পাহাড়ের পাদদেশে মরণ বসতি- দায় কার?
প্রতি বছর বর্ষা এলেই পাহাড়ের পাদদেশে কান্নার ধ্বনি প্রকট হয়ে উঠে। নতুন মৃত্যুর খবর চাউর হলে কর্তৃপক্ষের লোকজন রঙীন পোশাক পরে লাল হেলমেট মাথায় দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে ছুটতে থাকেন উদ্ধার কাজে। বালুর ঢিবি, গাছ-পালাসহ কাদার স্তুপ ও পাহাড়ি ঢলের স্রোতে উদ্ধার করা হয় শত শত মৃতমানুষ-যার বেশারভাগই ঘুমন্ত শিশু ও মহিলার নিথর কাদামাখা দেহ। সংবাদকর্মীরাও সোৎসাহে লাইভ প্রচার শুরু করে দেন। শহুরে সভ্য মানুষ ঘরে বসে সেসব দৃশ্য দেখেন আর হায় হায় করেন।
কেউ শুধু ইন্নালিল্লাহ্ পড়ে নিয়ে খানিকক্ষণ কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করে চ্যানেল পরিবর্তন করে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যান। এই তো নিয়তি, এটাই দেখে আসছি বহু বছর ধরে। প্রতি বছর ভূমি ধ্বসে মানুষের অকাল মৃত্যুতে পাহাড়ের পাদদেশে পৌনঃপুনিক কান্নার রব উঠে। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। রিপোর্ট জমা দেয়া হয়। তারপর কী যে হয় তা আর জানার উপায় থাকে না।
কারণ, এসব তদন্তেও ‘ধরি মাছ নাছুঁই পানি’-র মত বিষয়গুলো এসে বাগ্ড়া দেয়। ফলে যার ক্ষতি হয় সেই তার মর্মব্যাথা বুঝে, আহাজারি করে। নিস্ফল আহাজারি আর্তনাদ একসময় বাতাসে মিলিয়ে গেলে সব চুপচাপ। যেন সমাধান হয়ে গেছে কোনভাবে-এমন পরিস্থিতির কথা প্রচারিত হতে থাকে। কিন্তু আবার যে বর্ষাকাল আসছে সামনে।
আবার যে বালু-মাটির পাহাড়ে চিড় ধরেছে,একটু বেশী বৃষ্টিপাত হলে পুনরায় টিনের চালার বাড়ি-ঘর, আসবাব, ঘুমন্ত শিশু, মানুষ সবাইকে জীবন্ত কবর দিয়ে করুণ আর্তনাদ সৃষ্টি করবে তা কর্তপক্ষ ভুলে যান। তাদের সেসব কথা ভুলে যাবার কারণ অনেক।
বাংলাদেশে পূর্ব-দক্ষিণে কয়েকটি জেলায় পাহাড়ের অবস্থান। সেগুলোতে যুগ যুগ ধরে স্থায়ীভাবে বাস করা পাহাড়ী জনগোষ্ঠী রয়েছে। রয়েছে তাঁদের আদি বাসস্থান, জুমচাষ, নিজস্ব কৃষ্টি ও ঐতিহ্য। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ পাহাড়ের গায়ে বসতি স্থাপন করে বাস করে আসছেন।
তার সংগে যুক্ত হয়েছে সমতলের মানুষের অভিবাসন করে পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করার প্রবণতা। সম্প্রতি আরো যুক্ত হয়েছে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমন ও পাহাড়ের সন্নিকটে তাদের বসতি গড়ে থাকতে দেয়ার অনুমতি। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা এস হাজার হাজার গাছ কেটেছে, পাহাড় কেটে মাটি সমান করে ঘর তুলেছে। পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটাই বিনষ্ট হয়ে পড়েছে।
দু’দিকে উচু পাহাড়। ঢালের মধ্যে এবং ঢালের নিচে সামান্য সমতল মাটিতে তাদের বসত ঘর। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়াও বর্তমানে ৮টি উপজেলায় ৫০ হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের ঢালে ঘর তুলে বসবাস করছে। কক্সবাজার জেলাশহরের কাছাকাছি ছাড়াও টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকোরিয়া, পেকুয়া প্রভৃতি এলাকা প্রচন্ড ভূমিধ্বসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কিছুদিন আগে রাঙ্গামাটিতেও ৬টি দোকান ধ্বসে পড়েছে।
২০২১ সালে ২৮ জুলাই টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে পাহাড় ধ্বসে একই পরিবারের পাঁচজন শিশু নিহত হয়েছে। এর একদিন আগে উখিয়ার বালুখালি ১০নং রোহিঙ্গা শিবিরে ৫ জন মারা গেছে। তারা সবাই শিশু।
পাহাড়ের পাদদেশে মরণ বসতি তৈরীর প্রবণতা বন্ধ না হয়ে দিন দিন বেড়ে চলেছে। তার কারণ বহুমূখী। মানুষের চাপে প্রচলিত কৃষিব্যবস্থায় জুম চাষের পরিবর্তে কোদাল-লাঙ্গলের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে। পাহাড়ের মাটি কেটে সমতলের মত সমান করে কৃষি জমি বাড়ানো হচ্ছে। ২০০৭ সালে ব্যাপক পাহাড় ধ্বসে ১২৭ জনের করুণ মৃত্যু ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সেই তদন্ত কমিটি একটি রিপোর্ট দেয়। এরপর ২০১৭ সালের ভূমিধ্বসে বহু প্রাণহানির ঘটনার পর আরেকটি তদন্ত কমিটিও একইরুপ রিপোর্ট প্রদান করে।
কমিটির রিপোর্ট বলা হয়, ভূমিধ্বসের মূল কারণ পাহাড় কর্তন করা। পাহাড়গুলো বালুময়। বালু কাটলেই পাহাড়ের গাঠনিক প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়। সামান্য বৃষ্টিতেই বালু ভিজে ফাটল তৈরী হয়। বৃষ্টিপাত কিছুটা বেশী হলেই বালু গলে ফাটল তৈরী করে ও বড় বড় বালুমাটির চাই সহ নিচে গড়িয়ে পড়ে বাড়ি-ঘর, আবাদী জমি, মানুষ, গবাদিপশু সবকিছুকে চাপা দিয়ে কাদা-সমাধি তৈরী করে ফেলে মুহূর্তেই। কিছু বুঝে উঠার আগেই সবকিছু কাদায় ডুবে যায় ও মৃত্যু ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। বিশেষ করে অতি বৃষ্টির সময় বেশীরভাগ ভূমিধ্বস ঘটে থাকে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় উদ্ধার কাজে দেরী হয়।
এছাড়া আরেকটি বড় কারণ হলো রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রভাবশালীরা ভূমিহীন, গৃহহীন দরিদ্র মানুষকে দিয়ে পাহাড়ি জমি দখল করিয়ে ঘর বানিয়ে ভাড়া দেয়। প্রভাবশালীরা তাদেরকে পেশীশক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। সমুদ্রে মাছ ধরা, ভোটের সময় কেন্দ্র দখল ও মিয়ানমার থেকে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক চোরাচালানের কাজে নিয়োজিত করে।
হতদরিদ্র মানুষ সহজে আয়ের উৎস খুঁজে পেয়ে শত বিপর্যয়ের মুখেও পাহাড়ি বসতবাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যেতে চায় না। বর্ষাকালে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কায় মাইকিং করে আশ্রয় কেন্দ্রে যতে বললেও তারা বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যায় না। কারণ, সেটা অন্য কেউ দখল করে নিতে পারে সেই ভয়ে তটস্থ থাকে তারা।
মূলত: রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে পাহাড় কাটা বন্ধ হয় না। প্রভাবশালী মহলের আস্কারায় নিরীহ দরিদ্র মানুষগুলো এসব ভঙ্গুর বালুর পাহাড়ের পাদদেশে বসতি গড়ে বসবাস করে। এভাবে নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে প্রতিবছর শত শত মানুষ আত্মাহুতি দেয়। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এর সবকিছুই অবগত আছেন। কারণ, তাঁদের হাতে এসব মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটনার কারণসহ তদন্ত রিপোর্ট রয়েছে। হোমরা চোমড়া প্রভাবশালী মহল ও দুর্বল আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের ফলে ‘যে লাউ সেই কদু’-র মত এসব সমস্যা যুগের পর যুগ বহাল থাকে। দারিদ্র্য নিরসনে সরকারী কমিটমেন্ট শক্ত করে নির্দেশিত হলেও মাঠপর্যায়ে সেগুলো বাস্তবায়নের সময় দায়সারা নীতি ও নানা অজানা কারণে কোন টেক্সই সমাধান লক্ষ্য করা যায় না।
তাই আসুন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড় হত্যা বন্ধ করি। পাহাড়ের নরম বালুময় পাদদেশে নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ বন্ধ করতে আইন পাশ করি ও তা বাস্তবায়নে জোর দিই।
আসুন লোভ-লালসা ভুলে সবাই মানবিক হই। সকল অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে কঠোর নৈতিকতার সাথে দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করি। প্রভাবশালীদের অবৈধ পাহাড় কর্তন ঠেকাতে তৎপর হই, ফিবছর দুর্বল পাহাড়ের পাদদেশে পুনঃপুন ভূমিধ্বসের আঘাতে মৃত্যুর হাত থেকে মূল্যবান জীবন বাঁচাই।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।