কোভিড-১৯: জীবন, জীবিকা ও করণীয়

  • মো. মামুন হাসান বিদ্যুৎ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বের অনেক দেশের ন্যায় বাংলাদেশের মানুষ শুধু মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীনই হয়নি, উপরন্তু তাদের জীবন ও জীবিকাও মারাত্মক সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ করোনার চেয়ে জীবিকা নিয়ে বেশি শঙ্কিত ও বিচলিত। করোনা সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ।

করোনা মোকাবিলায় সরকার ১ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত সারাদেশে এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউন জারি করেছে। বলা হয়েছে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না এবং যারা বিধিনিষেধ মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের জারি করা সর্বাত্মক লকডাউন পালনের জন্য যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা কতটুকু প্রতিপালিত হবে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা থেকেই যায় -বাংলাদেশের মতো গরিব এবং জনসংখ্যাবহুল দেশে সর্বাত্মক লকডাউন কি সম্ভব? আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দিন আনে দিন খায়। খাদ্য মজুদ করে রাখার মত তাদের তেমন সঞ্চয়ও নেই।

বিজ্ঞাপন

মহামারি কোভিড-১৯ এর পাশাপাশি বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিবছর অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, টর্নেডো, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্পসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। এতে প্রাণহানি, ভূমি ও সম্পদ বিনষ্ট ও বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।

করোনার কারণে বছরজুড়ে চাপে রয়েছে সমষ্টিক অর্থনীতি। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে মন্দা বিরাজ করছে। জাতিসংঘের মতে, করোনা মহামারিতে বিশ্বজুড়ে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই ২০২১ সালে ২৩.৫ কোটি মানুষের জরুরি মানবিক সাহায্য প্রয়োজন।

বিজ্ঞাপন

আর আইএমএফ এর মতে, ১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে মহামারি করোনাভাইরাস। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপুঁজি ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে বিপর্যয়ে পড়েছে। অথচ শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট শ্রমিকের (৬ কোটি) শতকরা ৮০ ভাগ নিয়োজিত এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট জিডিপির শতকরা ২৫ ভাগ অবদান রাখে এ শিল্প।

প্রথম পর্যায়ে করোনার ক্ষতি মোকাবিলা তথা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য সরকার ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০,০০০ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকগুলো ঋণ ফেরত না পাওয়ার শঙ্কায় মাত্র ২০ শতাংশের কাছাকাছি ঋণ বিতরণ করে।

দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৪০.৬ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। কৃষির উৎপাদন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, মূল্য সংযোজন হয়েছে, তবুও কৃষি তুলনামূলক অলাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মহামারি করোনার কারণে খাদ্য উৎপাদনে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কৃষির বিপণনে।

অপ্রতুল ঋণসুবিধা, চলমান লকডাউনে বিপণনে সমস্যা, মধ্যস্বত্বভোগীদের উপস্থিতি, প্রণোদনার অব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত বাজারজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ক কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের অভাবে কৃষক ও কৃষি আজ গভীর সংকটময় অবস্থায় অবস্থান করছে।

করোনার প্রভাবে ইতিমধ্যে বেকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। আইএফসির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনাকালে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানাচ্ছে, ২০২০ সালের মার্চ মাসে বেকারত্ব ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ, যা জুলাই ২০২০-এ, ১০ গুণ বেড়ে হয়েছিল ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতের অগ্রাধিকার কৌশলে আমাদের গুরুত্বারোপ করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাপনা, খাদ্য উৎপাদন এবং পণ্য পরিবহন নিশ্চিতকরণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। একমাত্র কৃষিই পারে দুই -তিন বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখতে।
পাশাপাশি অকৃষি খাতের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাগুলোকে চাঙ্গা করে তোলা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের চাকা না ঘোরাতে পারলে আমাদের উদীয়মান অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। এ শিল্পের দিকে না তাকালে বেকারত্ব অতিদ্রুত বেড়ে যাবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হবে। মুখস্তভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে আগামী দিনের কর্মজীবী তৈরি করতে। অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে গুরুত্বারোপ করতে হবে। শ্রমঘন খাতগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি করে এই পথে এগুতে হবে। ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিতকরণ সহ প্রণোদনা প্যাকেজে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়েও ভাবতে হবে। আর দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে গরিব মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের রেশন ব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। ঘরে যদি নূন্যতম খাবারের সংস্থান না থাকে, তাহলে ঘরবন্দি, স্বেচ্ছা অবরোধ বা সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। জাতীয় পর্যায়ে করোনা মোকাবিলার স্বার্থেই কেবল নয়, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া এসব জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা থেকেই আপৎকালে তাদের খাবার ও ওষুধের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: মো. মামুন হাসান বিদ্যুৎ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।