ধর্ষকের কোনো ক্ষমা নেই
বাংলাদেশে গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাদ যায়নি প্রতিবন্ধী কিংবা ছয় বছরের শিশুও। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ধর্ষণ প্রবণতা দিন দিন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। ধর্ষণকাণ্ডের বিচার না হওয়াকে পরিস্থিতির জন্য দুষছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
সিলেটের এমসি কলেজে শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে অসুস্থ স্বামীর জন্য রক্ত জোগাড়ের কথা বলে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করতে ঘরে ঢুকে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্নস্থানে এমন আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক তরুণীকে (২০) দুইদিন ধরে আটকে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী এলাকায় অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১৪) ধর্ষণ করেছে তার ‘গৃহ শিক্ষক’ মাজহারুল ইসলাম রায়হান। সাত সেপ্টেম্বর রাতে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের সাঁতারপুর গ্রামে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক দরিদ্র রিকশাচালকের ছয় বছরের শিশুকন্যা।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ১৩ বছরের এক শিশুকে জোর করে তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে মো. মাসুদসহ তিন যুবকের বিরুদ্ধে। এভাবে ফিরিস্থি তুলে ধরলে, আরও অনেক ঘটনা উল্লেখ করা যাবে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে জানুযারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮৯ জন নারী। ধর্ষণের পরে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। সে হিসেবে গড়ে প্রতি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১১ জন নারী।
সংস্থাটির পরিসংখ্যানে আরও দেখা গেছে, ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষিত হয়েছেন। যা ২০১৮ সালে ছিল এর প্রায় অর্ধেক ৭৩২ জন। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী। এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর ধর্ষণের গ্লানি সইতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী।
এসব ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতাকে দায়ী করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের অভিযোগ, ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। আবার অনেক সময় পুলিশ ক্ষমতাশালীদের গ্রেফতার করে না। কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই অপরাধ কমে যাবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরাই বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। যেখানে পুরুষ আবির্ভূত হয় ধর্ষক হিসেবে, নারীরা হয় নির্যাতিত। শরীরে যৌন অনুভূতি না আসা কিংবা যৌন অনুভূতির বয়স পেরিয়ে বৃদ্ধাবস্থায় পতিত হওয়া মেয়ে শিশু-মহিলারাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নিয়মিত। যেখানে পুরুষের বিকৃত যৌন লালসা এবং মনুষ্যত্বহীনতাই প্রকাশ পায়। ধর্ষণ প্রতিরোধের জন্য রাষ্ট্র-সমাজ কর্তৃক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও থামছে না ধর্ষণ।
নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে বহু পুরুষ পশুতে পরিণত হয়, যাদের দ্বারা ঘটে ধর্ষণের মতো জঘন্য ও অমানবিক ঘটনা। যার শিকারে পরিণত হয়ে সম্ভ্রম হারানোসহ মৃত্যুবরণ করে বহু শিশু-কিশোরী-নারী। ধর্ষকরা রাষ্ট্রীয় আইনকে তোয়াক্কা না করার পাশাপাশি ধর্মীয় বিধানকেও উড়িয়ে দিয়ে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হন। মানুষরূপী এই পশুরা না মানছে ধর্মের বাণী, সামাজিকতা ও রাষ্ট্রীয় আইন।
ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা ও ধর্ষিতার মৃত্যু হওয়া ছাড়াও নানাবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। এর ফলে সুখের সংসারে নেমে আসে অন্ধকারের কালো ছায়া। এই ছায়া নারীর অগ্রগ্রতি, উন্নতি ও শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। তাই ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের যথাযথ শাস্তি জরুরি।
আমরা চাই, একজন পুরুষের কাছে তার নিজ মেয়ে, স্ত্রী, মা-বোন যেমন নিরাপদ, তেমনি অন্যের স্ত্রী, মা-বোন ও শিশুটিও যেনো নিরাপদ থাকে। সামাজিক এই নিরাপত্তার জন্যই ধর্ষকদের বিচার ত্বরান্বিত করতে হবে, তাদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। এর ফলে সমাজের মানুষ নিরাপদ হবে, শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত হবে।
ধর্ষণের যে তথ্য-উপাত্ত আমরা পাই, তা কেবল পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগ অথবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এর বাইরেও আছে ধর্ষণের অজস্র ঘটনা। অনেক নারী কিংবা পরিবার লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেন না।
এখন প্রশ্ন হলো- ধর্ষণ কেন হচ্ছে? কেনই বা ধর্ষণের হার ব্যাপকহারে বাড়ছে? এর জবাব বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন। কেউ মনে করেন, ধর্ষণের সঙ্গে পরোক্ষভাবে নারীর পোশাক জড়িত, কেউ মাদক-পর্নোগ্রাফি বা বিজাতীয় অপসংস্কৃতিকে দায়ী করেন ধর্ষণের কারণ হিসেবে। ধর্ষণের পেছনের অদৃশ্যমান আরেকটি কারণ কিছুটা হলেও উন্মোচন করা হয়েছে নারীপক্ষ নামে একটি সংস্থার গবেষণায়।
নারীপক্ষের গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে করা তিন হাজার ৬৭১টি মামলায় মাত্র চারজনের সাজা হয়েছে। ধর্ষণ মামলায় হাজারে সাজা হচ্ছে মাত্র চারজনের।
মহিলা আইনজীবী সমিতির আরেক জরিপে দেখা যায়, ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। এসব মামলার ভেতরে যেগুলোর রায় হচ্ছে সেখানেও আছে দীর্ঘসূত্রতা। এ দীর্ঘ সময়ে ধর্ষিতাকে মনস্তাত্ত্বিক ধর্ষণের শিকার হতে হয় বছরের পর বছরজুড়ে। সামাজিক এই মনোভাবও বদলানো দরকার।
আর আইনের এমন প্রয়োগ দরকার, যেখানে ধর্ষকেরা কোনো ফন্দি-ফিকির করে পার না পায়।
আমরা মনে করি, কোনো কারণ, ছল-চাতুরি, শিক্ষা, চেতনা কিংবা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা কিংবা পরিচয় দিয়ে ধর্ষককে আলাদা করার উপায় নেই। ধর্ষকেরা শুধু একটি নির্দেশকের মাধ্যমেই চিহ্নিত হতে পারে, সেটি হচ্ছে ধর্ষণকামী মন, বিকৃত মানসিকতা। ধর্ষণকামী এসব মানুষকে ভয় দেখাতে হবে।
ধর্ষণ করলে কোনোভাবেই পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই- এই ভয় জাগরুক করতে হবে, এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। এখনও এই সমাজ নষ্ট হয়ে যায়নি, সমাজের ভালো মানুষ ফুরিয়ে যায়নি। সুতরাং এমন একটি সামাজিক সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, যেখানে কঠোর পরিণতির ভয়ে কেউ আর ধর্ষণকামী হবে না। নাহলে এই সমাজে যেভাবে ধর্ষকদের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে কেউ নিরাপদ নয়। আর অনিরাপদ সমাজের যাবতীয় উন্নতি-অগ্রগতি, সূচক বৃদ্ধির সাফল্য আখেরে কোনো ভালো বার্তা বয়ে আনবে না।
মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তা২৪.কম