মত যখন ভিন্ন, অনুভূতির আঘাত কি বেশি তীব্র!
বাকস্বাধীনতা বা মুক্ত মতপ্রকাশের সঙ্গে আরেকটি বিষয় অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত, সেটি হচ্ছে শ্রবণের বা পড়ার স্বাধীনতা। যারা বাকস্বাধীনতা নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকেন বা চাপা দিতে চান, তারা এই বিষয়টিকে বরাবরই এড়িয়ে যান।
উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরেকটু খুলে বলি, ধরে নিন একটি কনফারেন্সে ১০ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন ১০টি দেশ থেকে। সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে ডেনমার্কের একজন প্রতিনিধি তার অভিজ্ঞতা এবং প্রাপ্ত জ্ঞান থেকে এমন সব সমালোচনা করছেন, যেটা বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমার জানা মতে, ‘সত্য নয়’, বরং আমার জন্য অপমানজনক। তাহলে কি আমি ডেনমার্কের ব্যক্তির বক্তব্যে বাধা দিবো? বা তার দিকে তেড়ে যাবো মারার জন্য? বাকস্বাধীনতা হচ্ছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে মত প্রকাশের অধিকার সেই ডেনমার্কের প্রতিনিধির যেমন রয়েছে, তেমনি সেই বক্তব্য না শুনে কনফারেন্স স্থান ত্যাগ করার অধিকারও আমার রয়েছে। তবে যদি এমন হয় যে সেই কনফারেন্সের চেয়ারে আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে জোর করে কথাগুলো শোনানো হচ্ছে, আমার শ্রবণ ইন্দ্রিযয়ে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে, সেটা অবশ্যই অপরাধের পর্যায়ে পড়বে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে যে গবেষণাগুলো হয়েছে, সেখানে ফেক নিউজ কেন মানুষ বিশ্বাস করে, সেই প্রশ্নটিও বারবার উঠে এসেছে। কারণ খুঁজতে যেয়ে দেখা যায়, মানুষ যেটা বিশ্বাস করতে চায় সেটাই দেখতে চাওয়ার প্রবণতা থেকে ফেক নিউজ বা ভুল তথ্যকে বিশ্বাস করে। এমনকি মিথ্যা জেনেও! এই বিশ্বাসটা যে আনমনে চলে আসে তা নয়, বরং ‘বিশ্বাস করে’ বলেই সে বিশ্বাস করে। যার কারণে ফ্রয়েড আনকনসাস শব্দটিকে অনেক আগেই অস্বীকার করে গিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এই বাকস্বাধীনতা বা মুক্ত মত প্রকাশের বিষয়টি বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। একদল লোকের মতে, ‘বাক স্বাধীনতা মানেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নয়,’ আরেক দল লোক মনে করেন, ‘বাক স্বাধীনতা মানে দেশের অস্তিত্বে আঘাত নয়,’ আবার অনেকের মতে, ‘বাক স্বাধীনতা মানে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের ওপর আঘাত নয়’। এগুলো সবগুলোই উদাহরণ। মূল কথাটা হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই সংখ্যাগুরু মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী নিজের মতের বিরুদ্ধে কোন কথা যেমন শুনতে চায় না, তেমনি অন্যের মতকে আক্রমণ করার জন্য বাক স্বাধীনতার আশ্রয়ও চাইছে।
কেউ যে ‘মত’কে অস্বীকার করতে চায়, সেটি কিন্তু নয়। ‘মত’কে যদি দুই ভাগে ভাগ করি। একটি ভিন্ন মত, আরেকটি সহ-মত। সহমত হলে কিন্তু সেই বিষয়ে নেতা থেকে শুরু করে পথের ধারে দক্ষিণে ঝুঁকে পড়া নারিকেল গাছেরও কোন অভিযোগ নেই। তবে ভিন্নমত হলে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন হয়ে উঠে। সেখানে চলে আসে, নিজ মতামতকে অসন্মান করার বিষয়টি বা সোজা সাপ্টা সেই মতকে ‘জানে না’, ‘দেশ বিরোধী’, ‘ধর্ম বিরোধী’,সহ বিভিন্ন তকমায় রাঙিয়ে দেওয়া। এই যে মতকে অস্বীকার করা বা সেটিকে বিভিন্ন রঙে রাঙানোর অধিকার কিন্তু শ্রোতা বা পাঠকের রয়েছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সংকটটা তৈরি হয়, যখন সেই ভিন্নমতকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, ভিন্নমতের ওপর হামলা করাকে সমর্থন করা হয়।
ভিন্নমতকে কোনঠাসা করে রাখলে কি হতে পারে? আসুন ইতিহাস থেকে একটি বড় ঘটনার বিশ্লেষণ করি। পৃথিবীর সৃষ্টি আর আকারের সঠিক ধারণা ছিল মানব ইতিহাসে এক বড় ধাক্কা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ দশকেই ঈজিয়ান অঞ্চলের জ্যোতির্বিদ অ্যারিস্টারকাস সূর্যকে বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু বলে গণ্য করেছিলেন। সেসময় গ্রীক দার্শনিক টলেমি বা তাঁর অনুসারীরা কিন্তু এ মতবাদ গ্রহণ করেননি। কারণ এটি ছিল তাদের জন্য ভিন্নমত। ফলে এ মতবাদের বিরোধিতা করেছেন জোরালোভাবে। তাঁরা বলতেন, বিশ্বের সকল বস্তু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান। পরবর্তীতে টলেমিকে অনুসরন করেছেন প্লেটো এবং এরিস্টটল। তারাও অ্যারিস্টারকাসের এই মতকে বন্দী করে রাখেন এবং প্রচলিতধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মত দেন যে,‘পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র।’ এরপর আর কেউ সাহস করেনি এই মতবাদকে ভাঙার। কারণ তৎকালীন গ্রিস, তথা পশ্চিমা বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতো তাদের এই দার্শনিককূলের মতামতের ওপর। কেটে যায় ২ হাজার বছর।
এরপর যখন ১৫ শতকে কোপার্নিকাস এসে সুসঙ্গতভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত গ্রহসমূহের ধারণা নিয়ে ভাবেন। ‘ভাবেন’ বললাম, কারণ তিনি সাহস পাচ্ছিলেন না প্রচলিত বিশ্বাসকে ভাঙতে। কারণ তার ওই মত অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে যেমন আঘাত হানতে পারে, তেমনি সৃষ্টির ধারণাকেও বদলে দিতে পারে! তার এই মতবাদ লিপিবদ্ধ হওয়ার পরেও দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় অপ্রকাশিত রাখতে হয়। কোপার্নিকাস তার নতুন মতবাদের বিষয়বস্তু নিয়ে একটি পান্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে সেটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি তার বন্ধুদের মাঝে প্রচার করেন। এরপর ২২ বছর পর মতবাদটি প্রকাশের অনুমতি পান তিনি। তার ছাত্র রেটিকাসের প্রচেষ্টায় এই মতকে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। পান্ডুলিপিটি মুদ্রণের জন্য জার্মানির নুরেমবার্গে নিয়ে যান রেটিকাস। কিন্তু সেখানে মার্টিন লুথার, ফিলিপ মেলান্সথন ও অন্য সংস্কারকদের বাঁধার কারণে আর প্রকাশ করা যায়নি। রেটিকাস নুরেমবার্গ থেকে লাইপজিগে চলে যান এবং প্রকাশনার দায়িত্ব দেন আন্দ্রিয়াস ও সিয়ান্ডারের হাতে।
মতবাদটি প্রকাশের আগেই সমালোচনার ভয় পাচ্ছিলেন সিয়ান্ডার, কোপার্নিকাসের সঙ্গে তারও জীবন হারানোর ভয়ে। তাই গ্রন্থের সাথে একটা মুখবন্ধ জুড়ে দিয়ে তিনি লিখেন, ‘এ বইয়ের বিষয়বস্তু পুরোপুরি সত্য নয়। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।’এই কথাটি বলে তিনি নিজেকে নিরাপদ রাখলেন এবং বইটি থেকে অ্যারিস্টার্কাসের নাম মুছে ফেললেন। যিনি প্রথম বলেছিলেন,‘সূর্য স্থির পৃথিবী গতিশীল।’ শুধুমাত্র মত প্রকাশ করতে না পারার কারণে পৃথিবী, তথা সৃষ্টির ধারণা থেকে ২ হাজার বছর পিছিয়ে গিয়েছিল বিশ্ব। এখন কথা হচ্ছে, ২ হাজার বছর কেন লাগলো! সত্যটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে! কারণ ক্ষমতাশালীরা এবং মতের সংখ্যাগুরুত্ব এতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে সেখানে ভিন্নমত কোন স্থানই পায়নি।
তাই ভিন্নমতকে যদি আমরা জাগতে না দেই এবং অনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয়ে থাকি, তাহলেতো এই ভারতবর্ষ থেকে যেমন সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হতো না, তেমনি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও চালু করা যেতো না। ভিন্নমতকে ভাল না লাগলে সেই মত না শোনার অধিকার সকলের রয়েছে। সেই স্থান ত্যাগ করার অধিকার রয়েছে। তবে নিজের অনুভুতিতে আঘাত লাগে বলে সেই মত প্রদানকারীকে হত্যাকারীরা শুধু ব্যক্তিকেই খুন করেন না, সভ্যতাকে পিছিয়ে দেন হাজার বছর। আমাদের এই দেশে ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে ভিন্নমতের কারণে। এছাড়া মাঝে মাঝে চোখে পড়ে, ভিন্নমত বা ভুল তথ্য ফেসবুকে ছড়ানোর অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশকারী ব্যক্তিতে আরেকজন ব্যবহারকারীর ভাল না লাগলে কিন্তু তিনি চাইলে আনফ্রেন্ড করতে পারেন, ব্লক করতে পারেন। এছাড়াও তিনি নিজের পক্ষে মত এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার করতে পারেন। কিন্তু সেটি না করে মামলা হামলা করাটা সবসময় ক্ষমতাশালীদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। যা আসলেই ঘৃণা, হিংসা আর বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। এটা সোজা সাপ্টা কথা যে, নতুন মত বা ভিন্ন মত কারো না কারো অনুভূতিতে আঘাত হানবে, কারো ব্যক্তিগত জীবনকে হয়তো সামনে নিয়ে আসবে, তাই বলে মতের প্রকাশকে বাধা দিলে সেখান থেকে যার উৎপত্তি হতে পারে, সেটি হচ্ছে ‘দানব’।
মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম