নেশায় নিষ্ক্রিয় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট
নেশা দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে নষ্ট হচ্ছে আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যার সুফল প্রদানের ক্ষমতা। বর্তমানে আমাদের দেশ কর্মক্ষম জনসংখ্যার সংখ্যার ভারে এগিয়ে থাকলেও নানা কারণে সেই কর্মক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাদের কারো কাজের দক্ষতা নেই আবার কারো কারো ডিগ্রি ও দক্ষতা থাকলেও সুযোগের অভাবে তারা নিজেদেরকে কাঙ্ক্ষিত কাজে সংযুক্ত করার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে দ্বিবিধ চোরাগলিতে বিপুল কর্মক্ষম মানুষ কর্মহীন থেকে যাওয়ায় আমাদের দেশ অপারগ হচ্ছে কর্মক্ষম মানুষের কর্মশক্তিকে কাজে লাগাতে।
এসকল মানুষের কর্মসুবিধাকে কাজে লাগাতে না পারায় বঞ্চিত হচ্ছে ওরা নিজেরা, ওদের পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। কিছু কর্মক্ষম মানুষ বিদেশে কাজের সুবিধা পেলেও এখনও প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অর্থের অভাবে কোটি কোটি কর্মক্ষম মানুষ কার্যত: বেকার নামক অভিশপ্ত জীবন যাপন করে চলেছে। এদের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকটেপ্রাপ্ত শতকরা ৪২ ভাগ শিক্ষিত বেকারদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। অথচ আমরা গত দশ বছর থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতিক লভ্যাংশ নামক অপার সুবিধার কোটি প্রহর হেলায় পার করে চলেছি।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট হলো কোন দেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ যখন যুব কর্মশক্তি হয়ে পড়ে অথবা অর্ধেকর বেশি জনগণ শ্রমশক্তিকে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম, আত্মনির্ভরশীল জনসংখ্যার হার বেশি হয়। জাতিসংঘের জনসংখ্য তহবিল (ইউএনএফপিএ)-র মতামত অনুযায়ী এই সুযোগের বয়স ১২ থেকে ৫৯-এর মধ্যে অবস্থান করে। বিশ্বের অনেক দেশেই এই ধরণের সুযোগ একবার আসে। কিন্তু সব দেশ এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে না এবং তাদেরকে কাজে লাগাতে পারে না। আমরাও এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারছি না। এর মূল কারণ আমাদের বর্তমান শ্রমপ্রাচুর্য্য কোনরুপ মূলধনপ্রাচুর্য্য অবকাঠামোর মধ্যে আজও প্রবেশ করতে পারেনি। অধিকিন্তু এরা বেকারত্ব ও হতাশার মধ্যে নিপতিত হয়ে নিজেদেরকে নিষ্ক্রিয় করার ফাঁদে আটকা পড়ে যাচ্ছে।
জনমিতির এই সুযোগ কোন দেশে চিরদিন স্থায়ী হয়ে থাকে না। বাংলাদেশে ২০১২ সাল থেকে এই সুবিধা চলমান থাকলেও আগামী ২০৩৭ সাল পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। সেই হিসেবে আমাদের দেশে আর মাত্র পনেরো বছর স্থায়ী হতে পারে এই সুবিধা।
কারণ এর পর থেকে আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকেবে। কমে যাবে কর্মক্ষম যুবশক্তির সংখ্যা। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মাফিক কাজ বা চাকরির সুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে না। নিয়োগ ক্ষেত্রে চরম দুর্নীতির বিকাশের কারণে আমরা ক্রমাগত মেধাবীদেরকে কাজের সুবিধা দিতে না পারায় এই জনমিতিক সুবিধা হারিয়ে ফেলছি।
ক’বছর আগেও মেধাবীরা বড় বড় চাকরিতে যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেত। এখন সেটা সংকুচিত হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকে গেছে। চাকরির বাজার যেন সোনার হরিণ। সরকারি চাকরিতে চূড়ান্ত নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করার পর নানা ছল-ছুতোয় ২০২০ সালে আড়াই হাজার প্রার্থীকে কাজে যোগদান করতে পারেনি। তাদেরকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নানাভাবে হয়রানি করে সময় ক্ষেপণ করে ফেলা হয়েছে। যথাযথ পেপার ডকুমেন্টস ও প্রমাণপত্রসহ বহু যোগাযোগ করা সত্ত্বেও তাদেরকে নিয়োগ দেয়া দেয়া হয়নি। অনেকের কাছে অনৈতিকভাবে ঘুষের অর্থ দাবি করা হয়েছে। এজন্য অনেকের চাকরি লাভের বিষয়টি আইন-আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে গিয়ে আরো জটিল হয়ে গেছে। দায়িত্বশীল আইন-শৃংখলা বাহিনীর আর্থিক লোভ ও দুর্নীতির বিষয়টি অনেকাংশে প্রধান সমস্যা হিসেবে উন্মোচিত হওয়ায দরিদ্র-মেধাবী প্রার্থীরা অনেকেই মহা ফাঁপড়ে পড়ে চাকরি প্রাপ্তির আশা ছেড়ে দিয়ে চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। এই ওপেন সিক্রেট বিষয়টি আমলে না নেয়ায় শিক্ষিত বেকার যুবশক্তির কেউ কেউ নৈতিক শক্তি হারিয়ে ক্ষোভে, লজ্জায় আত্মহণনের পথ বেছে নিয়েছেন। হয়ে পড়েছেন মাদকাসক্ত। তাদের অনেকে জীবন বাঁচার তাগিদে সহজে কিছু আয়ের আশায় মাদক ব্যবসায় নিজেকে জড়িত করে ফেলেছেন। আবার অনেকে নেশা দিয়ে নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে জীবনের গতিপথ হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছেন।
পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নানাভাবে হয়রানি শুধু চাকরিপ্রাপ্তি বা নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয় বরং প্রমোশন, মামলা, পাসপোর্ট তৈরি ইত্যাদির ক্ষেত্র আরো ব্যয়বহুল ও দুর্নীতির অপমানজনক ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে পড়েছে।
এটা অপমানজনক সত্যটি আমাদের চাকরির বাজারে একটি বিষফোঁড়া তা সিডিপি-র সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সিডিপি ১৭টি সেবাখাতের উপর গবেষণা চালিয়ে উদ্বঘাটন করেছে- দেশের সর্বচ্চো দুর্নীতির খাত হচ্ছে পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সর্বোচ্চ দুর্নীতির খাত পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী (৭৪.৪%), পাসপোর্ট (৭০.৫%), বিআরটিএ (৬৮.৩%)। আমাদের এসব সেবা খাতে সর্বোচ্চ দুর্নীতি হয়। এজন্য আমাদের দেশে গড়ে প্রতি পরিবার প্রতি ঘুষ প্রদান করে ৬,৬৯৮ টাকা। ঘুষ না দিলে এসব সেবা পাওয়া যায় না বলে মনে করে ৭১.২% মানুষ। এটা আমাদের সমাজের প্রচলিত সেবাখাতের জনসেবার পরিবর্তে জনগণকে নাজেহাল করার নমুনা।
শুধু নাজেহাল কেন? আসলে এই ধরণের ঘুষ-দুর্নীতি আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। মেধাবীদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ডকেও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। দেশের সামগ্রীক জনসেবা ব্যবস্থা সঠিক মেধাবীদের সেবা বঞ্চিত হয়ে একটি মেধাহীন, দুর্নীতিবাজ চক্রের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে। তাইতো তারা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের’ নৈতিক বাণীর কথা শুনলে মুচকি মুচকি হাসে।
এর ফলে দরিদ্র পরিবারের কোন তরুণ যেমন দেশে চাকরি পাচ্ছে না তেমনি কেউ ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গমন করতে চাইলেও পাসপোর্ট অফিসে হেনস্তার শিকার হচ্ছে। আবার সেখানকার দালাল ও দুর্নীতিবাজ চক্রের জালে পড়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে মোটা অঙ্কের ঘুষের আব্দার সহ্য করতে না পেরে জীবন সম্পর্কে ঘৃণা নিয়ে কালাতিপাত করতে করতে মাদকসেবী হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ আত্মহণনের পথ বেছে নিয়েছে।
অথচ এদিকে কারো সুনজর নেই। সবাই শুধু বক্তৃতা দিয়ে হম্বি-তম্বি করে ক্ষান্ত দিই। একটি বক্তৃতার আসরে বসে কথার ফুলঝুরিতে সবকিছুর উন্নয়নকে উদ্ধার করতে ছাড়ি না। অনেকে অতিকথন ও ফালতু কথার মাধ্যমে নিজেদের ওজন বিনষ্ট ও দেশের মর্যাদাকে জলাঞ্জলি দিতে সরব দেখা যায়।
দেশের কল্যাণ কামনা ও দুর্নীতি করা একসঙ্গে চলে না। দুর্নীতি করে নিজের রসনাতৃপ্ত করে দেশকে রসাতলে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য একদল মানুষ ব্যস্ত রয়েছে। দেশের আপামর জনগণের কল্যাণ কামনাকারী কোন মানুষের এত বেশি জমানো সম্পদ থাকতে পারে না। তা ছাড়া জনগণের উপর জুলুমকারী ও উৎপীড়ক না হলে জননেতাদের এত অবৈধ সম্পদ থাকে কি করে? দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি ও সম্পদের অবৈধ মেরুকরণ বেকারত্মকে আরও মারাত্মক সামাজিক সমস্যায় ঘণীভূত করে ফেলায় মেধার মূল্যায়ণ নিয়ে নিয়োগদাতাদের কোন বিকার নেই।
সেজন্য আমাদের শিক্ষিত, মেধাবী তরুণরা নিজেদের যোগ্যতামতো কোথাও ঠাঁই না পেয়ে ক্রমাগত পথে বসে যাচ্ছে। এ অবস্থা নিরসনের জন্য সুশাসন প্রয়োজন। দেশের প্রচলিত সেবাদান ব্যবস্থাকে কঠোর নৈতিক শৃঙ্খলার মধ্যে এনে একটি উন্নত ব্যবস্থাপনায় রূপান্তর করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এ মুহূর্তে নেশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কর্মশক্তির লভ্যাংশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের কত অংশ ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে নিপতিত হয়েছে সেটা নিরুপণ করাটা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। মাদকের সহজলভ্যতা ও ব্যবসা আমাদের দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের জন্য প্রধান অন্তরায় হিসেবে কেন বিবেচিত হচ্ছে তার কারণগুলো খতিয়ে দেখা এবং সেগুলো নিরসণে যুব উন্নয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশেষ আত্মকর্মসংস্থান ব্রিগেড গঠন করে আশু প্রশিক্ষণ, সুদবিহীন ঋণদান করে কাজের মধ্যে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হবে।
বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের যে বিরল সম্ভানাময় সময় পার করছে তাকে গুরুত্ত্ব দিতে হবে। জনমিতিক লভ্যাংশ মাদক ব্যবসা ও মাদক সেবন করে নেশায় বুঁদ হয়ে উচ্ছন্নে যাবে তা কারো কাম্য নয়। কঠোরভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই ঘৃণিত বিকাশকে বিশেষ কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ এটা আমাদের আর্থ-পরি-সামাজিক, মনো:দৈহিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য চাক্রিকভাবে গুরুত্ব বহন করে। এই সুযোগ আমাদের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ স্বরূপ। সুতরাং এই বিরল সুযোগকে আর কোনভাবে হেলায় হারানোর অবকাশ নেই।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন