সোশাল মিডিয়া, ট্রলিং ও মূল্যবোধহীনতা

  • ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

তথ্য-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির কারণে মানুষ প্রাকৃতিক দুনিয়া ছাড়াও আরও একটি দুনিয়ায় বাস করে। এটির নাম ডিজিটাল দুনিয়া বা ওয়েব ওর্য়াল্ড। এটি একটি বিস্ময়কর দুনিয়া। এই দুনিয়ায় মানুষ যন্ত্রের ও তথ্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। ডিজিটাল মাধ্যমগুলির মধ্যে ইমেল খুবই প্রাতিষ্ঠানিক একটি ধরণ। ইমেইল ছাড়াও সোশাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ও ইন্সট্রাগ্রাম ব্যবহার করে পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের বাসিন্দাদের সাথে বন্ধুত্ব করে এবং সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখে। এমনকি পেশাগত নেটওয়ার্কও মজবুত করে।

সোশাল মিডিয়া একদিকে সর্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অন্যদিকে, এগুলির অপব্যবহারের কারণে মানুষ এখন শঙ্কিত ও আতঙ্কিত। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভিত্তিহীন খবর, বিকৃত ছবি, অসত্য ভিডিও এবং অমার্জিত ভাষার ব্যবহার (সাইবারবুলি) বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, গত বছর বাংলাদেশের একজন সেলিব্রেটির বৈবাহিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ও পরবর্তীতে তাদের তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়ে বহু মানুষ ফেসবুকে ঘৃণামূলক ও শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য ছড়িয়েছে-যা কোনো মতেই কাক্সিক্ষত ও শোভন নয়। সোশাল মিডিয়া প্রযুক্তিগতভাবে এতটাই শক্তিশালী যে এটির মাধ্যমে মূহুর্তের মধ্যে একটি পোস্ট বা স্ট্যাটাস এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে চলে যায়।

বিজ্ঞাপন

যারা ব্যক্তিগত মনোরঞ্জনের জন্য কিংবা অন্যের সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য আক্রমণাত্মক, প্রেক্ষিত-বহির্ভূত ও অশালীন কনটেন্ট (ছবি, ভাষা, ভিডিও) ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রচার করে তাদেরকে ইন্টারনেট ট্রল (internet troll) বলা হয়। ট্রলকারীরা খুব সহজে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য বিতর্কিত বিষয় প্রচার করে থাকে। সম্প্রতি, বাংলাদেশে কিছু ব্যক্তির নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাদেরকে নিয়ে ট্রলকারীরা অমার্জিত ভাষায় তাদের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে।

এটি সহজেই লক্ষ্যণীয় যে,  ট্রলকারীদের সহজ টার্গেট হচ্ছে নারী। যেমন, একজন নারী চিকিৎসকের নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও ছবিগুলোকে অতিরঞ্জিত করে একদল ট্রলকারী সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের নজর কেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ: দেশে বহু পুরুষ ধূমপান করে। তাতে আইনগত কোনো নিষেধ নেই। কোনো ধূমপায়ী নারীর ছবি সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ পেলে তা আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাকে নিয়ে ট্রলকারীরা তৎপর হয়ে উঠে। ধূমপানও যে পুরুষের মতো নারীর ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের বিষয়-তা আলোচনায় স্থান পায় না।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি, একজন মা ও ছেলের ক্রিকেট খেলা নিয়েও ট্রলকারীরা ডিজিটাল দুনিয়ায় তৎপর হয়ে উঠেছে। উক্ত ঘটনাটিতে ট্রলকারীদের টার্গেট হচ্ছে নারীর পোশাক। পর্দানশীল নারী ক্রিকেট খেলতে পারবে কি পারবে না; তার পোশাক বাংলাদেশের ‘নারী’ কিংবা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘মা’ পরিচয়কে পরিবেশন করে কিনা, ইত্যাদি বিষয় সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এতে করে উক্ত নারীর নিজস্ব পোশাক-পছন্দকে অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

‘লোকেরা কেন ট্রল করে এবং আপনি এটি সম্পর্কে কী করতে পারেন’ শিরোনামে বিবিসি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টটিতে আচরণগত আসক্তির প্রফেসর মার্ক গ্রিফিথসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে ‘বেশিরভাগ মানুষ প্রতিশোধের জন্য, অন্যের মনোযোগ পাবার জন্য, নিজের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য এবং ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য ট্রল করে।’ রিপোর্টটিতে আরও বলা হয় যে, কেউ অন্যের সাফল্য ও খ্যাতি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে কিংবা কেউ হীনমন্যতাবোধে ভুগে ট্রল করে। মূলত, রিপোর্টটি ব্যক্তির মানসিক দুর্বলতাকে অনেকাংশে দায়ী করে।

ট্রলকারীদের অশালীন মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে তারা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য কারিগরি জ্ঞান অর্জন করেছে, কিন্তু মানবিকতাকে ও মূল্যবোধকে তারা ধারণ করতে পারেনি। তারা শিষ্টাচার বজায় রাখতে শিখেনি। তারা শালীন ও মার্জিত ভাষায় নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে শিখেনি। তারা সমাজের মানুষের সাথে সামাজিকতা বজায় রেখে সামাজিক জীব হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় এককভাবে ব্যক্তির নিজের নয়। একাডেমিক, পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি এই দায়কে এড়িয়ে যেতে পারেনা। একাডেমিতে, পরিবারে ও সমাজে মূল্যবোধের ও মানবিকতার চর্চার অভাবই ট্রলকারীদেকে অশালীন ভাষা ব্যবহারের দিকে ঠেলে দেয়। সময়ের চাহিদার কারণে তথ্য-প্রযুক্তির বিষয়ে আমরা নিজেদেরে ডিজিটাল দক্ষতা বাড়াবো, সেই সাথে এটিও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য-প্রযুক্তি ও সোশাল মিডিয়া ব্যবহারে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখাও প্রয়োজন। অন্যথায়, আমরা সোশাল মিডিয়া দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারলেও মানুষ হিসেবে অসামাজিক ও অমানবিক থেকে যাব।

লেখক: ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।