শ্রদ্ধা জানবেন, মাননীয়
ভারতের বেশ কয়েকজন পরিচিতজন, বন্ধু, জিজ্ঞেস করেছেন ‘কেমন চলছে গো তোমাদের টিকা কার্যক্রম। কোনো অসুবিধে নেই তো...’। খুব সুখী সুখী একটা ভাব নিয়ে তখন বলেছি, ‘অনেক দারুণ। তোমাদের এই মুহূর্তে ভালোবাসা দেওয়া ছাড়া; আমার কাছে আপাতত কিছু নেই আর’। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ ভ্যাকসিন দেশের আনাচে-কানাচে বিতরণ চলছে। নির্বিঘ্নে হচ্ছে সব কিছু। যা নিয়ে সন্তুষ্ট প্রায় শতভাগ বাঙালি। এর চেয়ে আর বড় খুশির কী-ই বা হতে পারে। প্রতিবেশী দেশ নিয়ে আমাদের নানান মতভেদ থাকতে পারে, সমালোচনাও কম নয়। কিন্তু কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যেভাবে আমরা একে অপরের পাশে এসেছি তা অত্যন্ত ইতিবাচক। শিগগিরই সেরাম থেকে দ্বিতীয় চালানও আসছে।
ভারতে এখন দুই ধরনের কোভিড টিকা দেওয়া হচ্ছে। একটি ব্রিটেনে উদ্ভাবিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা- দেশটিতে স্থানীয়ভাবে যার নাম 'কোভিশিল্ড'। আর দ্বিতীয়টি ‘কোভ্যাক্সিন’- যা ভারত-বায়োটেক নামে একটি স্থানীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের তৈরি। কোভ্যাক্সিন গ্রহণ করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর তুলনামূলক বেশি এসেছে। সেদিক থেকে কোভিশিল্ড অনেক নিরাপদ বটে। দেশে দুই সপ্তাহ হতে চলেছে, টিকা কার্যক্রম চলমান, এখনও বড় ধরনের কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি, আশা করি সমস্যা হওয়ার কোনো কথাও না। এতে প্রতিদিনই আস্থা বাড়ছে। ভিড় বাড়ছে রেজিস্ট্রেশনে, লাইন বাড়ছে টিকা কেন্দ্রগুলোতেও।
ভারত থেকে আমরা টিকা এনেছি, তবে দেশটির অনেক তথাকথিত ভিআইপি/বিশিষ্টজনরাই এখনও ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে পারেননি। ফ্রন্টলাইনার বা সম্মুখসারির যোদ্ধা বলা হয় যেই সাংবাদিকদের তাদের অনেকেই এখনও টিকার ডোজ থেকে ঢের দূরে। সব মিলিয়ে আমাদের দেশে ভিআইপি থেকে বৃদ্ধ, সম্মুখসারির যোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে টিকা। সময় মতো টিকা নির্বাচন আর আবহাওয়ার সঙ্গে উপযোগিতা রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যাতে শুধু বাংলাদেশ পাস মার্কসই পায়নি, পেয়েছে লেটার মার্কস। মহামারির শুরুতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কর্মকাণ্ডে নানা সমালোচনা হয়েছে ঠিকই, তবে তিনি শেষ পর্যন্ত উতরেই গেলেন বলা যায়— করোনা পরিস্থিতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে রেখে। সেই সঙ্গে যার পরামর্শে এই সুন্দর কার্যক্রম, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা— তার প্রতি জনগণের আস্থা ও সম্মান-শ্রদ্ধা আরও বৃদ্ধি পেলো এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি দেখেছি, ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা আর মৃত্যু ভয়ে কপালে ভাঁজ পড়া বৃদ্ধ মানুষটার বাহুতে সিরিঞ্জ ঢুকানোর পর তার স্বস্তির নিশ্বাস, চোখে-মুখের উজ্জ্বল আলো। তিনি এখন আশ্বস্ত সংকট দূর হলো বলে। মনোবল চাঙা হয়েছে সারাক্ষণে আতঙ্কে থাকা মানুষদের। জনগণের মুখের হাসি, মনের শান্তির চেয়ে বড় আর কী-ই বা হতে পারে একজন দেশ পরিচালকের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে।
নির্বাচন ব্যবস্থা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে বিরোধীদলগুলোর নানা প্রশ্ন আছে জানি। তবে তারা করোনা মোকাবিলায় এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগে আরও বেশি সংযুক্ত হতে পারে, পারতো। সমালোচনা করার জন্যই যে শুধু বিরোধী রাজনীতি, কটু বাক্য ছাড়াই যে তাদের মূল কাজ তা তো নয়। বিরোধীদলের মূল কাজ বিরোধিতা হতে পারে, কিন্তু একমাত্র নয়- এ কথা তাদের ভুলে গেলে চলবে না। অবকাঠামোগত উন্নয়নে দুর্নীতি থাকলে তা নিয়ে কড়া ভাষায় কথা বলা ছাড়া আর কিছু করার নেই তাদের, কিন্তু শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন আর স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে সরাসরি কাজ করার সুযোগ আছে বিরোধী পক্ষের। আশা রাখতেই পারি, এই দুর্যোগ কেটে ওঠার জন্য তাদের আরও সহযোগিতা পাওয়া যাবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে তারা।
পাশাপাশি সরকারেরও অনেক কিছুই করার আছে। ভারত বাদে টিকা উৎপাদন করছে যেসব দেশ, তাদের কয়েকটির সঙ্গে চুক্তি করে, আবহাওয়া উপযোগী টিকা আনা প্রয়োজন আরও। আপাতত বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় টিকা না দেওয়া, বিনামূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থাই চালু রাখা সঙ্গে সরকারি উদ্যোগে টিকা দেওয়ার কার্যক্রমকে আরও সহজ-বেগবান এবং ত্রুটিমুক্ত করার সময় এসেছে। পাশাপাশি দরকার মাস্ক পরার বিষয়টি যেন অবহেলায় না পড়ে সেটি নিশ্চিত করা। ফের গণসচেতনতা জরুরি এ কাজে। গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে আগের মতো।
আমি টিকা নিয়েছি, আমার পরিবারও নিয়েছে। বাংলাদেশের ১৬ কোটির বেশি মানুষের ৩২ কোটির বেশি ডোজ বিনামূল্যে পাওয়ার অধিকার আছে। এটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনা অনুচিত (ফলে ভারত থেকে টিকা আনা অব্যাহত রাখা জরুরি)। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে আরেকটু দেরিতে, এ নিয়ে যেন কোনো শঙ্কার সৃষ্টি না হয়, সেটা নির্ধারণ করা জরুরি। আমরা দেখেছি ২০২০ সালের মাঝামাঝি করোনার টেস্টের নামে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে দেশে। মানুষের জীবন নিয়ে যারা খেলেছে তাদের কঠিন সাজা হওয়ার দাবি ছিল, কিন্তু ততটা কঠিন হয়নি সাজা। এবারও যদি কোনো কারণে টিকা নিয়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয় তাহলে সেটা চরম বিপর্যয়ের কারণ হবে। বেসরকারি হাসপাতালে করোনার টেস্ট করাতেই লাগে তিন থেকে চার হাজার টাকা, সেখানে তাদের টিকার দায়িত্ব দিলে, একই পরিমাণ টাকা কিংবা তার চেয়েও বেশি অর্থ দিয়ে কিনতে হবে। যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। সরকারের ওপর বেসরকারি খাতের চাপ আছে সত্যি, কিন্তু এখন সময় নত হওয়ার নয়। সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে এই বিষয়গুলোয় সরকারকে কড়াভাবে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। পুঁজিবাদীদের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে ফেললে হবে না।
একই সঙ্গে এবার স্কুল-কলেজ ধাপে ধাপে খুলে দেওয়ার দিন এসেছে। মার্চের শুরুতে অন্তত নবম-দশম শ্রেণি আর একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষার্থীরা যেন ফিরতে পারে নিজ বেঞ্চে, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে খুলেছে স্কুল, আমরা কেন তাহলে পিছিয়ে থাকবো? অফিস-আদালত-ব্যবসা-বাণিজ্য সবই যেখানে চলছে, সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম কী দোষ করলো! একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়াও জরুরি ভিত্তিতে সম্পন্ন করা দরকার। স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি মনন ও শিক্ষার বিকাশ যেন পূর্ণ দমে চলে এটাই কাম্য। আর তবেই ভাইরাস মোকাবিলার সাফল্যের সঙ্গে যোগ হবে, আরও কিছু অর্জনের পালক।
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক, সাংবাদিক