাতে চেষ্টা করি। ভোর রাত অব্দি গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। পপ পপ শব্দের মাঝখানে মেশিনগানের রা টা টাট শব্দের ফুলঝুরি ফোটে সারারাত।

শনিবার সকালে আবার সবকিছু শান্ত ও স্বাভাবিক মনে হলে, আমরা বছরের মন্দাকালীন ছয়মাসের জন্য সব্জি টিনবন্দী করার বার্ষিক প্রকল্পের কাজে হাত লাগাই। আমরা গাজর, আলু, ঢেঁড়স, পেঁয়াজ, সিম, টমেটো ইত্যাদি ধুয়ে ও কেটে কুচি কুচি করে বোতলে ভরতে থাকি। বারোটি বয়ম ভরার পর এবং আরো একটি ঝুড়ি ভরা বাকি থাকতে আমরা আবিষ্কার করি যে, প্রেসার কুকারটি কাজ করছে না। অর্থাৎ অল্প কদিনের মধ্যে এইসব সব্জি আমাদের খেয়ে শেষ করতে হবে, তা নাহলে আমাদের সময়, শক্তি ও অর্থ পুরোটাই জলে যাবে।

মধ্যসকালে রিড এই খবর নিয়ে আসেন যে, তিনি তাঁর গাড়িখানি দিয়ে দিয়েছেন। এটা সামান্য ব্যাপার ছিল না; এটাই ছিল আমাদের পালানোর একমাত্র বাহন, যেটাকেও দান করে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তিনি, ঈশ্বরের দূত, আর কোনোদিনই ঈশ্বরের ভালোবাসা প্রচার করতে পারতেন না, যদি তিনি নিজে সেই ভালোবাসাটুকু দেখাতে না পারেন। গাড়িটা নেওয়ার অনুরোধ নিয়ে যে-এসেছিল সে হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মণীন্দ্র দাস। ১৯৬৬ সালে সে, তার স্ত্রী ও মাতা একে একে যিশুর ওপর বিশ্বাস আনে। সেই থেকে মণীন্দ্রর শ্বশুরকুলের সবাই তাকে ত্যাজ্য ঘোষণা করে এবং জনসমক্ষে অপমানিত করে। তারা কাছাকাছি বাস করলেও কেউ কারো বাড়িতে যেত না, খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিশে তার আত্মীয়রা নিজেদের কলুষিত করতে চাইত না। এখন আসন্ন বিধর্মী শুদ্ধি অভিযানে হিন্দুজনগোষ্ঠীর কী অবস্থা হতে পারে তা কল্পনা করে তার শ্বশুর মণীন্দ্রকে অনুনয় করে তাদের গোটা পরিবারকে কোনো ’খ্রিস্টান বাড়িতে’ নিয়ে যেতে। রিড কিভাবে তাদেরকে পালানোর জন্য গাড়িটা না দিয়ে থাকতে পারেন?

“তোমরাও কি হাসপাতালেই চলে যেতে চাও?” রিড আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন। “আমার মনে হয় আমি এখনো চেষ্টা করলে ড্রাইভারকে আটকাতে পারি।”

আবারও আমরা থাকার সিদ্ধান্ত নিই।

রিড দরজার বাইরে বেরুতে না বেরুতেই গুর্‌গানস তাঁর মোটর সাইকেলে চড়ে আমাদের খোঁজখবর করতে আসেন। তিনি জানান নেভাল সদরদপ্তরের পাশ দিয়ে আসার সময় তিনি দেখতে পান রাস্তার বেসামরিক নাগরিকদের দিকে তারা মারণাস্ত্র তাক করে রেখেছে। পরের নিঃশ্বাসেই তিনি জানান যে, তিনি আসলে আমাদেরকে তাঁর বাড়িতে নিতে এসেছেন, তাঁর ও রিডের মোটরসাইকেলে পেছনে বসিয়ে। শহরের সব বিদেশিদের নিয়ে একটি আমেরিকান আবাস তৈরি করা হয়েছে। তার ছাদের ওপর আমেরিকা ও কানাডার পতাকা ওড়ে সবসময়।

আমাদের কী করা উচিত। আমাদের প্রথম দায়িত্ব কি অন্যান্য মিশনারি সদস্য ও আমেরিকান নাগরিকদের সঙ্গে মিলে এক জায়গায় থাকা, যাতে করে নিজেদের মিশনের পুরুষদের আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে না হয়, নাকি আমাদের প্রকৃত দায়িত্ব আসলে আমরা যাদের সেবা করতে এসেছি সেই অসহায় বাঙালিদের প্রতি? আমরা যখন এই দুই সম্ভাবনা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করছিলাম তখন বসু পরিবারের বড় ভাই এসে তার মা ও ছোট বাচ্চাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য মিনতি করতে থাকে।

প্রভু আমাদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেন। আমরা তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। আমরা তাদেরকে আমাদের সঙ্গে সেই মার্কিন আবাসেও নিয়ে যেতে পারি না। ফলে আমরা থেকে যাই। রিড আমাদের আগেই বলেছিলেন যদি আমরা প্রয়োজন মনে করি তাহলে তিনি আমাদের সঙ্গে থেকে যেতে পারেন—আমরা তেমনটা মনে করেছিলাম বৈকি।

বসুরা কারা? সারা বসু, বয়স ১৮, আর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে গুড ফ্রাইডেতে তার বিয়ে হবার কথা। তার বাগদত্ত শহরের যে-অঞ্চলে বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে সহিংস দাঙ্গা লেগে থাকে, সেখানেই থাকত ও কাজ করত। আমরা তার কোনো খবরই পাচ্ছিলাম না, তাই ধরেই নিয়েছিলাম যে, সে নিহত হয়েছে। দশ মাস পরে, সীমান্তের ওপারে আত্মীয় ও শরণার্থীদের সঙ্গে কাটিয়ে একদিন সে উদ্ভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত চেহারায় এসে হাজির হয়।

রেবেকা ছিল আরেক হাসিমাখা কিশোরী। যুদ্ধ ছিল তার তালিকায় যুক্ত হবার মতো আরেকটি অ্যাডভেঞ্চার মাত্র। দূরদর্শী যে-খ্রিস্টান আবাসিক স্কুলটিতে সে পড়ত, সেটি যুদ্ধ শুরু হবার কয়েকদিন আগেই তাদের শিক্ষার্থীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা তা না করলে, চট্টগ্রাম থেকে একশত মাইল, ও ট্রেন, স্টিমারে দেড়দিনের যাত্রাপথের দূরত্বে আরেকটি শহরে সে আটকা পড়ে যেত।

লাকি ও বিউটি ছিল দুই ভীত বাচ্চা মেয়ে, যারা ঠিক বুঝতে পারছিল না চারদিকে কী ঘটছে, আর স্বপন ছিল চোখের তারা-কাঁপানো আরেকটি বাচ্চা ছেলে, কিছু একটা করার জন্য যে সবসময় উন্মুখ হয়ে থাকত।

স্বপন বরাবরই আমাদের খুব প্রিয় ছিল। কয়েক বছর আগে সে আমাদের আমেরিকানদের খ্রিস্টবিষয়ক ধারণাকে প্রসারিত করতে সাহায্য করেছিল, যিনি সব ভাষার ব্যবধানই উত্তীর্ণ হয়ে যান। ব্যাপারটা ছিল এরকম।

একজন নতুন মিশনারি, মন্টি (ম্যারিলিন) মালম্স্ট্রম সবে এসেছেন। রবিবারের স্কুলের বাঙালি বাচ্চারা, ভাষা ঠিক বুঝতে না পারলেও, তাঁর মধ্যে একজন দয়ালু মানুষকে ঠিকই চিনে নিতে পারে। এই একজন মানুষ যে বাচ্চাদেরকে পছন্দ করে তারা স্রেফ বাচ্চা বলেই।

লিন বাচ্চাদেরকে শিখিয়েছিল কিভাবে প্রার্থনায় অংশ নিতে হয়, এবং তারাই কোনো নির্দিষ্ট দিনে সিদ্ধান্ত নিত তারা কার সঙ্গে প্রার্থনা করবে।

এটা তেমন অবাক-করা ছিল না যে, ক্লাস চলাকালীন এমন একটা উদগ্রীব অনুরোধ শোনা গেল, “আমরা মিস মন্টির সঙ্গে প্রার্থনা করতে চাই।” গোটা ক্লাস তখন বাংলায় ধুয়ো ধরে, “আমরা মিস মন্টিকে চাই।”

“কিন্তু,” লিন প্রতিবাদ করে বলে, “মন্টিতো বাংলা বলতে পারে না; তাকে তাহলে ইংরেজিতে প্রার্থনা করতে হবে।”

স্বপনের কালো চোখ প্রশ্নভরা বিস্ময়বোধে ভরে ওঠে, সে জানতে চায়, “যিশু বুঝি ইংরেজি বোঝেন না?”

বসুপরিবারের মা ছিলেন একজন পরিশ্রমী, ধর্মভীরু নারী যিনি সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রভুকে অনুসরণ করার প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

আর ছিলেন বুড়ি দিদিমা। তিনি বধিরতম খাম্বার চেয়েও বধির ছিলেন। প্রত্যেকবার যখন কেউ গুলিগোলার শব্দে ভয় পেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে লুকানোর উপক্রম করত, তিনি বলে উঠতেন, “আমি বুঝতে পারি না তোরা কেন এত ভয় পাচ্ছিস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছে এটা তো নস্যি।” তখন কিন্তু তিনি ঠিকই শুনতে পাচ্ছিলেন।

বসুপরিবারের সদস্য কেউকেউ নিখোঁজও ছিলেন। সবচেয়ে বড় ভাইটি—পরিবারটিকে একত্র রাখতে গিয়ে অতিরিক্ত বোঝার ভারে নুইয়ে পড়া এক তরুণ। মেঝ ভাই—সরকারি টিবি হাসপাতালে তখন চিকিৎসাধীন। এই হাসপাতালটি ছিল শহরের ঠিক উপকণ্ঠে, কুমিরায়, যেখানে হামেশাই পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে লড়াই হতো। হাসপাতালভরা বিভিন্ন মাত্রার যক্ষ্মারোগীদের ফেলে রেখে ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীরা সবাই প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তারা আরো কয়েকদিন টিকে ছিল, চারপাশ দিয়ে গোলাগুলি ছুটে যাওয়ার সময় বিছানার নিচে লুকিয়ে থেকে। খাবারদাবার শেষ হয়ে গেলে, যারা তখনও হাঁটতে পারত, তারা পাহাড় ও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, শহরঅভিমুখে চারদিনের এক দীর্ঘ যাত্রা শুরু করে আশ্রয়ের আশায়। কিন্তু খুবই অসুস্থ যারা হাঁটতেও পারত না, তাদের কী হয়েছিল?

সবচেয়ে ছোটটি, নির্মল—সবসময় আমাদের সাহায্য করতে চাইত, কিন্তু তার জন্য যতটা সময় ঘরে থাকার দরকার ততটা সে পারত না। খাবার কিংবা অন্য কিছু সংগ্রহের জন্য সে বাইরে গেলে তার মা ভয়ে কাঁপতে থাকত, তার ছেলেকে বুঝি তিনি আর দেখবেন না।

আরো একজন ছিল নিখোঁজ। মার্চের ২ তারিখে, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ করে দেওয়া শহরের প্রথম সর্বাত্মক হরতালের দিন সকালবেলায় আমরা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাই।

“আপনারা একটু জলদি আসবেন প্লিজ? আমার বাবা খুব অসুস্থ।”

ভোরের শীতল বাতাস ঠেলে আমাদের বাসা থেকে প্রায় সোয়া মাইল দূরে অবস্থিত বসুদের দুকামরার বাঁশের ঘরে যাই আমরা। বসুর বাবা আমাদের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গত সপ্তাহগুলোতে প্রায়শই আমরা ওবাড়িতে গেছি। ডাক্তারেরা তাঁর অপারেশন করেছিলেন এই আশায় যে, তাঁর আলসারটিকে তারা সরিয়ে ফেলতে পারবেন। উল্টো তারা দেখেন তাঁর পেট ক্যান্সারাক্রান্ত টিউমারে ভরা। আমরা তাঁকে কিছু ইঞ্জেকশন আর বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়ে কিছুটা আরাম দিতে পেরেছিলাম। আমরা তাঁর ক্ষুধা বাড়ানোর জন্য কিছু পুষ্টিকর খাবারও দিয়েছিলাম। আমরা গিয়ে দেখি সব শেষ! ছয় বাই নয় ফুট ঘরটিতে গাদাগাদি অবস্থায় আমরা একটি ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছিলাম, আর ঠান্ডা, ভয় আর বেদনায় কাঁপতে থাকা পরিবারটিকে যতটা পারি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তারপরই তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলোর চিন্তা আমাদের আঘাত করে। এই হরতালের দিনে তো কিছুই চলছিল না। আমরা তাহলে ওর বাবাকে সমাহিত করি কিভাবে? শেষকৃত্যই বা করা হবে কিভাবে? পরিবার ও বন্ধুদেরকে খবরই বা পৌঁছানো হবে কী করে? ছেলেরা এই সাতসকালে শহরময় ঘোরাঘুরি করতে ভয়ও পাচ্ছিল, পাছে সন্দেহজনক তৎপরতার অভিযোগে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, ফলে লিন, রিড আর আমিই বেরিয়ে পড়ি।

বসুদের বাড়ির সামনের বড় রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত চার্চ অভ ইংল্যান্ডে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান হয়। মৃত্যুর খবরটি মুখে মুখেই ছড়িয়ে গেলে, লোকজন, এমনকি দুই মাইল দূর থেকেও, শ্রদ্ধা জানাতে আসে। কিন্তু শহর থেকে তিন মাইল দূরের কবরস্থানে আমরা মৃতদেহটি নিয়ে যাই কিভাবে? ঝুঁকি নিয়ে হলেও নিজেদের একটি গাড়ি বার করা ছাড়া আর কোনো সমাধান দেখি না আমরা। এদেশে মৃতদেহকে ঠান্ডাঘরে রাখার সুবিধা না থাকাতে, এবং দিনের তাপমাত্রাও দ্রুত বাড়ার কারণে, হরতাল শেষ হওয়া পর্যন্ত কবর দেওয়ার কাজটুকু স্থগিত রাখতে পারিনি আমরা। রিড মিনিখ তাঁর ল্যান্ডরোভারটিকে রাস্তায় বার করে আনেন (এটিকে চালু করতে সবসময়ই একটা বাড়তি ধাক্কার দরকার হতো) এবং প্রার্থনা করতে করতে কোনোমতে গির্জা অব্দি নিয়ে যান। শেষকৃত্য অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরে, কারা কারা সমাধিক্ষেত্রে যাবেন তা নিয়ে লম্বা বাক্য বিনিময় হয়। অবশেষে শবমিছিল বার হয়, পরিবারের ছেলেদের দুই বন্ধু গাড়ির হুডের ওপর চড়ে বসে, আর চারপাশে ও পেছনে যতজন আঁটে উঠে পড়ে, ‘লাশের গাড়ি’, ‘লাশের গাড়ি’ বলতে বলতে কবরখানার দিকে এগিয়ে চলে।

শেষকৃত্যের চব্বিশদিন পর আজ বসুপরিবারের লোকজন আমাদের বাড়িতে থাকতে আসে। তারা আসার কয়েক মিনিট পরই, জব্বার নামে যে-তরুণটি আমাদের সঙ্গে অনেকদিন যাবত কাজ করছিল সে এসে উপস্থিত হয় তার বউ নিয়ে। সে মুখ-ঢাকা কালো বোরখা পরিহিত ছিল, তার কোলে একটি বাচ্চা আর হাতধরা দুই বছরের আরেকটি। তারা মালপত্র যা পারে হাতে করে নিয়ে আসে, বাকিগুলো ফেলে আসে বাড়িতে, চুরি হয়ে যাবার জন্য। আমাদের ‘শরণার্থী শিবির’ দ্রুত ভরে ওঠে।

তারা, এবং আরো যারা আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে পরে, তাদের জন্য উদ্বেগ আর ভয়ে ভরা দিনগুলো অপেক্ষা করছিল সামনে।

২৮শে মার্চের ডায়রির লেখা আমার: দিনটিকে অবশ্যই রবিবারের মতো লাগছে না। আমরা সকালের নাস্তার জন্য ডালপুরি তৈরি করি। এরপর রিড তাঁর বাড়ি চলে যান গোসল ও শেভ করার জন্য। আমাদের এখানে খুব অল্পই পানি ছিল। বাঙালিরা আমাদের এলাকার পানির লাইন বন্ধ করে দিয়েছিল, যেন নেভাল হেডকোয়ার্টারে ঘাঁটি করে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের একটু শাস্তি হয়। আমাদের কেরোসিনও প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তখনও বিদ্যুৎ ছিল, ফলে আমরা বৈদ্যুতিক যন্ত্রে রান্না করতে পারছিলাম।

সারাদিনই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে একটা ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিল বারবার।

“বিশ্ববাসী। জানা গেছে যে, সাগর ও আকাশপথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরো অনেক সৈন্য এসেছে আমাদের দেশে। আমি তাই পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক দেশকে মুক্তিকামী বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানচ্ছি।”

তারপর বাংলা ভাষায় চট্টগ্রামের সকল জনগণকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে একটি নির্দিষ্ট সভাস্থলে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদেরকে যোদ্ধাদলে সংগঠিত করা হবে। আমাদের এলাকার লোকেরা এই আহ্বানে সাড়া দেয়। আমরা বাড়ির পুরুষদের দলবেঁধে সেখানে যেতে দেখি। কিন্তু আপনি শিকারের বন্দুক কিংবা কুড়ালকে কিভাবে লুকিয়ে নিয়ে যাবেন? যখন দেখা গেল অস্ত্রশস্ত্র হাতে লোকদের দেখে গুলি করে মারা হচ্ছে, তখন এই ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। পরিবর্তে লোকজনদের যার যার মহল্লায় থাকতে বলা হলো। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কেরা নিজেরা গিয়ে তাদেরকে যুদ্ধের কলাকৌশল শিখিয়ে দেবে।

বিদেশি বেতারকেন্দ্রগুলো খবর দেয় যে, ঢাকা থেকে মোট ২৫ জন বিদেশি সংবাদদাতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। লরেন জেন্কিন্স ১২ এপ্রিলের নিউজউইকে ব্যাখ্যা করে লেখেন।

আমরা এতকিছু দেখেছি যা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গেই মানায়... আমাদেরকে বলা হলো বাঁধাছাদা করে আধঘণ্টার মধ্যে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে। তার দুই ঘণ্টা পরে আমাদেরকে চারটি আর্মি ট্রাকে গাদাগাদি করে তুলে সেনাপ্রহরায় ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে আমাদের শরীর তল্লাশি করা হলো এবং অধিকাংশ নোট ও ফিল্ম কেড়ে নেওয়া হলো। একটা বেসামরিক বিমানে করে আমাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে আমাদেরকে আরেকবার তল্লাশি করা হয়। আমার টাইপরাইটার ও রেডিয়ো খুলে ফেলা হয়, এবং রেডিয়োর ব্যাটারির খোপে রাখা দুই রোল ছবি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়। আমাকে তারপর আরেকটি ঘরে নিয়ে উলঙ্গ-তল্লাশি করে অন্তর্বাসের ভেতর লুকিয়ে রাখা আরেকটি ফিল্মের রোলও নিয়ে নেওয়া হয়। ”তোমার এখন স্রেফ স্মৃতিই সম্বল,” এই বলে এক সেনাসদস্য ব্যাঙ্গের হাসি হাসে।

বিকেল সাড়ে চারটায় আমরা রবিবারের প্রার্থনা সারি। রিড বাইবেলের স্তোত্র ৯১ থেকে পাঠ করেন। আমাদেরকে সাহস ও শক্তি যোগানোর পাশাপাশি তিনি বাংলা বাইবেলের একটি শব্দ নিয়ে কিঞ্চিৎ মজাও করেন। শ্লোক ছয় থেকে তিনি পাঠ করেন, ‘‘The pestillence that walketh in darkness’’, এর বাংলা করতে গিয়ে তিনি ’বিহারী’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন—আর আশা করছিলেন আমরা তাতে ভয় পাব না!

রিড বিভিন্নজনকে ডাকতেন প্রার্থনাসভার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। কিশোর স্বপনকে দিয়ে তিনি শুরু করেন। আর সব বাঙালির মতোই ঈশ্বর ও প্রভুর বন্দনায় প্রচুর কবিত্বময় বাক্য প্রয়োগ করে সে অবশেষে আসল কথায় আসে।

“প্রভু, আপনি জানেন আমাদের এখানে পানি নেই, আর পানি ছাড়া চলা খুব কষ্ট। দয়া করে আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করুন।”

আমাদের ঈশ্বর, যিনি ছোট ছেলেদের বাংলা প্রার্থনাও শোনেন, তিনি স্বপনের আবেদন মঞ্জুর করবেন দ্রুতই। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৪)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৩)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ২)

কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১)

দারুণ সৌভাগ্য আমাদের



মহীবুল আজিজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ধরো তোমার যদি জন্ম না হতো...

আমি ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া ইতিহাসের
গলিটার দিকে তাকাই।
ওপার থেকে ছিটকে আসে বিগত কালের আলোক,
ইহুদিদের চর্বি দিয়ে সাবান বানিয়েছিল জার্মানরা।
বাথটাবে সেই সাবানের ফেনার মধ্যে ঠেসে ধরে
ওরা ঠাপাতো ইহুদি মেয়েদের।
পাকিস্তানিরা ঐভাবেই ঠাপাতো আমাদের।
ধরো তোমার যদি জন্ম না হতো...
সিন্ধু থেকে আসতো আমাদের জেলা প্রশাসকেরা,
পেশোয়ার থেকে গভর্নরেরা।
স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হেডটিচার
প্রিন্সিপাল ভিসি'রা আসতো লাহোর করাচি মুলতান থেকে।
ফ্যালফেলে তাকিয়ে আমরা ভাবতাম,
আহা কবে জন্ম নেবে আমাদের মেসায়া!
নেপথ্যে ভেসে আসতো অদম্য কুচকাওয়াজের শব্দ।
ধরো তোমার যদি জন্ম না হতো...
আমরা লম্বা লম্বা পাঞ্জাবি পরতাম গোড়ালি পর্যন্ত।
ঘরে ঘরে রবীন্দ্রনাথ নজরুলের গান বাজতো কাওয়ালির সুরে--
আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের নাম ভুলে যেতাম
কিন্তু জিন্না'কে ভুলতাম না।
ধরো তোমার যদি জন্ম না হতো...
ঢাকার মাঠে খেলা হতো পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের।
প্রত্যেকটি খেলায় একজন করে সুযোগ পেতো
বাঙালি টুয়েল্ফথৃ ম্যান যারা মূল খেলোয়াড়দের
বিশ্রাম দেবার জন্য প্রচণ্ড দাবদাহের রোদে
প্রাণপণ ফিল্ডিঙয়ের ওস্তাদি দেখাতো।

আমাদের কাজ হতো শুধু
পাকিস্তানিদের চার-ছয়ে উদ্দাম হাততালি দেওয়া,
হাততালি দিতে দিতে তালু ফাটিয়ে ফেলা।
তীব্র হাততালির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি
আজ মার্চের সতেরো।
দারুণ সৌভাগ্য আমাদের তুমি জন্ম নিয়েছিলে!
১৭-০৩-২০২৩

;

বঙ্গীয়’র কিশোরগঞ্জ কমিটি গঠনের দায়িত্বে শাহ্ ইস্কান্দার আলী স্বপন



মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
বঙ্গীয়’র কেন্দ্রীয় সভা অনুষ্ঠিত

বঙ্গীয়’র কেন্দ্রীয় সভা অনুষ্ঠিত

  • Font increase
  • Font Decrease

ঝদ্ধ মননের প্রাগ্রসর ভূমিপুত্র শাহ মাহতাব আলী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান ও মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা শাহ ইস্কান্দার আলী স্বপন বঙ্গীয়’র কিশোরগঞ্জ কমিটি গঠনের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় মাল্টিমিডিয়া নিউজ পোর্টাল বার্তা২৪.কম'র কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ও কিশোরগঞ্জ নিউজ'র নিয়মিত লেখক।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি,শিল্প, সংগীত, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরার বহুল কার্যক্রম নিয়ে দেশের প্রাচীনতম ও অগ্রণী প্রতিষ্ঠা নবঙ্গীয় সাহিত্য- সংস্কৃতি সংসদ’র এক সভা এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

শনিবার (১১মার্চ ২০২৩) বিকেল ৪-৩০ টায় রাজধানীর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় নাট্যশালার কনফারেন্স হলের ভিআইপি সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় দেশের বরেণ্য শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্হিতিতে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গীয় সাহিত্য- সংস্কৃতি সংসদ’র মূখ্য উপদেষ্টা
কবি ও গীতিকার আজিজুর রহমান আজিজ। এতে সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম সঞ্চালনা করেন।

সভায় বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদের সদস্য বার্তা২৪.কম'র কন্ট্রিবিউটিং এডিটর লেখক, কমামিস্ট ও গীতিকার শাহ্ ইস্কান্দার আলী স্বপনকে বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ’র কিশোরগঞ্জ জেলা শাখা গঠনের দায়িত্ব আরোপ করে তার হাতে বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ’র ইশতেহার তুলে দেন বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ’র মূখ্য উপদেষ্টা কবি ও গীতিকার আজিজুর রহমান আজিজ এবং সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম এবং অন্যান্য নেতৃবর্গ ।

এতে আরো বক্তব্য রাখেন বঙ্গীয়'র জার্মানির সভাপতি কবি নাজমুন নেসা পিয়ারী, বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক আমিনুর রহমান বেদু, রবীন্দ্র একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সংগীতশিল্পী বুলবুল মহলানবিশ, ইউনেস্কোর ব্রান্ড এম্বাসেডর নাজমুল হাসান সেরনিয়াবাত, বঙ্গীয়'র সভাপতি পর্ষদের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. শাহিনুর রহমান, বঙ্গীয়'র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে আলী নিয়ামত, কবি নাঈম আহমেদ, বঙ্গীয়'র কেন্দ্রীয় সদস্য কবি মীনা মাশরাফী, কবি পারভিন আক্তার সহ প্রমুখ।

সভার প্রথম পর্বে আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র সম্মিলন উদযাপন বিষয়ক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কবি আজিজুর রহমান আজিজকে আহবায়ক এবং সংগীতশিল্পী শামা রহমানকে সদস্য সচিব করে উদযাপন কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে বঙ্গীয়র সভাপতি পর্ষদের সকল সদস্য, রবীন্দ্র একাডেমির নির্বাহী শাখার সকল সদস্য, বঙ্গীয়র যুগ্ম সম্পাদকবৃন্দসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিশিষ্টজনকে নিয়ে পূর্নাঙ্গ কমিটি গঠিত হবে।

দ্বিতীয় পর্বে অযুত তারুণ্যের বঙ্গবন্ধু সম্মিলন, দ্বিশতজন্মবর্ষে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্মরণ, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত গ্রন্থ নিয়ে লেখক কবির আলোচনা সম্পন্ন হয়।

অনুষ্ঠানে সাংগঠনিক কার্যক্রমকে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে ইউনাইটেড নেশন্সের ব্রান্ড এম্বাসেডর জনাব নাজমুল হাসান সেরনিয়াবাতকে সভাপতি পর্ষদের সদস্য, শিশু সাহিত্যিক হুমায়ূন কবির ঢালীকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক , সংস্কৃতি সেবক রোকনউদ্দীন পাঠানকে সাংগঠনিক সম্পাদক, কবি আনোয়ার কামালকে লিটল ম্যাগ সম্পাদক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি সাংবাদিক শাহ ইস্কান্দার আলী স্বপনকে নির্বাহী সদস্য ও কিশোরগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক, কবি মীনা মাশরাফীকে নীলফামারী জেলার সমন্বয়ক, জনাব এ এইচ এম সালেহ বেলালকে গাইবান্ধা জেলার সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন, বীরমুক্তিযোদ্ধা লেখক কবি আবদুল হালিম খান, বীরমুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, কবি মানিক চন্দ্র দে, কবি অর্ণব আশিক, কবি বাবুল আনোয়ার, দৈনিক বঙ্গজননীর সম্পাদক কামরুজ্জামান জিয়া, কবি শাহানা জেসমিন, কবি গবেষক আবু সাঈদ তুলু, চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. বিশ্ব রায় (কলকাতা), বঙ্গীয় চট্রগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ফ্যাশন ডিজাইনার আমিনা রহমান লিপি, শিল্পী শাহরিয়ার পিউ, কবি সোহরাব সুমন, কবি সরকার পল্লব, কবি রহিমা আক্তার মৌ, কবি লিলি হক, কবি আকমল হোসেন খোকন, শাহ ইস্কান্দার আলী স্বপন, হিরা পারভেজ, ড. দিপু সিদ্দিকী, শিক্ষক ও কবি রওশন ই ফেরদৌস, কবি পারভীন আক্তার, কবি শিল্পী মাহমুদা, পূর্বধলার মো. জাকির হোসেন তালুকদার, কবি আনারকলি, কবি অপরাজিতা অর্পিতা, ডা. নূরুল ইসলাম আকন্দ, আবৃত্তিশিল্পী যথাক্রমে রূপশ্রী চক্রবর্তী, রবিউল আলম রবি সরকার, জেবুন্নেছা মুনিয়া, চন্দনা সেনাগুপ্তা, কবি সংগঠক রাজিয়া রহমান, কবি শামীমা আক্তার, শিল্পী সাদিয়া শারমিন, কবি কনক চৌধুরী, কবি তাসলিমা জামালসহ প্রমুখ।

;

কলকাতায় রাইটার্স ওয়ার্ল্ডের সাহিত্য উৎসব



মাহমুদ হাফিজ
কলকাতায় রাইটার্স ওয়ার্ল্ডের সাহিত্য উৎসব

কলকাতায় রাইটার্স ওয়ার্ল্ডের সাহিত্য উৎসব

  • Font increase
  • Font Decrease

কলকাতায় শুরু হয়েছে রাইটার্স ওয়ার্ল্ডের তিন দিনব্যাপী সাহিত্য উৎসব। শুক্রবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দুমতি সভাগৃহে বিকালে এ উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। এবারের উৎসবে বাংলাদেশের কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, পরিব্রাজক ও ভ্রমণগদ্য সম্পাদক মাহমুদ হাফিজ, স.ম. শামসুল আলম, নাহার আহমেদ, ড. নাঈমা খানম প্রমুখকে সম্মানিত করা হয়।

বিকালে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক নলিনী বেরা। বিশিষ্ট নাট্যকার চন্দন সেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য ও কবি সব্যসাচী দেব। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন রাইটার্স ওয়ার্ল্ডের সাধারণ সম্পাদক কবি সুরঙ্গমা ভট্টাচার্য। এতে সমাপণী বক্তৃতা করেন সংগঠনের সভাপতি কবি স্বপন ভট্টাচার্য। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য।

আজ ও আগামীকাল ভবানীপুর এডুকেশন সোসাইটি হলে বিকাল থেকে কবিতা ও গল্পপাঠ, আলোচনা, শ্রুতিনাটক, সঙ্গীত অনুষ্ঠিত হবে। রাইটার্স ওয়ার্ল্ডের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ, নেপাল, আসাম, ত্রিপুরার কয়েশ’ কবি লেখক অংশগ্রহণ করছেন।

;

কিশোরগঞ্জে মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের 'বইয়ের সাথে মাহে রমজান বরণ' কর্মসূচি



কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কিশোরগঞ্জে মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের 'বইয়ের সাথে মাহে রমজান বরণ' কর্মসূচি

কিশোরগঞ্জে মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের 'বইয়ের সাথে মাহে রমজান বরণ' কর্মসূচি

  • Font increase
  • Font Decrease

করোনাকালে বন্ধ থাকার পর আবারো 'বইয়ের সাথে মাহে রমজান বরণ' কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে কিশোরগঞ্জের শিল্প, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক উদ্যোগ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনে। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে 'বইয়ের সাথে মাহে রমজান বরণ' কার্যক্রমে ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ রচিত 'কোরআন-হাদিসের আলোকে মানবজীবনে রমজান' বইয়ের একশত কপি শুভেচ্ছামূলক প্রদান করা হবে। 

উল্লেখ্য, আগেও ইংরেজি নববর্ষে এবং ভাষার মাসে শত বিশিষ্টজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থ উপহার দিয়েছিল ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ. এ. মাজহারুল হক ও সমাজসেবী নূরজাহান বেগম প্রতিষ্ঠিত কিশোরগঞ্জের শিল্প-সাহিত্য-সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা 'মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন' এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আনসার বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার নামে গঠিত 'শাহ মাহতাব আলী ফাউন্ডেশন'। অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার ছিল স্থানীয় নিউজ পোর্টাল কিশোরগঞ্জ নিউজ।

মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের পক্ষে জানানো হয়েছে যে, বরকতময়, নেয়ামতপূর্ণ মাহে রমজানের সঙ্গে অন্য কোনো মাসের তুলনা চলে না। রোজা হলো মাহে রমজানে অবশ্য পালনীয় ফরজ আমল, যার পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা নিজে দেবেন। মানবজীবনে রোজা একজন বান্দার আত্মীক ও শারীরিক কল্যাণের ও উন্নতির গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। তদুপরি, রমজান মাসকে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা তাঁর অপার ক্ষমা, দয়া আর অপরিসীম করুণা দিয়ে বান্দাদেরকে উপহার দিয়েছেন। রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত রোজা সঠিকভাবে পালন করলে রোজাদার নবজাতক শিশু মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রোজা রাখবে তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে মানব জীবনে ও সামাজিক ব্যবস্থায় রমজান মাস ও রোজার গুরুত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে ফাউন্ডেশন প্রদত্ত গ্রন্থে। এ গ্রন্থ রমজান মাসের তাৎপর্য এবং রোজার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পাঠকদের সামনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে ৩০টি সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ের মাধ্যমে।

'কোরআন-হাদিসের আলোকে মানবজীবনে রমজান' বইয়ের লেখক মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মাহফুজ পারভেজ। তাঁর পিতা: ডা. এ.এ, মাজহারুল হক, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। মাতা: নূরজাহান বেগম, সমাজসেবী। ড. মাহফুজ পারভেজের জন্ম: ৮ মার্চ ১৯৬৬, কিশোরগঞ্জ শহরে। পড়াশোনা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (পিএইচ,ডি)। পেশা: অধ্যাপনা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। লেখালেখি, গবেষণা ও সাহিত্য সাধনায় ব্রতী। প্রকাশিত গ্রন্থ কুড়িটি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- গবেষণা-প্রবন্ধ: বিদ্রোহী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শান্তিচুক্তি, দারাশিকোহ: মুঘল ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো। দ্বিশত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর। উপন্যাস: পার্টিশনস, নীল উড়াল। ভ্রমণ: রক্তাক্ত নৈসর্গিক নেপালে। গল্প: ইতিহাসবিদ, ন্যানো ভালোবাসা ও অন্যান্য গল্প। কবিতা: মানব বংশের অলংকার, আমার সামনে নেই মহুয়ার বন, গন্ধর্বের অভিশাপ। অধ্যাপনা ও গবেষণা ছাড়াও তিনি বাংলাদেশের শীর্ষতম মাল্টিমিডিয়া পোর্টাল বার্তা২৪.কম'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর এবং কিশোরগঞ্জকে জানার সুবর্ণ জানালা কিশোরগঞ্জ নিউজ'র উপদেষ্টা সম্পাদক রূপে সংযুক্ত রয়েছেন।

কিশোরগঞ্জের শিল্প, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক সামাজিক উদ্যোগ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের  'বইয়ের সাথে মাহে রমজান বরণ' কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজিত হবে রমজান মাসের প্রথম সপ্তাহে। এ কার্যক্রম সমন্বয় করবেন কিশোরগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক, ইতিহাসবিদ ও পাঠাগার আন্দোলনের অগ্রণীজন মু আ লতিফ। সমন্বয় কমিটিতে আরো রয়েছেন কিশোরগঞ্জ নিউজ'র প্রধান সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, শাহ মাহতাব আলী ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শাহ ইসকান্দার আলী স্বপন, সাংস্কৃতিজন লুৎফুন্নেছা চিনু ও চিকিৎসক নেতা ডা. গোলাম হোসেন।

মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের পক্ষে আরো জানানো হয় যে, ইতিপূর্বে ঘোষিত ৬ষ্ঠ এবং ৭ম মাজহারুন-নূর সম্মাননা বক্তৃতা ২০২০ এবং ২০২১ করোনাকালের বিরূপ পরিস্থিতিতে স্থগিত থাকায় তা যৌথভাবে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হবে। ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. এএ মাজহারুল হক এবং সমাজসেবী নূরজাহান বেগম প্রতিষ্ঠিত কিশোরগঞ্জের শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজসেবা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্থা 'মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন' কর্তৃক কিশোরগঞ্জের জীবিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জীবনব্যাপী বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতি জানাতে ও ঐতিহাসিক মূল্যায়ন করতে ২০১৫ সাল থেকে এ সম্মাননা বক্তৃতা আয়োজন করা হচ্ছে, যা বক্তৃতা ও লিখিত আকারে প্রদান করেন মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মাহফুজ পারভেজ।

মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন' গতানুগতিক সম্মাননার বদলে ব্যক্তির কর্ম ও কীর্তির বিশ্লেষণমূলক-মূল্যায়নভিত্তিক সম্মাননা বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর প্রকৃত স্বরূপ চিহ্নিত করে এবং এরই ভিত্তিতে জ্ঞাপন করা হয় যথাযথ সম্মান। সম্মাননা স্মারকের পাশাপাশি লিখিত আকারে বক্তৃতা-পুস্তিকায় চিত্রিত হন সম্মাননা প্রাপ্তগণ। মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন এই বুদ্ধিবৃত্তিক-একাডেমিক আবহে ধারাবাহিকভাবে সম্মাননা বক্তৃতার আয়োজন করে আসছে, যা কিশোরগঞ্জে তো বটেই, বাংলাদেশের মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। শুরু থেকে সম্মাননা বক্তৃতা প্রদান করেন ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসর, বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী ড. মাহফুজ পারভেজ, যিনি কিশোরগঞ্জে পাবলিক লেকচার সিরিজের মাধ্যমে গণবুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর তৈরির পথিকৃৎ।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে প্রথম মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা পান শিক্ষাবিদ প্রাণেশ কুমার চৌধুরী, ২০১৬ সালে দ্বিতীয় মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা পান দীপ্তিমান শিক্ষকদম্পতি: অধ্যক্ষ মুহ. নূরুল ইসলাম ও বেগম খালেদা ইসলাম, ২০১৭ সালে তৃতীয় মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা পান ‘প্রজ্ঞার দ্যুতি ও আভিজাত্যের প্রতীক: প্রফেসর রফিকুর রহমান চৌধুরী’ এবং ২০১৮ সালে চতুর্থ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা পান ‘ঋদ্ধ মননের প্রাগ্রসর ভূমিপুত্র: শাহ্ মাহতাব আলী’। ২০১৯ সালে পঞ্চম মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা দেয়া হয় 'স্বাস্থ্যসেবা-শিক্ষায় পথিকৃৎ চিকিৎসক-দম্পতি' প্রফেসর ডা. আ ন ম নৌশাদ খান ও প্রফেসর ডা. সুফিয়া খাতুনকে। ৬ষ্ঠ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা-২০২০ প্রদান করা হয় নাসিরউদ্দিন ফারুকী, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন ও শাহ আজিজুল হককে। এ উপলক্ষে ‘কিশোরগঞ্জে আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস’ শীর্ষক সম্মাননা বক্তৃতা বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা সম্ভব হয়নি।

৭ম মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা-২০২১ প্রদান করা হয়েছে ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, পাঠ ও পাঠাগার আন্দোলনের অগ্রণীজন মু.আ. লতিফ,  মুক্তিযোদ্ধা-শিক্ষাবিদ ঊষা দেবী এবং শতবর্ষ অতিক্রমকারী ১২০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আলীমুদ্দীন লাইব্রেরীকে, যারা কিশোরগঞ্জের সামাজিক ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বিন্যাসে স্বকীয় কৃতিত্বের প্রভায় উজ্জ্বল। জীবনব্যাপী কিশোরগঞ্জের মাটি ও মানুষের জন্য শৈল্পিক দ্যোতনায় নান্দনিক বর্ণালী সৃজন করেছেন এই তিন গুণান্বিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ জানান, ৬ষ্ঠ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২০ এবং ৭ম মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২১ একসাথে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, যা মার্চ মাসের শেষ দিকে আয়োজিত হবে।

;