আলাউদ্দিন আল আজাদ: আপাদমস্তক একজন লেখক
বহুমাত্রিক লেখক, শিক্ষাবিদ, কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, গবেষক, সাহিত্য-সমালোচক আলাউদ্দিন আল আজাদের (১৯৩২-২০০৯) সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলাম জীবনের একটি পর্যায়ে। মধ্য আশি দশকে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের সূচনা। নব্বই দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়ে তাঁকে পাই সিনিয়র সহকর্মী রূপে। বহু দিনের দীর্ঘ দীর্ঘ সময় কেটেছে তাঁর সঙ্গে। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন লেখক। আত্মমগ্ন ও ভাবুক।
তাঁর জন্ম ৬ মে ১৯৩২ সালে, নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে। মৃত্যু ঢাকায়, ৩ জুলাই ২০০৯ সালে।
দেখতে দেখতে এতো বছর হয়ে গেলো তাঁর মৃত্যু। প্রচণ্ড সংগ্রাম করেছেন তিনি জীবনভর। শেষ জীবনেও লেখালেখির জন্য পরিবার-পরিজন থেকে দারে থেকে পরিত্যাগ করেছেন আরাম-আয়েশ। পড়াশোনা ও লেখার মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে তাঁর পুরোটা জীবন।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ছিলেন কৃতি ছাত্র। অত্যন্ত পশ্চাৎপদ একটি এলাকা থোকে স্বীয় মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি জীবনে সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালে নারায়ণপুর শরাফতউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করেন তিনি। তারপর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (১৯৪৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক (১৯৫৩) ও স্নাতকোত্তর (১৯৫৪) এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবন ও কবিতা বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি (১৯৭০) লাভ করেন। পরে তিনি অরগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে উচ্চ প্রশিক্ষণও (১৯৮৩) গ্রহণ করেন।
আলাউদ্দিন আল আজাদ অধ্যয়নকালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ও বার্ষিকী সম্পাদকের দায়িত্ব (১৯৪৭-৪৯) পালন করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (১৯৫৩-৫৪), ঢাকা জেলা যুবলীগের সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সহসভাপতি (১৯৫৭-৬০) ছিলেন। পাকিস্তানের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁকে সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত করে। দেশ বিভাগের পরে তিনি দেশের চলমান প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
ছাত্রাবস্থায় আলাউদ্দিন আল আজাদ সংবাদপত্রে খন্ডকালীন চাকরি করেন। অধ্যয়ন শেষে তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ (১৯৫৫), ঢাকা জগন্নাথ কলেজ (১৯৫৬-৬১), সিলেট এমসি কলেজ (১৯৬২-৬৮) এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ (১৯৬৪-৬৭)-এ অধ্যাপনা করেন। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন এক বছর (১৯৭৪-৭৫)। কিছুকাল (১৯৭৬-৮১) মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে Education Attaché কাজ করার পর তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টার দায়িত্ব (১৯৮২-৮৯) পালন করেন। এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল প্রফেসর ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব (১৯৯০-৯২) পালন করেন।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আবির্ভাব। এ সময়ে যাঁরা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। প্রগতিশীল ও মানবতাবাদী ভাবধারায় তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। প্রথম জীবনে গ্রামের মানুষ ও তাদের সংগ্রাম, প্রকৃতির ঐশ্বর্য ও সংহারমূর্তি দুইই তাঁর মনে ছাপ ফেলে গেছে। নগরজীবনের কৃত্রিমতা, রাজনীতিক সংগ্রাম, নিপীড়ন, প্রতারণা তিনি তাঁর কথাসাহিত্যের বিষয়বস্ত্ত করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগন্থ জেগে আছি (১৯৫০), ধানকন্যা (১৯৫১), জীবন জমিন (১৯৮৮) প্রভৃতি। ষাটের দশকে রচিত তাঁর উপন্যাস, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০) ও কর্ণফুলী (১৯৬২) ব্যাপক সাড়া জাগায়। তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসটির বিষয়বস্ত্ত অবলম্বনে বসুন্ধরা নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত। এ চলচ্চিত্রটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে শীতের শেষরাত বসন্তের প্রথমদিন (১৯৬২), ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪), শ্যামল ছায়ার সংবাদ (১৯৮৬) উল্লেখযোগ্য। তাঁর মরক্কোর যাদুকর (১৯৫৯), মায়াবী প্রহর (১৯৬৩) ও ধন্যবাদ (১৯৬৫) অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ নাটক। তাঁর অন্যান্য নাটকের মধ্যে ধন্যবাদ (১৯৫১), নিঃশব্দ যাত্রা (১৯৭২), নরকে লাল গোলাপ (১৯৭২) প্রধান। তাঁর দুটি কাব্যনাট্য, ইহুদির মেয়ে (১৯৬২) ও রঙিন মুদ্রারাক্ষস (১৯৯৪)।
আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্য-সমালোচনা ও মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় শিল্পীর সাধনা (১৯৫৮), সাহিত্যের আগন্তুক ঋতু (১৯৭৪), নজরুল গবেষণা: ধারা ও প্রকৃতি (১৯৮২), মায়াকোভস্কি ও নজরুল (১৯৮৫), সাহিত্য সমালোচনা (১৯৮৯) প্রভৃতি গ্রন্থে।
ভাষা আন্দোলনে আজাদের অবদান ঐতিহাসিক হয়ে আছে তাঁর রচিত কবিতার মাধ্যমে। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন: 'স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?/ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চারকোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো!'
আলাউদ্দিন আল আজাদের কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে মানচিত্র (১৯৬১), ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ (১৯৬২), লেলিহান পান্ডুলিপি (১৯৭৫), নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ (১৯৮৩) সাজঘর (১৯৯০) ও শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৭) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিতে গণমুখী ও স্বদেশপ্রেমী সাহিত্যধারার লেখক হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধেও প্রেরণাদীপ্ত দায়িত্ববান শিল্পীর ভূমিকা গ্রহণ করেন। মানুষ ও সমাজ আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু, যার সঙ্গে মিশ্রিত আদর্শবোধ ও প্রগতিশীলতা।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য আলাউদ্দিন আল আজাদ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৪), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৪), জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার (১৯৭১), একুশে পদক (১৯৮৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৪) উল্লেখযোগ্য।
জীবনের ব্রত হিসেবে সাহিত্য সাধনাকে গ্রহণ করে আজাদ শত বিরূপতার মধ্যেও ছিলেন অবিচল। জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হননি তিনি কখনোই। সারাটা জীবন লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করে একজন প্রকৃত লেখকের দায় ও দায়িত্ব পালন করে গেছেন সৃজনের বহুমাত্রিক সৃষ্টি-সম্ভারের আলোকিত দ্যোতনায়।