খবরে যখন মাদরাসায় বলাৎকার

  • মাওলানা যুবায়ের আহমাদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মাওলানা যুবায়ের আহমাদ, ছবি: বার্তা গ্রাফিক্স

মাওলানা যুবায়ের আহমাদ, ছবি: বার্তা গ্রাফিক্স

আমাদের চারপাশে নানা রকমের অপরাধ সংঘটিত হয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্মূলে আমাদের চলমান চেষ্টার মধ্যেও চলে অপরাধ। তবে কোনো কোনো ব্যক্তি, স্থান বা প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত অপরাধ মানুষ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। অপরাধ দমনের দায়িত্বে থাকা পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য অপরাধে জড়ালে যেমন মানুষ তা মেনে নিতে পারে না তেমনি গীর্জা, মন্দির বা মাদরাসা সংশ্লিষ্ট কারা দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হলে সাধারণ মানুষকে সেটা অনেক বেশি কষ্ট দেয়।

যারা মানুষকে সবসময় সৎ কাজের দিকে আহবান করেন, মাদকমুক্ত জীবন ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনের কথা বলেন। তাদেরই একটি অংশ যখন ভালো মানুষের লেবাস পরে অপরাধ করেন, তখন মানুষের মনে সেটা বেশি দাগ কাটে, মানুষ সেটা মেনে নিতে চায় না। আবাসিক মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থী বলাৎকারের খবরটিও তেমনি লজ্জাজনক একটি খবর।

বিজ্ঞাপন

আমি কোরআনে কারিমের হাফেজ। হেফজ থেকে স্নাতকোত্তর কওমি মাদরাসা, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। হেফজখানার আড়াই বছরে কখনও শুনিনি, মাদরাসায় এ ধরণের গর্হিত কাজ হয়, হেফজখানা একটি পবিত্র ক্যাম্পাস। আমার হেফজের সম্মানিত উস্তাদ হাফেজ নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন উঁচু ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

কোরআন হেফজ শেষে দেশের অন্যতম শীর্ষ মাদরাসা কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়ায় ভর্তি হই। দুই হাজার শিক্ষার্থীর বিশাল বিদ্যাপীঠ। অর্ধশতাধিক শিক্ষক। কোনোদিন এ ধরণের বিষয় আমাদের কানে আসেনি। ফলে কওমি মাদরাসায় অধ্যয়নকালে শুনতে হয়নি, মাদরাসায় বলাৎকার হয়। সত্যি কথা বলতে কী, কওমি মাদরাসাগুলো অবস্থা এমনই।

বিজ্ঞাপন

তার পরও দুঃখজনক হলো, হালসময়ে এমন কিছু ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। সংখ্যা কিংবা আনুপাতিকহারে তা খুব কম হলেও মাদরাসার পবিত্র আঙিনায় তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এ জাতীয় ঘটনা বরাবরই আমাদের লজ্জিত করে। আমরা এর শাস্তি চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এখানে অন্যায় দু’টি। প্রথমত বলাৎকার, দ্বিতীয়ত ধর্মীয় অঙ্গনকে অপবিত্র করা। এ দু’টোরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি এমনভাবে আলোচিত হচ্ছে, মাদরাসা মানেই যেন বলাৎকার। কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ওয়াজ ও ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে দেশের আলেমসমাজ ও তওহিদি জনতা বিক্ষুদ্ধ হয়ে তা বর্জনের ডাক দিয়েছিল। তখন থেকে ওই চ্যানেলসহ আরও কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল মাদরাসা শিক্ষার পরিবেশকে আরও নেতিবাচকভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে। দেশের কোনো অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে ঘটা এ জাতীয় ঘৃণ্য ঘটনাকে জাতির সামনে বড় করে তুলে ধরা হয়।

শুনলে অবাক হতে হয়, বিচ্ছিন্ন এ জাতীয় ঘটনার অধিকাংশই মিথ্যা অপবাদ। অনেকদিন আগে আমার পরিচিত এক শিক্ষককে এহেন অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়। শিক্ষকের দাবি ছিল, তিনি নির্দোষ। ঘটনার প্রায় ৬ মাস পর প্রকাশ পায় সত্য ঘটনা। এলাকার এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন ওই মাদরাসার হিসাবরক্ষক। তিনি মাদরাসার তহবিল তসরুফ করেন। বিষয়টি ওই শিক্ষক জেনে গেলে নিজের অর্থ কেলেংকারির কথা প্রকাশ হয়ে যাবে, তাই ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বলাৎকারের মিথ্যা অভিযোগ এনে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ৬ মাস পর যে ছাত্রের সঙ্গে শিক্ষক এ গর্হিত কাজ করেছেন বলে অভিযোগ এসেছিল, ওই ছাত্রই জানায়- ঘটনা মিথ্যা।

তার পরও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সেসব বন্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা আশা করি, কওমি মাদরাসার শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেবেন, কোনো অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে, বিচ্ছিন্ন এসব ঘটনার দায় আর বদনাম কোনো মাদরাসা কিংবা আলেমদের নিতে হবে না।

এক্ষেত্রে কওমি মাদরাসার নীতি-নির্ধারক প্রতিষ্ঠান বেফাকসহ অন্য বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ কিছু সুপারিশ পেশ করা হলো-

১. মাদরাসা স্থাপন ও প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতি জেলায় একটি কমিটি রাখা। যে কেউ যেন দু’টি রুম ভাড়া করে সেখানে ‘জামিয়া’ বা দুই রুমবিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে না পারে সে বিষয়টি দেখবে এ কমিটি। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আছে কি-না কিংবা তা যাচাই করে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক অনুমতি দেবে এ কমিটি।

২. প্রতিটি কওমি মাদরাসায় শিক্ষকদের পাক্ষিক ছুটির ব্যবস্থা রাখা। বিশেষত আবাসিক ক্ষেত্রে অবিবাহিত শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়া এবং বিবাহিতদের অন্তত দুই সপ্তাহ পরপর ৩ দিনের ছুটির ব্যবস্থা রাখা।

৩. প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সঙ্গতি থাকলে শিক্ষকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে স্ত্রী-সন্তানসহ শিক্ষকদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া।

৪. ছাত্রদের থেকে কোনো ধরনের সেবা গ্রহণ নিষিদ্ধ করা।

৫. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের ঘটনা বন্ধে জেলা কিংবা উপজেলায় আলেমদের একটি কমিটি রাখা। কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে, তা তদন্ত করা। কেউ যেন ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা অভিযোগ চাপিয়ে দিতে না পারে, আবার কিছুতেই যেন অপরাধীরা ছাড় না পায়। কোনো শিক্ষক অভিযুক্ত হলে তাকে বাঁচানোর কিংবা ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা নয়, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্রীয় আইনে বিচারের আওতায় আনা।

৬. মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কোনো শিক্ষকের চারিত্রিক সমস্যা দেখলে তাকে সংশোধনের জন্য কোনো বুজুর্গের কাছে পাঠাবেন।

৭. কোনো মাদরাসায় যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের কোনো ত্রুটি সামনে আসলে- অভিযুক্ত শিক্ষকের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান প্রধানকে বহিষ্কার করা। প্রয়োজনে ওই মাদরাসার রেজিস্ট্রেশন ৩ বছরের জন্য বাতিল করা।

৮. যৌন কেলেংকারিতে বহিস্কৃত হলে কোনো মাদরাসায় সে আর শিক্ষক হিসেবে যেন চাকরি করতে না পারে, কিংবা নতুন মাদরাসা খুলতে না পারে- সে ব্যাপারে বেফাকের জেলা কার্যালযে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা রাখা।

৯. মহিলা মাদরাসাগুলোতে শতভাগ মহিলা শিক্ষক নিশ্চিত করা।

১০. বেফাকের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যেক শিক্ষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষণবিহীন কোনো শিক্ষককে নিয়োগ প্রদান বন্ধ করা।

১১. শিক্ষকদের পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষকের ব্যক্তিত্বও ছাত্ররা অনুসরণ করে। সব শিক্ষকের আত্মশুদ্ধি, উঁচু ব্যক্তিত্ব ও উত্তম চরিত্রের ব্যাপারে বেফাকের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য বছরে ১ সপ্তাহের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা। প্রতিষ্ঠান কীভাবে পরিচালনা করবেন তা শেখাতে প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরকেও প্রশিক্ষিত করা।

মাওলানা যুবায়ের আহমাদ: পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর