কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১৩)



জিনি লকারবি ।। অনুবাদ: আলম খোরশেদ
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

মালুমঘাট থেকে পলায়ন

[পূর্বপ্রকাশের পর] বাংলাদেশের মালুমঘাটের মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতাল যতদিন থাকবে ততদিন বেকি ডেভি’র প্রথম ‘মেডিকেল ভুলের’ গল্পটি বলে যাওয়া হবে।

নার্সিং বিভাগের তূখোড় পরিচালকের সেই ঐতিহাসিক ভুলটি কী ছিল? যে-কোনোভাবেই হোক তিনি ডা. ডন কেচামকে একজন রোগীর কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, যার স্পষ্টতই একটা অপারেশনের দরকার ছিল। দেশি নার্সরা যখন এটা বুঝতে পারলেন এবং তার অপারেশন শুরু হলো, তখন রাত বাজে সোয়া নয়টা। সার্জারি থেকে ফিরে, দরজা খুলে ঘরে ঢুকে, ঘুমুতে ইচ্ছা হচ্ছিল না বলে, সে রেডিও খোলে—যা সে কালেভদ্রে করে থাকে। সে ভয়েস অভ আমেরিকাকে ধরতে পারে না সহজে, কেবল সোয়া এগারোটার খবর শেষ করার আগে-বলা সংবাদ শিরোনামের অংশটুকু শুনতে পারে। বেকি সেই সংবাদ সারাংশে শুনতে পায়: “এবারে মালুমঘাটে অবস্থানরত আমেরিকানদের জন্য একটি বিশেষ ঘোষণা। মার্কিন সরকার জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া আর সবাইকে অতি সত্বর সড়কপথে বার্মা সীমান্তের দিকে রওনা হতে জোরালোভাবে পরামর্শ দিচ্ছে। চট্টগ্রাম দিয়ে দেশত্যাগের পথ বন্ধ। আবারও বলছি: মার্কিন সরকার জোরালোভাবে ...”

বেশ কয়েকমাস বাদে রিড আমাদেরকে এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটটি জানান।

“বিমানে করে দেশত্যাগ-করা দলটি চট্টগ্রামের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিল যে, তারা জোর দিয়ে বলে, ‘আমাদের সমস্ত লোক যেন দেশ ছেড়ে চলে যায়’।”

“আমাদের আতঙ্ক আরো বেড়ে গেল যখন জানলাম, শহর থেকে পঁচিশ মাইল দূরে চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত ব্রিটিশ ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালটিকে কোনোপ্রকার সতর্কবাণী ছাড়াই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে। তাদের কুষ্ঠরোগীর বিভাগটায় একটা কামানের গোলা এসে আঘাত করে এবং তাতে এক রোগী নিহত হয়। চন্দ্রঘোনার আবাসিকেরা নিশ্চিত ছিল যে, যথেষ্ট আগে থেকে সতর্কবার্তা না দিয়ে মিলিটারিরা সেখানে আক্রমণ করবে না। তারা অপাত্রে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল।”

“সেনারা হাসপাতালে এসেই প্রত্যেকটা শয্যা পরীক্ষা করে দেখছিল সেখানে কোনো আহত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে কিনা। হাসপাতালের কর্মীদেরকে ভয় দেখানোর জন্য তারা বেশ কজন বাঙালিকে হাসপাতাল ভবনের সামনে দাঁড় করিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে।”

“চট্টগ্রামে অবস্থানরত তাদের ব্রিগেডিয়ার সাহেব মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালের কর্মীদের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে রাজি হলেন না। যদি মুক্তিবাহিনীর কোনো সদস্য হাসপাতালের আসে তাহলে তারা তক্ষুনি সেখানে অভিযান চালাবে।”

“এটা ছিল একেবারে ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেওয়া একটা সংবাদ। এই খবরটা নিশ্চয়ই দ্রুততার সঙ্গেই মালুমঘাটে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের লোকেরা হয়তো হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেছে এতক্ষণে। তাহলে এই খবরটা তাদেরকে কিভাবে পৌঁছানো যায়? চন্দ্রঘোনা আক্রমণের আগে কোনো সতর্কবার্তা পায়নি, মালুমঘাটও একই বিপদের মুখোমুখি। তাছাড়া সেখানে তখন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হারুন রয়েছেন!”

একটিই মাত্র উপায় রয়েছে—ভয়েস অভ আমেরিকা। তাদের সঙ্গে এমন ব্যবস্থা হয় যে, পরিস্থিতি দাবি করলে তারা আমাদের মিশনারিদের প্রতি যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাসমূহ সকাল সাতটা ও সন্ধ্যা সাতটায় তাদের কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করবে আমাদের উদ্দেশে। এখনই সেই সময়। অবশ্য ভয়েস অভ আমেরিকা মালুমঘাটের লোকদের এই মুহূর্তের বিপদ সম্পর্কে কিছু জানে না। ইউএস এইডের সেই কর্মকর্তা আর আমি দুজনে মাথা খাটিয়ে একটা বার্তা তৈরি করি। তখন বিকাল চারটা বাজে। বিস্ময়করভাবে, তিনি ঢাকায় যাওয়ার বিমান পেয়ে যান। তিনি এই বার্তাটি ভয়েস অভ আমেরিকাকে পাঠিয়ে দেন এবং তারা সেটি সেদিন রাতেই প্রচার করে দেয়।

বেকি দৌড়ে এসে সবাইকে এই খবরটা দেয়। আমরা ওয়াল্শের বাড়িতে জমায়েত হই এবং মধ্যরাতের খবর শুনি, কিন্তু তখন সেটাকে আর পুনরাবৃত্তি করা হয় না। আমাদের সমস্ত আলোচনার মধ্যে এই প্রথম আমরা সবাই সহমত হই যে, এই নির্দেশনা মেনে আমাদের বার্মার পথে রওনা দেওয়া উচিত। আমাদের অরণ্যকেন্দ্র হেব্রনে যাওয়ার পরিকল্পনাটিকে প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করা হয়।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়, ডা. ওল্‌সেন এবং ডা. ডন কেচাম থাকবেন এবং বাকিরা (সব মিলিয়ে ২৯ জন) চলে যাবে। এটাকে দাপ্তরিক সিদ্ধান্ত হিসেবে লিখে রাখা হয়। অন্যদের অনুপস্থিতিতে ভিক ওল্‌সেনকে ফিল্ড কাউন্সিল চেয়ারম্যান ও ডনকে সেক্রেটারি নির্বাচন করা হয়। ডিকুকেরা, যারা সদ্য তাঁদের প্রয়োজনীয় দুটো ফিল্ড কাউন্সিল মিটিংয়ে যোগ দেওয়া সম্পন্ন করেছেন, প্রথমবারের মতো ভোট দিতে পারেন।

সবাই বাড়ি ফিরে গোছগাছ করতে বসে। আশ্চর্যজনকভাবে, অন্যসময় রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে গেলেও, সেদিন প্রায় ভোর চারটা পর্যন্ত থাকে এবং ততক্ষণে আমাদের গোছানো হয়ে যায় (এমনকি বারান্দার সেইসব পুরনো কাপড় পর্যন্ত)।

একুশে এপ্রিল , বুধবার
তৈরি হবার জন্য খুব ভোরেই উঠে পড়ি। কেউ কি ঘুমিয়েছিল? ‘ভোয়া’র সকাল সাতটার সংবাদেও একই ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করা হয়। আমরা ঢাকার ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে এমন একটা ব্যবস্থা করি যেন আমাদের জন্য সকল ঘোষণাই সকাল ৭টা কিংবা সন্ধ্যা ৭টায় প্রচার করা হয়। প্রথমবার যে-ঘোষণাটা রাত এগারোটায় দেওয়া হয়েছিল সেটা এর গুরুত্ব অনুধাবন করে। আমরা শেষ পর্যন্ত সকাল ৯টায় মালুমঘাট ছেড়ে যাই।

দেশি ভাইবোনেরা এতটাই মন খারাপ করেছিল যে, আমাদের বিদায় নিতে কষ্ট হয়েছিল খুব। কেউ কেউ অবশ্য বুঝেছিল, আমাদের যাওয়া উচিত, তবে তাদের মনে হচ্ছিল পৃথিবীর তলাটা বুঝি খসে পড়ে গেছে। তাদের এতজন প্রভুর চাইতেও মনে হয় আমাদের ওপর বিশ্বাস রেখেছিল বেশি। হয়তো ঈশ্বর আমাদের সরিয়ে নিয়েছিলেন তাদেরকে এটাই বোঝাতে যে, তাদেরও কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া উচিত। আমরা যতদিন এখানে থাকতাম তারাও থাকত। কেউ কেউ ধারণা দিয়েছিল, তারা হেব্রনের উদ্দেশে রওনা করবে। অন্যেরা বার্মা কিংবা ভারতে আশ্রয় নেবার কথা ভাবছিল।

একটা মন-ছুঁয়ে-যাওয়া মুহূর্ত ছিল যখন বাঙালিদের ক্রোধ থেকে আমাদের লুকিয়ে রাখা সেই পশ্চিম পাকিস্তানি দারোয়ান, বদ্ধ ঘরের পর্দা তুলে আমাদের চলে যাওয়া গাড়িগুলোকে বিদায়ী সালাম জানিয়েছিল।

আমাদের চট্টগ্রামের শরণার্থীদের এক কিশোর, বাবলার কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। সে ঠিক জানত না কী করবে। সে কি একটা ছোট ছেলে যে, এগিয়ে এসে গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে বিদায়-বলা আমাকে ছুঁতে পারবে, নাকি সে এতটাই বড় হয়ে গেছে যে, তাকে দূরত্ব বজায় রেখে ভদ্র আচরণ করতে হবে? সামনের মাসগুলোতে আমরা জানতে পারব, বাবলা মোটেও কোনো ছোট ছেলে নয়, বরং একজন শক্তিশালী, সাহসী মানুষ।

আমরা তিনটা ল্যান্ডরোভারে যাত্রা করি। আমরা যখন পথে নামি তখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, কিন্তু টেকনাফ পৌঁছানো মাত্র মুষলধারে ঝরতে শুরু করে। ক্রন্দসী আকাশ যেন সেই সকালে আমাদের মনের অবস্থা ও আবেগেরই প্রতিচ্ছবি ছিল।

তবে মেঘ ও বৃষ্টি আবহাওয়াটাকে ঠান্ডা করে দিয়েছিল, তা নাহলে গাড়িতে ঠাসাঠাসি করা এতগুলো লোকের পক্ষে এই গরম সহ্য করা কঠিন হত।

এলিয়ানোর ওয়াল্‌শ বলেন, “প্রভু আমাদেরকে রাতের বিদ্যুৎ আর এই দিনের বেলার রোদের হাত থেকে আশ্রয় দিয়েছিলেন; আমাদের নিজস্ব অগ্নি ও মেঘের স্তম্ভ।”

কক্সবাজারের উপকণ্ঠে বার্মা যাবার রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল। এই ব্যারিকেডটা আবার তালা দিয়ে আটকানো ছিল, আর তার চাবি যার কাছে ছিল তিনি তখন কক্সবাজার শহরে। জে সেটা আনতে গেলেন, আর ততক্ষণে আমরা একটা কফিবিরতি নিলাম। আমরা চিনির সন্ধান করছিলাম কিন্তু কোথাও চিনি পাওয়া গেল না। একজন দোকানি আমাদেরকে মাগনা কিছু দেশি গুড় এনে দেয়।

আমরা টেকনাফ যাওয়ার পথে বাইরে চমৎকার দৃশ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করি। টেকনাফে আমরা জোয়ার আসার জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করি যাতে করে সাম্পান ভাসতে পারে; সেই অবসরে বন্ধ দোকানের বারান্দায় বসে আমাদের ঝোলা খুলি। সেখান থেকে আমরা পর্ক ও শিমের বিচি, ভিয়েনার সসেজ, রুটি ও মধু-মাখন এবং সেই কে-রেশনের কিছু চকলেট ক্যান্ডি বার করে খাই।

পুরুষেরা সাম্পানে মাল তোলে, আর আমরা ঊনত্রিশজন সেই সাম্পানের খোলা তলদেশে পেতে রাখা বাঁশের বেঞ্চিতে বসে পড়ি। টেকনাফ থেকে ছয় মাইল দূরের মংদাউ যেতে নৌকাযাত্রায় দেড়ঘণ্টা লাগার কথা। আমরা খাঁড়ি ছেড়ে মূল নদীতে পড়ার সময় একটা সাইনবোর্ড দেখি যাতে লেখা, ‘টেকনাফ সীমান্তফাঁড়ি’।

ভালো বাতাস ছিল, তাই মাঝিরা পাল তোলার চেষ্টা করে। প্রথম চেষ্টায় একটা দড়ি ছিঁড়ে যায়, তবে গার্ল স্কাউট জোয়ান ওল্‌সেন সেগুলোকে গিঁট বেঁধে দেয় এবং দ্বিতীয় চেষ্টায় তারা সফল হয়। পাল তোলার পর দ্রুত এগুনো যায়, কিন্তু তারপরও সেটা অনেক লম্বা পথ ছিল। কয়েকবারই আমাদের বলা হয় মাথা নিচু করে বসে থাকতে, যাতে করে তীরবর্তী সীমান্তপ্রহরীরা আমাদের না দেখতে পায়। সন্ধ্যা নামলে তারা আমাদের একটু চুপ করতে বলে (অসম্ভব) যেন আমরা কোনো সন্দেহের উদ্রেক না করি। তাহলে মাঝিদেরকে আরো বড় অঙ্কের ঘুষ দিতে হবে।

মংদাউ তল্লাশি ফাঁড়ির ঘাটে আমরা ভিড়ি সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার দিকে এবং ছোট্ট আরেকটি সাম্পানের ছাদের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে লাফ দিয়ে পিচ্ছিল কাদাভরা তীরে অবতরণ করি। সবাই নিরাপদে নামতে সক্ষম হয়। তারপর আমরা আবিষ্কার করি যে, ওল্‌সেনের স্লাইডগুলো নৌভ্রমণের পুরো তিনঘণ্টাই ছিল সাম্পানের তলায় জমে থাকা পানির ভেতর। আমরা পানির ওপর একটি খোলা বাঁশের ঘরে গিয়ে জড়ো হই। বাচ্চাদের আমরা পিনাট বাটার, রুটি, কিসমিস ও পানি খাইয়ে দিই। একটা বড় কুকুরও এসে সেই ভোজে যোগ দিতে চাইছিল। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদেরকে একটা ডাকবাংলোয় নিয়ে গেল।

সেখানে আমরা পুরো বিল্‌স পরিবারকে আবিষ্কার করি; তাদেরকে সেখানে আটকে রাখা হয়েছিল, রেঙ্গুন থেকে তাদের দেশ ছাড়ার ছাড়পত্র আসার অপেক্ষায়। তারা আমাদেরকে দেখে তেমন বিশেষভাবে বিস্মিত হয়নি। তারা যেন জানতোই যে, আমরাও এসে হাজির হব অচিরেই।

এখন তাহলে মোট চৌত্রিশজন হলাম আমরা। এই অতিথিনিবাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন, যারা রেঙ্গুনের ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করার কথা ভাবছিলেন। সেখানে মোট ছয়টা চারপেয়েসহ তিনখানা ঘর ছিল আমাদের সবার জন্য। পুরুষ ও ছেলেরা একটা ঘরে শুলো। মার্ক ওল্‌সেন তাঁর টেনিস শু’কে বালিশ বানিয়েছিলেন, আর জো ডিকুক এক তাড়া টয়লেট পেপারকে। রাতের মাঝখানে, মেল বিল্‌সের ঠান্ডা অনুভূত হলে তিনি একজোড়া দরজার পর্দা নামিয়ে নেন, তারপর গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ছোট্ট বাচ্চা ও তাদের মায়েরা এক ঘরে এবং বড় মেয়েরা আরেক ঘরে ছিল।

তেরো বছরের বেকি কেচাম ভেবেছিল মিলিটারিরা এসে তাকে অত্যাচার করছে। সে সারা রাত খালি বলতে থাকে, উফ, উফ! সকাল বেলা আবিষ্কার করে, সে আসলে গায়ে একটা অসমাপ্ত সেলাইয়ের কাপড় জড়িয়ে ছিল, যেটার গায়ে তখনও পিনগুলো লেগে ছিল। ভাগ্য ভালো সেখানে কোনো ইঁদুর কিংবা মশা ছিল না—এবং বাঁদুড়গুলো দরজার বাইরেই অবস্থান করছিল। প্রধান অসুবিধা, রাতটা খুব ঠান্ডা ছিল। [চলবে]


কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১২)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১১)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ১০)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৯)
কর্মব্যপদেশে, একাত্তরের বাংলাদেশে: জনৈক মার্কিন সেবিকার স্মৃতিকথা (কিস্তি ৮)

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মনের বীক্ষণে দলিত, তপশিলি, নিম্নশ্রেণির ইতিহাস



সাৰ্থক লাহা
ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাস চর্চা দীর্ঘকাল ধরে মূলত রাজনীতি, রাজনৈতিক চিন্তা, রাজবংশ, রাজা-রাজত্বের মধ্যে সীমায়িত ছিল। আবার একইসাথে ইতিহাসের সংজ্ঞায়নে কেউ কেউ বলেছেন মহান মহান মানুষের জীবন অবতারনা বা আলোচনার নামই হল ইতিহাস। থমাস কার্লাইলের ভাষায়, 'ইতিহাস হল অসংখ্য মহান মানুষের আত্মজীবনির সারবস্তু’।

মূলত একটা সময় ইতিহাস মানে নেপোলিয়ান, আলেকজান্ডার, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, আকবর প্রমুখ মানুষদের জীবনীগাঁথা ও তাঁদের সময়কালকেই বোঝা হতো। কিন্তু ইতিহাসের যে অন্য অনুষঙ্গ আছে বা ইতিহাস যে সমস্ত শ্রেণির মানুষের ইতিবৃত্ত সেটা বুঝতে বেশ কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়।

মূলত গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে নিম্নবর্গের কথা ঐতিহাসিক কলমে উন্মোচিত হয়। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে ‘নিম্নবর্গের মানুষ কি সত্যিই কথা বলতে পারে?’- এই প্রশ্নের উত্তরে সজ্জিত উপাত্ত নিয়ে ইতিহাসে যে দলিত শ্রেনি, তপশিলি জাতির উচ্চারনও সমানভাবে প্রতীয়মান, সেই জায়গাটি বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার আলোকে যিনি সম্মুখে আনেন তিনি হলেন অন্যতম ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন। যার কলমে বিভিন্ন গ্রন্থে দলিত শ্রেনি, তপশিলি শ্রেণির তথা নিম্নশ্রেনির ইতিহাস, আত্মকথন, স্বকীয় রচনাগুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। লেখকের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

ইতিহাসচর্চা বস্তুনিষ্ঠতা, বিজ্ঞানবাদিতা, নিরপেক্ষতা সহ নানা নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে ক্রমশই অগ্রবর্তী হচ্ছে। ইতিহাসবেত্তাদের কলমে ক্রমশই পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, মহামারি, বিজ্ঞান, ক্রীড়াসহ নানাবিধ চর্চা বিশ শতকে নানা আবর্ত আলোচিত হতে দেখা যায়।

মুখ্যত বাংলা ভাষায় জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ বিষয়ক আলোচনার আবর্ত দীর্ঘকাল যাবৎ ইতিহাসচর্চাকারীদের কলমে অপাংক্তেয় অবস্থাতেই থেকে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক কালপর্বে এবং সাম্প্রতিকে কিছুক্ষেত্রে জাতিচেতনা, দলিত আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি হলেও মূলত তা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যেই সীমায়িত। কাজেই কলকাতার গাঙচিল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ এই গ্রন্থটি জাতপাতের ও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিকনির্দেশক গ্রন্থ তা বলাই যায়।

লেখক মূলত সমকালীন পশ্চিমবঙ্গকে এক্ষেত্রে অনুধাবন করেছেন। অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও ক্ষেত্রসমীক্ষা সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজন এবং অসংখ্য প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্তিকরনের প্রয়াসের ফসল এই গবেষণা গ্রন্থটি। শিরোনামেই ধরা পড়েছে গ্রন্থের মূল নির্যাস। যার মধ্যে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত, জাতি-হিংসা, তপশিলিদের সামাজিক স্তরীকরণে কী অবস্থা, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, নারীদের বৈষম্যকরনের পাশাপাশি ডান-বাম রাজনীতির আবহে এই তপশিলি জাতির চিত্রপটের স্বরূপ অনুধাবন, জাতিকেন্দ্রিক রচনা, কিছু ব্যক্তিত্বের বর্ননের সাথেও সরকারী নীতি, বিভাগ স্থাপন, প্রতিস্থান নির্মান ও নামকরন প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের সংযুক্তকরুন বইটিকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে।

রুপ কুমার বর্মনের গ্রন্থটিতে ভূমিকা, অধ্যায়ীকরন, উপসংহার, সুদীর্ঘ গ্রন্থ তালিকা সহ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের সন্নিবিষ্টকরন পরিলক্ষিত করতে পারি। গ্রন্থ তালিকায় প্রাথমিক তথ্যাদি সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক রচনা, অফিসিয়াল ও লেখ্যাগারের তথ্যাদি ও বৈদেশিক গ্রন্থের প্রয়োগ গ্রন্থটির প্রামাণ্যতাকে নির্দেশ করে। অতিরিক্ত তথ্যাদির এই ব্যবহার গ্রন্থটিকে আরো প্রাঞ্জল করেছে।

গ্রন্থটির ভূমিকাংশে জাতপাত এবং জাতি, বর্ণবাদের উৎপত্তির ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের বর্ণবাদের বিকাশ এবং ক্রমশই যে জাতপাতের ভারতীয় সমাজে নিম্নবর্ণীয়দের প্রান্তিকায়িত করার আভাস তার ব্যাখ্যা দেখতে পায়। লেখক ইসলামিক এবং ঔপনিবেশিক সময়কালেও গ্রন্থগুলি অবলোকন করে ভারতীয় সমাজের নিম্নবর্ণীয়দের কি অবস্থান, তারা কিভাবে জাতি বৈষম্যের শিকার সেই ব্যাখ্যা করেছেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন আইন এবং প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা মধ্য দিয়ে নিম্নবর্ণীয়দের অবস্থা যে ক্রমিক প্রভু-দাস সম্পর্কের (patron-client Relationship) বন্ধনে নিমজ্জিত হয়েছে। এবং প্রান্তিকিকরন হয়ে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা সেটা আমরা দেখতে পাই এবং স্বাধীনতার সময়কালে ভারতের নিম্ন বর্ণের জাতি জাতি হিংসা অবসানের যে প্রচেষ্টা এবং সেই প্রচেষ্টায় তপশিলি জাতি এবং জনজাতীয় অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতির স্বরূপ কতটা বিকাশমূলক হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবং খুব সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় প্রেক্ষিতে পরিবর্তনের অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন এবং সমকালীন পশ্চিমবঙ্গেও জাতপাতের যে ধারাবাহিকতা সেটির আলোচনা করেছেন।

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তপশিলি জাতি ক্রমিক কিভাবে মৌখিক তথা বাহ্যিক এবং মানসিক জাতপাতের শিকার হচ্ছে সেই নব ব্যাখ্যাও এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট।

গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে এই জাতপাত, জাতি-রাজনীতি, জাতি-হিংসা, জাতি-বৈষম্য এই বিষয়গুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত, জাতি হিংসা এবং সামাজিক সংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্তরীকরণের ক্ষেত্রে জাতপাতের যে গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্যাখ্যা যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি অন্য মেরুতে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে চলতে থাকা বাচিক, মানসিক, ব্যবহারগত জাতপাতের যে অন্ধকার দিক সেটি লেখক তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বাধীনতার পর্বে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনকালীন রাজনীতি জাতপাত বা জাতি রাজনীতি কে কতটা ত্বরান্বিত করেছে এবং তপশিলি জাতির বিকাশ তথা উন্নয়ন নাকি তপশিলিরা রাজনীতির শিকার হয়েছে সেই ব্যাখ্যায় আমরা মূলত সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষিত হতে দেখি।

গ্রন্থটির তৃতীয় অধ্যায় মূলত বাংলার নিম্নবর্ণীয়দের নিজস্ব স্বকীয় লেখনীর মাধ্যমে তাদের অবস্থা নির্ণয়ের বা নির্মাণের আলোকে উঠে এসেছে। খুব সুন্দর ভাবেই লেখক বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য, সৃজনধর্মী সাহিত্য অবলোকন এবং ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে নিম্নবর্ণের উত্থানের প্রশ্নটিই উত্থাপন করেছেন। গ্রন্থটির চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলার তপশিলি সমাজের থেকে রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বকরণ এবং বেশ কিছু নিম্নবর্ণীয় মানুষের বিস্মৃত স্মৃতির নতুন করে চর্চা এবং চর্যার জগতে আনার আলোকে রচিত হয়েছে।

জাতপাত, জাতি-বৈষম্য, জাতি রাজনীতি এই শব্দবন্ধগুলি ভারতীয় সমাজের আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমানভাবেই বহমান হয়ে রয়েছে। সমাজে অন্যকে দেখার মানসিকতা, প্রভু-দাসত্বের সম্পর্ক উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের রূপক বর্তমান বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির যুগেও সমভাবেই জাজ্বল্যমান সেটি পরিস্ফুটিত হয়েছে। গ্রন্থটি অনুধাবন করলে আমরা এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা ফুটে উঠতে দেখতে পারি। কাজেই শুধুমাত্র ইতিহাস চর্চার আলোকে বা ইতিহাস পাঠকদের কাছেই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে এই বইটির এক অন্যকথনের গল্প বলে যে গল্প জাতপাত, জাতি হিংসা, বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ের সংযোজনে জাতপাতের ইতিহাসে এই গ্রন্থটির গুরুত্বকে বর্নিত করে।

অনেক প্রশ্নের জবাব রূপ কুমার বর্মনের সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি সজ্জা, জাতি ইতিহাসের নানা আঙ্গিকে বর্ননা, নির্ভরযোগ্য গ্রন্থতালিকা এবং সার্বিক-সুস্পষ্ট বর্ননা গ্রন্থটিকে অনন্য মাত্রা দান করে। হাল আমলে দাঁড়িয়ে জাতপাতের বর্ননা, আঞ্চলিক প্রেক্ষিত, জাতি-হিংসার নানা দিকের উন্মোচন এবং বিভিন্ন তথ্যাদির প্রয়োগে সার্বিকভাবে সমকালীন বাংলার জাতপাতের ইতিহাস নির্মানের ক্ষেত্রে এক দিকনির্দেশক পাঠ হয়ে উঠেছে রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি।

গ্ৰন্থ আলোচনা
সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ: জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ
রূপ কুমার বর্মণ
গাঙচিল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০২২, দাম- ৪০০ টাকা
.....

সাৰ্থক লাহা, গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

;

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা



সোমঋতা মল্লিক
নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।

আমরা অবোধ, অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু।।"

১৪ মে, সকাল। কলকাতার রবীন্দ্র সদনে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল এই নজরুল সঙ্গীত। বহুল প্রচলিত গানটি এই বিশেষ দিনে আমার কাছে ধরা দেয় অন্যরূপে। সমুখে শায়িত রয়েছেন সদ্য প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ শ্রীমতী কল্যাণী কাজী। নিথর দেহে পুষ্পের অঞ্জলি। তাঁকে ঘিরে তাঁর আপনজনদের এই মর্মস্পর্শী উচ্চারণ মনকে ব্যাকুল করে।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ ১২-১৩ বছরের আত্মিক সম্পর্ক। ছায়ানট (কলকাতা)-এর হাত ধরেই যদিও এই সম্পর্ক শুরু হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। তাঁর কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তা অবর্ণনীয়। আমার জীবনে এই প্রথম নজরুল জন্মজয়ন্তী যেদিন কল্যাণী কাজী আর সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই। একথা ভাবলেই চোখ ভরে ওঠে জলে। বছরের এই বিশেষ দিনগুলিতে তাঁর সাথে দেখা হলে মনে হত, কি অসীম ভালোবাসায় তিনি আমাদের প্রাণের কবিকে অন্তরে ধারণ করেন। আর পাঁচজন শিশুর মতো তিনিও নজরুলকে ভালোবেসেছেন শৈশবেই।


'অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ' বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'প্রভাতী', ‘লিচুচোর’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্রোহী', 'আমার কৈফিয়ৎ’ ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘ইন্দ্রপতন’ প্রভৃতি কবিতা বিভিন্ন বয়সে মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবিতে তাঁর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর বড় বড় ভাবালু চোখ দুটোর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার ইচ্ছা হত। মনে পড়ছে, একবার গৃহশিক্ষককে অনুরোধ করেছিলাম তাঁকে দেখতে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু কেন জানি না শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিয়তি সেদিন অলক্ষ্যে নিশ্চয় হেসেছিলেন। নয়ত যে মানুষটাকে শুধু মাত্র চোখের দেখা দেখবার জন্য সেদিন ব্যাকুল হয়েছিলাম - পরবর্তী জীবনে তাঁরই পরিবারের একজন হয়ে তাঁর কাছে থেকে তাঁকে সেবা করার সুযোগ পেলাম কি করে? একেই বোধহয় বলে ‘বিধিলিপি’!

এই বিরল ব্যক্তিত্বের খুব কাছের মানুষ হয়েও, দুর্ভাগ্যবশত আমি সুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাইনি। আমি এ বাড়ীর ছোট বউ হয়ে আসার বেশ কয়েক বছর আগেই বিস্মৃতি তাঁর চেতনার ওপর কালো পর্দা টেনে দিয়েছিল। তবুও আমাদের সবার প্রিয় ‘মামনি’ প্রমীলার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে, তাঁর যতটুকু সেবা করার সুযোগ পেয়েছি তাতেই আমি ধন্য।"


এভাবেই কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুবাদে নজরুল পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বহু অন্তরঙ্গ আড্ডায় তিনি পরিবারিক স্মৃতিচারণা করতেন।

প্রথমবার তাঁর শ্বশুরবাবা কে সামনে থেকে দেখার অনুভূতির বর্ণনা যখনই দিতেন, মনে হত আমরাও সেই সময়ে উপস্থিত হয়েছি। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। অতি সামান্য ঘটনাও তাঁর বাচনভঙ্গিতে হয়ে উঠত অসাধারণ।

তাঁকে ঘিরেই জমে উঠত আড্ডা। কখনও কথা, আবার কখনও গেয়ে উঠতেন একের পর এক নজরুল সঙ্গীত। নিয়মিত দূরদর্শনে নজর রাখতেন কোন্ শিল্পী কিভাবে নজরুলের গান গাইছেন। বিভিন্ন চ্যানেলের প্রভাতী অনুষ্ঠান দেখতে খুবই ভালোবাসতেন। পরিচিত শিল্পী হলে অনুষ্ঠানের পরেই চলভাষের মাধ্যমে অভিনন্দন জানাতেন। এভাবেই তিনি ভালোবাসায় আবদ্ধ করে রাখতেন সকলকে।

নজরুল চর্চার সঙ্গে যুক্ত যে কোন ব্যক্তি/সংগঠনকে তিনি আপন করে নিতেন। তাঁর পূর্ণদাস রোডের বাড়িতে ছিল নজরুল প্রেমীদের নিত্য যাতায়াত। নজরুল বিষয়ক আলোচনায় তাঁর ক্লান্তি ছিলনা। যে কোন সময়, যে কোন পরিস্থিতে তিনি পাশে থেকেছেন। ২০১৭ সালে কলকাতার বুকে প্রথম নজরুল মেলার আয়োজন করে ছায়ানট (কলকাতা), উদ্বোধক কল্যাণী কাজী। শিশুদের জন্য নজরুলের লেখা ২৫টি ছড়া ও কবিতা নিয়ে ২০২১ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে কল্যাণী কাজীর কণ্ঠে ‘শিশু কিশোরদের নজরুল’ শিরোনামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। পরম যত্নে তাঁর হাতে গড়া দল 'বিষের বাঁশী' ছায়ানট (কলকাতা) - এর বহু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে।


নজরুল সঙ্গীতের শিক্ষা তিনি কিভাবে পেয়েছিলেন সেই বিষয়ে কল্যাণী কাজী স্মৃতিচারণা করেছেন, "সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে গান শেখার সুযোগ পাই। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে আমি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। বাংলা গানের সাথে সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও যাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারি,  তিনি তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমার তখন চটুল গানের দিকেই ঝোঁক বেশি, তাই রাগ সঙ্গীতের জটিল পথে চলতে মন চাইত না। যতদিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি গলাকে স্ববশে রেখে গান গাইতে হলে, বিশেষ করে নজরুল গীতিকে প্রাণবন্ত করতে রাগ সঙ্গীত চর্চা খুবই দরকার।

আজ সঙ্গীতের শিক্ষকতা করতে গিয়ে নজরুল গীতির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের সব রকমের বাংলা গানের চাহিদা যে মেটাতে পারি, তারজন্য আমি আমার গুরু শ্রদ্ধেয় শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। সেদিন যদি তিনি জোর করে খেয়াল, ঠুংরী, দাদরা, গীত, গজল এর সাথে সাথে কীর্তন, পুরাতনী, রাগপ্রধান প্রভৃতি গান না শেখাতেন, তবে গানের অনেক ধারাই আমার অজানা থেকে যেত। কাজী নজরুলের গানের সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে তিনিই আমায় প্রথম পরিচয় করান। প্রথম যে নজরুল গীতিটা শিখিয়েছিলেন সেটা হল হাম্বির রাগে নিবদ্ধ 'আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া'। এরপর তিনি শেখালেন 'ভোরের ঝিলের জলে', 'প্রথম প্রদীপ জ্বালো', 'শাওন আসিল ফিরে', 'ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি' প্রভৃতি নজরুলের রাগভিত্তিক গানগুলো।


আমার স্বামী অনিরুদ্ধ যখন নজরুল গীতির স্বরলিপির বই 'রাগবিচিত্রা'-র প্রস্তুতি নেন, তখন আমিই হাম্বির রাগের গানটির স্বরলিপির কাজে সাহায্য করেছিলাম। তিনি গানটা জানতেন না। অপ্রচলিত গানটা পরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।" 

তিনি অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকমাস, কিন্তু তাঁর জীবনীশক্তি ছিল প্রবল। জীবনের বহু দুঃসময়কে তিনি জয় করেছিলেন অবলীলায়। ১২ মে ভোরে নজরুল অনুরাগীদের চোখের জলে ভাসিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন তিনি।

তাঁর কন্যা অনিন্দিতা কাজী বলেছেন মায়ের শেষ ইচ্ছের কথা। শোকবার্তায় অনিন্দিতা লিখেছেন - "মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজের বাড়িতে (৭৪ এইচ, পূর্ণদাস রোড, ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক) দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা আর্কাইভ হবে।"

আমরা সকলেই চাই তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ হোক।

সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক। সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)।

;

বাজারে এলো আতিফ ওয়াফিকের বই ‘এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া’ 



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক, যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ, তার সর্বশেষ বই "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" বাজারে এসেছে। এই বইটি আজকের পাঠকদের দ্রুত-গতির বিশ্বে সঠিক আচরণের শিল্প সম্পর্কে একটি সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করবে বলে লেখক মনে করেন।

একটি সমাজে যেখানে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" সেই ব্যক্তিদের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে কাজ করবে বলে লেখক মনে করেন। বিশেষ করে আজকের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী দের এই বই টি অনেক কাজে আসবে। এই বইটি পাঠকদের আধুনিক আচরণের সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করতে সাহায্য করার জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ এবং কার্যকরী টিপস প্রদান করে৷

"এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" যত্ন সহকারে গবেষণা করা হয়েছে, পাঠকদের সমসাময়িক শিষ্টাচারের নিয়ম সম্পর্কে সর্বশেষ অন্তর্দৃষ্টি এবং নির্দেশিকা প্রদান করে। এর সহজ ভাষা এবং উপস্থাপন উদাহরণ সহ, সমস্ত পটভূমির পাঠকদের জন্য উপযুক্ত, তারা তাদের সামাজিক দক্ষতা পোলিশ করতে চাইছে বা তাদের পেশাদার চিত্র উন্নত করতে চাইছে।

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক একজন অন্বেষিত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, তার আকর্ষক কথা বলার ব্যস্ততা এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ পরামর্শের জন্য পরিচিত। বর্তমানে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স এ ।

রিডিং ক্যাফে, বনানীতে বইটি উন্মোচনের সময়, জনাব ববি হাজ্জাজ (একজন অক্সফোর্ড স্কলার), জনাব সোলায়মান শুকন (একজন বাংলাদেশী যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ), জনাব শাহরিয়ার নাফীস (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার), জনাব হাসান মাহমুদ (প্রতিষ্ঠাতা, স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ার্স), জনাব বেনজির আবরার (প্রতিষ্ঠাতা, এক্সিলেন্স বাংলাদেশ), মিসেস আফরুজা তানজি (রাষ্ট্রদূত, ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড), মিসেস শারমিন কবির (প্রতিষ্ঠাতা, রিতু), মিসেস ইশরাত নাহের ইরিনা (প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশ), জনাব ফাহিন আরাফিন (ক্রিয়েটিভ হেড, স্বপ্ন), জনাব সালেহীন মাহবুব (বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ), মিসেস ফারহানা শারমিন (ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিস্ট, রিমার্ক এইচবি), এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয় শিক্ষার্থীউপস্থিত ছিলেন।

;

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'



কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি একক ও অনন্য। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। যার অগ্নিঝরা লেখনি ত্রস্ত করেছে ঔপনিবেশিক শাসকদের। যার বই বার বার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন।

নজরুল শতবর্ষ আগে বন্দি ছিলেন কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেলখানায়। নজরুল বিষয়ক সংগঠন ছায়ানট কলকাতা শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা-গবেষণার পাশাপাশি নজরুল স্মৃতিধন্য হেরিটেজ স্থান ও স্থাপনাসমূহ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় রয়েছে। ছায়ানট কলকাতার সভাপতি, বিশিষ্ট শিল্পী, সোমঋতা মল্লিক কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নজরুলতীর্থগুলো নিজে গিয়ে সেগুলো রক্ষার প্রশাসনিক ও নাগরিক তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন। যার ফলে এবছর নজরুল জয়ন্তীতে কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে স্থাপিত হয়েছে 'নজরুল কক্ষ'।


ছায়ানট কলকাতা সভাপতি সোমঋতা মল্লিক বার্তা২৪.কম'কে জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর,২০২২ তারিখে ছায়ানট (কলকাতা) তথ্য সহ WBHIDCO - এর কাছে এই মর্মে আবেদন করে যে, নজরুল স্মৃতি বিজড়িত আলিপুর জেল মিউজিয়ামে কাজী নজরুল ইসলাম যে জায়গায় বন্দি হিসেবে ছিলেন, সেই জায়গাটি চিহ্নিত করা এবং নজরুল মূর্তি স্থাপন করার জন্য।

তিনি বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি,২০২৩ তারিখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নজরুলের আগমনের শতবর্ষকে স্মরণ করে ছায়ানট (কলকাতা) এবং আলিপুর মিউজিয়াম যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানও পালন করে।

শনিবার (২৬ মে) আমরা সত্যিই আনন্দিত, আমাদের এই প্রস্তাব তাঁরা বিবেচনা করেছেন এবং আলিপুর মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ' তৈরি হয়েছে, জানান সোমঋতা মল্লিক।

;