‘দেশ চালাচ্ছে কারা’
ভারতের বাংলা নিউজ চ্যানেল জি ২৪ ঘণ্টার এডিটর অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মারা গেলেন (১৬ মে ২০২১), তখন জানা গেলো যে তার বড় ভাই আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চিফ সেক্রেটারি। বিরাট আমলা হওয়ার আগে আলাপনও ভাইয়ের মতো সাংবাদিক ছিলেন।
সাংবাদিকতা ছেড়ে আমলা পদে আলাপন স্বার্থক। পেশার সর্বোচ্চ ধাপে উঠেছেন এবং ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের টানাপোড়নের রাজনীতিতে নিজেকে সফলভাবে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। কেন্দ্রের বদলির নির্দেশ উড়িয়ে দিয়ে তিনি চাকরি ছেড়ে রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় উপদেষ্টা হয়েছেন। লিখেছেন 'আমলার মন' নামে একটি গ্রন্থও।
আধুনিক রাষ্ট্রে প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা। যারা সরকারের থাকেন, তাদেরকে সার্বক্ষণিক প্রশাসনের মনের খবর রাখতে হয়। তাদের গতিবিধি নজরেও রাখতে হয়। 'আমলার মন' আসলেই শাসনের ক্ষেত্রে জরুরি বিবেচ্য বিষয়।
এ কথা সবার জানা যে, ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার বহন করে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোতে আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। উল্লেখ্য যে, এ অঞ্চলে রাষ্ট্রগঠনের আদি পর্বে প্রশাসক তথা আমলাতন্ত্রের যথেষ্ট ভূমিকা ও উচ্চতর অবস্থান ছিল। যদিও ঔপনিবেশিক আমলে সাহেব সিভিলিয়ানরা অপ্রতিহত প্রাধান্যে ছিলেন, তথাপি স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক কাঠামোতে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
তারপরেও উপমহাদেশে প্রশাসকরা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গােষ্ঠী হিসেবে গড়ে ওঠেন এবং সাহিত্য থেকে রাষ্ট্রচিন্তা পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রেই তারা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। গণতন্ত্রের প্রসার ও স্বাধীনতার পর এদের খর্ব দেখায় এবং এরা অনেকেই হীনতা-অনুভূতির শিকার হন । প্রশাসক-রাজপুরুষদের মানসিক বিবর্তনের সেই বৃহৎ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যয়ন ও সমীক্ষার ক্ষেত্র।
বাংলাদেশে বিশেষ লক্ষণীয় না হলেও ভারতের আমলারা স্মৃতিচারণ ও আত্মজীবনীমূলক বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন, যাতে অমাত্য থেকে কেরানি হয়ে পেয়াদা-চাপরাশি পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের রাজকর্মচারীদের অন্তরঙ্গ আলেখ্য স্থান পেয়েছে। বস্তুত আমলা-বৃত্তান্তে ধরা পড়ে প্রশাসনের ভিতরকার পাঠ আর আমলার মন এবং রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে তাদের আন্তঃসম্পর্কের নানাবিধ মাত্রা।
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই তপন বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেছেন ‘আমলাগাছি' নামের একটি বই। তাতে প্রকাশ পেয়েছে প্রশাসনের অন্দরমহলের বহু আখ্যান। যদিও আপাতদৃষ্টিতে একজন আমলাকে বাইরে থেকে মনে হয় সুখী রাজপুত্রের মতাে। একদিকে তার উপর অর্পিত সরকারি ক্ষমতা, অন্যদিকে স্বচ্ছল জীবন। আবার জনপ্রতিনিধি থেকে বাইরের মানুষজন, সবারই ধারণা আমলাদের অনড় অবস্থানের কারণেই থমকে থাকে সরকারি কাজ। তাদের এক কলমের খোঁচায় নড়ে যেতে পারে বহুদিনের জগদ্দল পাথর, অথচ কলম উদ্যতই থাকে। জবরদস্ত লাল ফিতের ফাঁসে বাইরের মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। এমনটাই আমলাতন্ত্র সম্পর্কে সর্বসাধারণের মনোভাব।
কিন্তু কী ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে হয় একজন আমলাকে তার খবর রাখেন না বাইরের মানুষ । আমলার চাকরিতে থাকে বহুমুখী রাজনৈতিক চাপ, সামলাতে হয় নানা কর্তার প্রভাব আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হুমকি, রক্ষা করতে হয় নিরপেক্ষতা। অন্যদিকে রাখতে হয় সরকারি নিয়ম, আইন ও বিধি পালনের বাধ্যবাধকতা এবং জনসম্পদ তথা বিপুল অঙ্কের টাকার চুলচেরা হিসাব।
এসবই আমলাতন্ত্রের সদস্যদের তাত্ত্বিক দায়িত্ব, যা ব্যবহারিকভাবে পালন করা তার কর্তব্য। এসব মেনে একজন আমলা পেশাজীবনে সফল হন। তবে, কখনও কখনও, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশে আমলাতন্ত্রের নৈর্ব্যক্তিক-নিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হয়। অভিযোগ উঠে প্রশাসনের রাজনীতিকরণের। আমলা তখন সমালোচিত হন। বাংলাদেশেও তারা এবার আলোচনার ইস্যুতে পরিণত হয়েছেন।
'দেশ চালাচ্ছে কারা'-এমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে সংসদে। সোমবার (২৮ জুন) সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ এ প্রশ্ন তোলেন।
পরে একই সুরে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ দলীয় সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী এমপিরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে।
মোদ্দা কথায়, যত মেধাবী আর দক্ষই হোক না কেন, আমলাতন্ত্রকে কাজ করতে হয় জনপ্রতিনিধিদের অধীনে। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনেই কাজ করতে হয় আমলাতন্ত্রের সদস্যদের। এটাই গণতন্ত্রের চূড়ান্ত ফায়সালা।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম