বাদী থেকে আসামি

  • প্রভাষ আমিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলাদেশ থেকে এখনও কেউ অস্কার পায়নি। তবে আমি একজনের নাম প্রস্তাব করছি, তিনি হলেন বাবুল আক্তার। আমি নিশ্চিত অস্কার কর্তৃপক্ষ খোঁজ পেলে, তাদের নিয়ম-কানুন শিথিল করে হলেও এই বিরল প্রতিভাকে সেরা অভিনেতার পুরস্কার দেবে। অভিনয় দিয়ে ১৮ কোটি মানুষকে পাঁচ বছর ধরে অন্ধকারে রাখা কম কথা নয়। থ্রিলার সিনেমায় গল্পের নানান বাঁকে নানান টুইস্ট করা হয়। বারবার গল্পের রঙ পাল্টে যায়। এই যাকে দোষী মনে হয়, পরক্ষণেই তাকে মনে হয় সাধু। দর্শকদের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত আটকে রাখাই চিত্রনাট্যকারের মুন্সিয়ানা। বোঝাই যায়, গল্পে নাটকীয়তা আনতে চিত্রনাট্যকার কল্পনায় নানা কিছু লেখেন। আমরা ভাবি, বাস্তবে এমনটা সম্ভব না। কিন্তু কখনো কখনো বুঝে যাই, সত্য কল্পনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। জীবন নাটকের নাট্যকারই সবচেয়ে বড় মুন্সী।

বাবুল আক্তার একজন চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। জঙ্গী বিরোধী অভিযানসহ অসংখ্য সাহসী অভিযান পরিচালনা করে অল্প সময়েই নায়কের মর্যাদা পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন পুলিশের জন্য মর্যাদার সব পদকই। কিন্তু পরকীয়া তার সবকিছুই শেষ করে দিল। বাবুল আক্তার প্লটটা সাজিয়েছিলেন ভালোভাবেই। ঘটনাটা ঘটবে নিজে যখন চট্টগ্রামের বাইরে মানে ঢাকায় থাকবেন তখন। পরিচিত সোর্সদের দিয়েই তিনি স্ত্রীকে খুন করিয়েছিলেন। অল্প টাকার কন্ট্রাক্ট কিলিং। ঘটনার পর খুনীদের তিন লাখ টাকাও দিয়েছেন বাবুল আক্তার। স্ত্রীর খুনের খবর পেয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে যে কান্নাটা কেঁদেছিলেন, তা সারাদেশে তার জন্য সহানুভূতির বন্যা নিয়ে এসেছিলেন। সহকর্মীরা ধরে তাকে দাড় করিয়ে রাখতে পারছিলেন না।

বিজ্ঞাপন

নিজে বাদি হয়ে মামলা করেছিলেন। নিজের জঙ্গী বিরোধী তৎপরতার কথা উল্লেখ করে সন্দেহের তীরটা জঙ্গীদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। সবাই বিশ্বাসও করেছিল। ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছিল তাদের সুখী দাম্পত্যের নানা ছবি আর গল্প। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বাবুল দুই সন্তান নিয়ে উঠেছিলেন শ্বশুড়ের বাসায়। কথা হচ্ছিল, শ্যালিকার সাথে তার বিয়েরও। সব প্লট মতই এগুচ্ছিল। কিন্তু সব খুনীই কোনো না কোনো ক্লু রেখে যায়, এই কথাটি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। সিসিটিভি আছে, এমন একটি জায়গায় খুন করানোটা তার প্রথম ভুল। তবে বাবুল আক্তারের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায় ঘটনার পর মূল পরিকল্পনাকারী মুছার সাথে তার ২৭ সেকেন্ডের টেলিফোন কথোপকথনে। মূল পরিকল্পনাকারী বাবুল আক্তার মাঠে মূল বাস্তবায়নকারী মুছাকে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, তুই কোপাইলি কেন?

ধরা পরা দুই আসামির জবানবন্দীতেও পরিস্কার হয় অনেক কিছু। আমার ধারণা প্রাথমিক ধাক্কা কাটানোর পর পুলিশও বুঝে গিয়েছিল, এই ঘটনা বাবু্লই ঘটিয়েছে। তবে পুলিশের ভেতরের অনেকেই বাবুলকে বাঁচানোরও চেষ্টা করেছেন। অভিযুক্ত দুই আসামি মারা যায় ক্রসফায়ারে। মূল বাস্তবায়নকারী মুছাকে গায়েব করে দেয় পুলিশ। পুলিশের কোন কোন সদস্য মুছাকে তুলে নিয়ে গেছে, তাও জানিয়েছিলেন তার স্ত্রী। কিন্তু পুলিশ কখনোই তা স্বীকার করেনি। বাবুল আক্তার নিজের পরকীয়া আড়াল করতে মিতুর পরকীয়ার গল্প বাজারে ছেড়েছিলেন, তবে সেটি মার্কেট পায়নি।

বিজ্ঞাপন

বাবুল আক্তার এতটাই নিখুঁত অভিনয় করেছেন যে, বাইরের লোক তো বটেই এমনকি এক বাসায় থেকে তার শ্বশুরও কিছুই বুঝতে পারেননি। বরং তিনি বাবুলের পক্ষেই সাফাই গাইছিলেন। তবে মিতুর বাবা বছরখানেকের মধ্যে বুঝে যান, ঘটনা কী। স্ত্রীকে খুন করিয়ে লাশের পাশে বেসামাল কান্নাকাটি করে আবার দুই সন্তান নিয়ে সেই মিতুর বাসাতেই ওঠা! অবিশ্বাস্য। তার নার্ভ স্টিলের মতো।

আমার ধারণা, মুছাকে ধরা এবং গায়েব করার পরই পুলিশ শতভাগ নিশ্চিত হয় মিতু হত্যার সাথে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়ে। গোয়েন্দা পুলিশ তাকে ডেকে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেয়। তখনই আমি সন্দেহ করেছিলাম। গোয়েন্দা পুলিশ হয়তো বাবুল আক্তারের সামনে দুটি অপশন দিয়েছিল- হয় পদত্যাগ করো নয় খুনের মামলায় জেলে যাও। বাবুল আক্তার প্রথম অপশনটি বেছে নিয়ে এবং পদত্যাগ করে বেসরকারি এক হাসপাতালে চাকরি নিয়ে আড়ালে চলে যান।

বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যেই দেখি তারা বাহিনীর ভাবমূর্তি এবং কর্মীদের মনোবলের দোহাই দিয়ে নিজেদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করেন। এই মনোভাবটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। একজন ব্যক্তির অপরাধের কারণে পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি বা কর্মীদের মনোবল কীভাবে ক্ষুন্ন হতে পারে। বরং একজন ব্যক্তির অপরাধের যথাযথ সাজা হলে বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং অন্যরা অপরাধ করার আগে দ্বিতীয়বার ভাববে। আর কার্পেটের নিচে ময়লা রাখলে ঘর পরিস্কার হয় না। আমি তখনই লিখেছিলাম, যদি বাবুল আক্তার অপরাধী না হন তাহলে তাকে সম্মানের সাথে চাকরির সুযোগ দিতে হবে। নইলে তাকে অপরাধী হিসেবে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। কিন্তু তখন গোয়েন্দা পুলিশ বাবুল আক্তারকে গুরুপাপে লঘুদন্ড মানে খুনের অপরাধ চাকরি থেকে পদত্যাগের শর্তে ছাড় দিয়েছিল।

যদিও পুলিশ তখন দাবি করেছে, এই ঘটনায় বাবুল আক্তারের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি এবং তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। এই দাবি যদি সত্য হয়, তাহলে পুলিশ বাহিনী খুব অমানবিক আচরণ করেছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বাবুল আক্তার যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তখন পুরো বাহিনীর উচিত ছিল এই চৌকস কমর্কতার পাশে দাঁড়ানো। চাইলেও তিনি যাতে পদত্যাগ করতে না পারেন, তা নিশ্চিত করা। আর যদি তারা বুঝেই থাকেন, বাবুল আক্তারই মূল অপরাধী, তাহলে তখনই তাকে আইনের হাতে তুলে দেয়া উচিত ছিল।

পাঁচ বছর পর হলেও পিবিআই একটি ভয়ঙ্কর সত্যকে সামনে এনেছে। বাবুল আক্তারের মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ার পর মিতুর বাবা বাদি হয়ে নতুন মামলা করেছেন, যাতে বাবুল আক্তারকে আসামি করা হয়েছে। পিবিআইকে এখন আরো একটি তদন্ত করতে হবে, পুলিশের কারা বাবুল আক্তারকে বাঁচাতে চেয়েছিল, কারা এতবড় একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডকে ধামাচাপ দিতে চেয়েছে, কারা দুই আসামিকে ক্রসফায়ারের নামে খুন করেছিল, কারা মুছাকে গায়েব করে দিয়েছিল; তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে। এই ঘটনায় প্রত্যেক ধাপে আইনের মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটেছে। অপরাধ ঢেকে রাখা বা ঢাকতে সাহায্য করাও অপরাধ। তাই শুধু বাবুল আক্তার নয়, তাকে বাঁচাতে চাওয়া প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে।  তাহলেই শুধু পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

প্রমাণিত হবে, যে বা যারাই অপরাধ করুক, আইনের চোখে সবাই সমান। পরিকল্পনা করলেও  ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকায় বাবুল আক্তার হয়তো আইনের কিছু সুবিধা পেতে পারেন। তবে যে পিতা তার সন্তানের সামনে মাকে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারে, মায়ের রক্তে যে সন্তানের গা ভিজিয়ে দিতে পারে; এমন ঠান্ডা মাথার খুনীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই ঘটনায় বাবুল-মিতু দম্পতির দুই সন্তানের জন্য বেদনায় আমার হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে। মা নিমর্মমভাবে খুন হয়েছেন আর সেই খুনের পরিকল্পনাকারী তাদের বাবা। আহারে এই দুটি শিশু কী বিশ্বাস নিয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে?

 

শুরুতেই সিনেমার কথা বলছিলাম। এই ঘটনা থ্রিলার সিনেমাকেও হার মানাবে। এই ঘটনায় সিনেমা বানাতে চিত্রনাট্যকারকে খুব বেশি কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে না। প্রেম, পরকীয়া, দাম্পত্য, সন্দেহ, যৌনতা, নৃশংসতা, নাটকীয়তা সবই আছে। একটি সিনেমার নাম আছে ‘স্বামী কেন আসামি’। এই সিনেমার নাম হতে পারে ‘স্বামী কেন আসামি-২’ বা ‘বাদী যখন আসামি’। আরেকটি বাংলা সিনেসার নাম ছিল ‘বাদি থেকে বেগম’, আর এই সিনেমার নাম হতে পারে ‘বাদী থেকে আসামি’। সিনেমায় বাবুল আক্তারের চরিত্রে যেই অভিনয় করুন, তারচেয়ে ভালো কেউ পারবেন না, এটা নিশ্চিত।

লেখকপ্রভাষ আমিনহেড অব নিউজএটিএন নিউজ