নেশায় নিষ্ক্রিয় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নেশা দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে নষ্ট হচ্ছে আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যার সুফল প্রদানের ক্ষমতা। বর্তমানে আমাদের দেশ কর্মক্ষম জনসংখ্যার সংখ্যার ভারে এগিয়ে থাকলেও নানা কারণে সেই কর্মক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। তাদের কারো কাজের দক্ষতা নেই আবার কারো কারো ডিগ্রি ও দক্ষতা থাকলেও সুযোগের অভাবে তারা নিজেদেরকে কাঙ্ক্ষিত কাজে সংযুক্ত করার কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে দ্বিবিধ চোরাগলিতে বিপুল কর্মক্ষম মানুষ কর্মহীন থেকে যাওয়ায় আমাদের দেশ অপারগ হচ্ছে কর্মক্ষম মানুষের কর্মশক্তিকে কাজে লাগাতে।

এসকল মানুষের কর্মসুবিধাকে কাজে লাগাতে না পারায় বঞ্চিত হচ্ছে ওরা নিজেরা, ওদের পরিবার এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। কিছু কর্মক্ষম মানুষ বিদেশে কাজের সুবিধা পেলেও এখনও প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অর্থের অভাবে কোটি কোটি কর্মক্ষম মানুষ কার্যত: বেকার নামক অভিশপ্ত জীবন যাপন করে চলেছে। এদের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকটেপ্রাপ্ত শতকরা ৪২ ভাগ শিক্ষিত বেকারদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। অথচ আমরা গত দশ বছর থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতিক লভ্যাংশ নামক অপার সুবিধার কোটি প্রহর হেলায় পার করে চলেছি।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট হলো কোন দেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ যখন যুব কর্মশক্তি হয়ে পড়ে অথবা অর্ধেকর বেশি জনগণ শ্রমশক্তিকে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম, আত্মনির্ভরশীল জনসংখ্যার হার বেশি হয়। জাতিসংঘের জনসংখ্য তহবিল (ইউএনএফপিএ)-র মতামত অনুযায়ী এই সুযোগের বয়স ১২ থেকে ৫৯-এর মধ্যে অবস্থান করে। বিশ্বের অনেক দেশেই এই ধরণের সুযোগ একবার আসে। কিন্তু সব দেশ এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে না এবং তাদেরকে কাজে লাগাতে পারে না। আমরাও এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারছি না। এর মূল কারণ আমাদের বর্তমান শ্রমপ্রাচুর্য্য কোনরুপ মূলধনপ্রাচুর্য্য অবকাঠামোর মধ্যে আজও প্রবেশ করতে পারেনি। অধিকিন্তু এরা বেকারত্ব ও হতাশার মধ্যে নিপতিত হয়ে নিজেদেরকে নিষ্ক্রিয় করার ফাঁদে আটকা পড়ে যাচ্ছে।

জনমিতির এই সুযোগ কোন দেশে চিরদিন স্থায়ী হয়ে থাকে না। বাংলাদেশে ২০১২ সাল থেকে এই সুবিধা চলমান থাকলেও আগামী ২০৩৭ সাল পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। সেই হিসেবে আমাদের দেশে আর মাত্র পনেরো বছর স্থায়ী হতে পারে এই সুবিধা।

কারণ এর পর থেকে আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকেবে। কমে যাবে কর্মক্ষম যুবশক্তির সংখ্যা। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মাফিক কাজ বা চাকরির সুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে না। নিয়োগ ক্ষেত্রে চরম দুর্নীতির বিকাশের কারণে আমরা ক্রমাগত মেধাবীদেরকে কাজের সুবিধা দিতে না পারায় এই জনমিতিক সুবিধা হারিয়ে ফেলছি।

ক’বছর আগেও মেধাবীরা বড় বড় চাকরিতে যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেত। এখন সেটা সংকুচিত হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকে গেছে। চাকরির বাজার যেন সোনার হরিণ। সরকারি চাকরিতে চূড়ান্ত নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করার পর নানা ছল-ছুতোয় ২০২০ সালে আড়াই হাজার প্রার্থীকে কাজে যোগদান করতে পারেনি। তাদেরকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নানাভাবে হয়রানি করে সময় ক্ষেপণ করে ফেলা হয়েছে। যথাযথ পেপার ডকুমেন্টস ও প্রমাণপত্রসহ বহু যোগাযোগ করা সত্ত্বেও তাদেরকে নিয়োগ দেয়া দেয়া হয়নি। অনেকের কাছে অনৈতিকভাবে ঘুষের অর্থ দাবি করা হয়েছে। এজন্য অনেকের চাকরি লাভের বিষয়টি আইন-আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে গিয়ে আরো জটিল হয়ে গেছে। দায়িত্বশীল আইন-শৃংখলা বাহিনীর আর্থিক লোভ ও দুর্নীতির বিষয়টি অনেকাংশে প্রধান সমস্যা হিসেবে উন্মোচিত হওয়ায দরিদ্র-মেধাবী প্রার্থীরা অনেকেই মহা ফাঁপড়ে পড়ে চাকরি প্রাপ্তির আশা ছেড়ে দিয়ে চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন। এই ওপেন সিক্রেট বিষয়টি আমলে না নেয়ায় শিক্ষিত বেকার যুবশক্তির কেউ কেউ নৈতিক শক্তি হারিয়ে ক্ষোভে, লজ্জায় আত্মহণনের পথ বেছে নিয়েছেন। হয়ে পড়েছেন মাদকাসক্ত। তাদের অনেকে জীবন বাঁচার তাগিদে সহজে কিছু আয়ের আশায় মাদক ব্যবসায় নিজেকে জড়িত করে ফেলেছেন। আবার অনেকে নেশা দিয়ে নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে জীবনের গতিপথ হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে গেছেন।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নানাভাবে হয়রানি শুধু চাকরিপ্রাপ্তি বা নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয় বরং প্রমোশন, মামলা, পাসপোর্ট তৈরি ইত্যাদির ক্ষেত্র আরো ব্যয়বহুল ও দুর্নীতির অপমানজনক ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে পড়েছে।

এটা অপমানজনক সত্যটি আমাদের চাকরির বাজারে একটি বিষফোঁড়া তা সিডিপি-র সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সিডিপি ১৭টি সেবাখাতের উপর গবেষণা চালিয়ে উদ্বঘাটন করেছে- দেশের সর্বচ্চো দুর্নীতির খাত হচ্ছে পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সর্বোচ্চ দুর্নীতির খাত পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী (৭৪.৪%), পাসপোর্ট (৭০.৫%), বিআরটিএ (৬৮.৩%)। আমাদের এসব সেবা খাতে সর্বোচ্চ দুর্নীতি হয়। এজন্য আমাদের দেশে গড়ে প্রতি পরিবার প্রতি ঘুষ প্রদান করে ৬,৬৯৮ টাকা। ঘুষ না দিলে এসব সেবা পাওয়া যায় না বলে মনে করে ৭১.২% মানুষ। এটা আমাদের সমাজের প্রচলিত সেবাখাতের জনসেবার পরিবর্তে জনগণকে নাজেহাল করার নমুনা।

শুধু নাজেহাল কেন? আসলে এই ধরণের ঘুষ-দুর্নীতি আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। মেধাবীদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার মেরুদণ্ডকেও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। দেশের সামগ্রীক জনসেবা ব্যবস্থা সঠিক মেধাবীদের সেবা বঞ্চিত হয়ে একটি মেধাহীন, দুর্নীতিবাজ চক্রের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে। তাইতো তারা ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের’ নৈতিক বাণীর কথা শুনলে মুচকি মুচকি হাসে।

এর ফলে দরিদ্র পরিবারের কোন তরুণ যেমন দেশে চাকরি পাচ্ছে না তেমনি কেউ ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গমন করতে চাইলেও পাসপোর্ট অফিসে হেনস্তার শিকার হচ্ছে। আবার সেখানকার দালাল ও দুর্নীতিবাজ চক্রের জালে পড়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে মোটা অঙ্কের ঘুষের আব্দার সহ্য করতে না পেরে জীবন সম্পর্কে ঘৃণা নিয়ে কালাতিপাত করতে করতে মাদকসেবী হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ আত্মহণনের পথ বেছে নিয়েছে।
অথচ এদিকে কারো সুনজর নেই। সবাই শুধু বক্তৃতা দিয়ে হম্বি-তম্বি করে ক্ষান্ত দিই। একটি বক্তৃতার আসরে বসে কথার ফুলঝুরিতে সবকিছুর উন্নয়নকে উদ্ধার করতে ছাড়ি না। অনেকে অতিকথন ও ফালতু কথার মাধ্যমে নিজেদের ওজন বিনষ্ট ও দেশের মর্যাদাকে জলাঞ্জলি দিতে সরব দেখা যায়।

দেশের কল্যাণ কামনা ও দুর্নীতি করা একসঙ্গে চলে না। দুর্নীতি করে নিজের রসনাতৃপ্ত করে দেশকে রসাতলে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য একদল মানুষ ব্যস্ত রয়েছে। দেশের আপামর জনগণের কল্যাণ কামনাকারী কোন মানুষের এত বেশি জমানো সম্পদ থাকতে পারে না। তা ছাড়া জনগণের উপর জুলুমকারী ও উৎপীড়ক না হলে জননেতাদের এত অবৈধ সম্পদ থাকে কি করে? দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি ও সম্পদের অবৈধ মেরুকরণ বেকারত্মকে আরও মারাত্মক সামাজিক সমস্যায় ঘণীভূত করে ফেলায় মেধার মূল্যায়ণ নিয়ে নিয়োগদাতাদের কোন বিকার নেই।

সেজন্য আমাদের শিক্ষিত, মেধাবী তরুণরা নিজেদের যোগ্যতামতো কোথাও ঠাঁই না পেয়ে ক্রমাগত পথে বসে যাচ্ছে। এ অবস্থা নিরসনের জন্য সুশাসন প্রয়োজন। দেশের প্রচলিত সেবাদান ব্যবস্থাকে কঠোর নৈতিক শৃঙ্খলার মধ্যে এনে একটি উন্নত ব্যবস্থাপনায় রূপান্তর করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এ মুহূর্তে নেশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কর্মশক্তির লভ্যাংশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের কত অংশ ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে নিপতিত হয়েছে সেটা নিরুপণ করাটা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। মাদকের সহজলভ্যতা ও ব্যবসা আমাদের দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের জন্য প্রধান অন্তরায় হিসেবে কেন বিবেচিত হচ্ছে তার কারণগুলো খতিয়ে দেখা এবং সেগুলো নিরসণে যুব উন্নয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশেষ আত্মকর্মসংস্থান ব্রিগেড গঠন করে আশু প্রশিক্ষণ, সুদবিহীন ঋণদান করে কাজের মধ্যে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল হবে।

বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের যে বিরল সম্ভানাময় সময় পার করছে তাকে গুরুত্ত্ব দিতে হবে। জনমিতিক লভ্যাংশ মাদক ব্যবসা ও মাদক সেবন করে নেশায় বুঁদ হয়ে উচ্ছন্নে যাবে তা কারো কাম্য নয়। কঠোরভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই ঘৃণিত বিকাশকে বিশেষ কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ এটা আমাদের আর্থ-পরি-সামাজিক, মনো:দৈহিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য চাক্রিকভাবে গুরুত্ব বহন করে। এই সুযোগ আমাদের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ স্বরূপ। সুতরাং এই বিরল সুযোগকে আর কোনভাবে হেলায় হারানোর অবকাশ নেই।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

যাত্রীবান্ধব এয়ারলাইন্স: ইউএস-বাংলা



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি; বার্তা২৪.কম

ছবি; বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থেকে একটি এয়ারলাইন্স যাত্রীদের চলার পথে যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠে। যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠতে অন-টাইম পারফর্মেন্স জরুরী হয়ে উঠে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরুর পর থেকে ৯০ শতাংশের উপর ফ্লাইট অন-টাইম বজায় রেখে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে।

এয়ারক্রাফটের পর্যাপ্ততা একটি এয়ারলাইন্স এর এগিয়ে চলার পথে বড় নিয়ামক। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দু’টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন বহরে যুক্ত করেছে ১৯টি এয়ারক্রাফট। যার মধ্যে ৮টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৮টি এটিআর ৭২-৬০০ ও ৩টি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট রয়েছে। চলতি বছরের মে-জুন মাসে ৪৩৯ আসনের দু’টি এয়ারবাস ৩৩০ ওয়াইড বডি এয়ারক্রাফট যোগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইউএস-বাংলা।

অন-টাইম পারফর্মেন্স বজায় রেখে অভ্যন্তরীণ সকল রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পর আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। ২০১৬ সালের ১৫ মে ঢাকা থেকে কাঠমুন্ডু রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যাত্রা শুরু করে। একের পর এক নতুন নতুন আন্তর্জাতিক গন্তব্য শুরু করতে থাকে ইউএস-বাংলা।

যাত্রীদের চাহিদাকে পূর্ণতা দিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ফ্লাইট সিডিউল ঘোষণা করছে। নূন্যতম ভাড়ায় ভ্রমণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। পর্যটকদের ভ্রমণকে আরো বেশী আকর্ষণীয় করতে নানা ধরনের ভ্রমণ প্যাকেজ ঘোষণা করছে। দেশে কিংবা বিদেশে টিকেট কিনলে হোটেল ফ্রি অফার রাখছে। ইএমআই সুবিধা দিয়ে প্যাকেজ ঘোষণা পর্যটকদের ভ্রমণ পরিকল্পনাকে সহজতর করে দিচ্ছে। কলকাতা কিংবা চেন্নাইয়ে চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ করলে এ্যাপোলো হাসপাতালে ডিসকাউন্ট অফার দিচ্ছে ইউএস-বাংলা। 

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য মালদ্বীপের রাজধানী মালের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে। যার ফলে ভারত মহাসাগরের নীলাভ সৌন্দর্য দর্শনে পর্যটকরা ঢাকা থেকে মালে ভ্রমণ করছে। বিভিন্ন ধরণের প্যাকেজ সুবিধা নিয়ে মালদ্বীপের আকর্ষণীয় দ্বীপগুলোতে ভ্রমণ করছে।

মধ্যপ্রাচ্যে পর্যটকদের আকর্ষণীয় গন্তব্য দুবাই ভ্রমণে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিদিন ঢাকা থেকে দু’টি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এবং শারজাহ-তেও প্রতিদিন একটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশী অধ্যুষিত মাস্কাট ও দোহাতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা।

সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক কিংবা গুয়াংজু রুটে বাংলাদেশী যাত্রীদের পছন্দক্রমে ইউএস-বাংলা অগ্রগণ্য। যাত্রী বিবেচনায় প্রবাসী শ্রমিকবান্ধব এয়ারলাইন্স হওয়ায় ইউএস-বাংলা যাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে।

অভ্যন্তরীণ রুটে ঢাকা থেকে সিলেটে ৬টি, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৮টি করে ফ্লাইট, যশোরে ৩টি, রাজশাহীতে ২টি, বরিশালে ১টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা। যা দেশের অভ্যন্তরে যাত্রীদেরকে সেবা দেয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

দেশের অভ্যন্তরে ব্র্যান্ডনিউ এটিআর ৭২-৬০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে সর্বপ্রথম ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দেশে সর্বপ্রথম সেলফ চেক-ইন করার ব্যবস্থা রেখেছে ইউএস-বাংলা। 

অনলাইন ও অফলাইন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকেট ক্রয়ের সুবিধা থাকার পরও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দেশে এবং দেশের বাহিরে ৪১টি নিজস্ব আউটলেটের মাধ্যমে সরাসরি টিকেট ক্রয়ের সুবিধা রেখেছে যাত্রীদের জন্য।

বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দশ বছর অতিক্রমকালীন সময়টা এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য অনেকটাই নাজুক অবস্থা বিরাজমান সেখানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বাংলাদেশকে ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত এয়ারলাইন্স এর বিমান বহরে নতুন নতুন এয়ারক্রাফট যুক্ত করে নতুন নতুন গন্তব্যে নিজেদের পেখম মেলে ধরছে। বর্তমানে ২৫০০ এর অধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে ইউএস-বাংলায়। যা দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে কাজ করছে।

দেশের ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি ও হোটেল ইন্ডাস্ট্রিকে গতিশীল রাখতে ইউএস-বাংলা যাত্রার শুরু থেকেই কাজ করছে। যাত্রীদের আস্থাই ইউএস-বাংলার এগিয়ে চলার পথে পাথেয়।   

লেখক: মোঃ কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;

ইসলামে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের গুরুত্ব



মাহমুদ আহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত।

আমাদের মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখ প্রাণের তাজা রক্ত। আল্লাহপাকের জমিনে তিনি পরাধীনতা পছন্দ করেন না। যেখানে স্বাধীন ভূখণ্ড নেই সেখানে ধর্ম নেই আর যেখানে ধর্ম নেই সেখানে কিছুই নেই। তাই ইসলামে দেশ প্রেম এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব অতি ব্যাপক। সৃষ্টির প্রতিটি জীব স্বাধীনতা পছন্দ করে। পৃথিবীতে এমন কোন জাতি বা জীব পাওয়া যাবে না যারা পরাধীন থাকতে চায়। তাই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবাই কতই না চেষ্টাপ্রচেষ্টা করে থাকে। আর এই স্বাধীনতার জন্যই মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে মক্কাকে করেছিলেন স্বাধীন।

ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত নবীর আগমণ হয়েছে তারা সবাই সমাজ, দেশ ও জাতির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। আর এই স্বাধীনতা অত্যাচারী শাসকের দাসত্ব থেকে জাতিকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেই হোক বা ধমীর্য় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হোক। এক কথায় বলা যায়, সব ধরণের দাসত্ব ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত করাই হচ্ছে আল্লাহতায়ালার প্রেরিত নবীদের কাজ।

আমরা জানি, গোলাম মুক্ত করে এবং সর্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য যিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন এবং শতভাগ সফল হয়েছেন তিনি হলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি হচ্ছেন স্বাধীনতার উজ্জল সূর্য। যাঁর কিরণ দূরদূরান্তে বিস্তার লাভ করেছে, যিনি নিজের মাঝে সব ধরণের স্বাধীনতাকে ধারণ করেছিলেন। যিনি মানুষকে শুধু বাহ্যিক দাসত্ব থেকেই স্বাধীনতা দেননি, বরং সমাজ ও দেশ থেকে সব ধরণের নৈরাজ্য দূর করে সবাইকে করেছিলেন স্বাধীন। বিশ্বের এক বিশাল জনগোষ্ঠী অবলোকন করেছে, কিভাবে বিশ্বনবী (সা.) সমাজ, দেশ তথা সর্বত্রে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পরাধীনতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য মহানবী (সা.) যেমন লড়েছেন তেমনি তিনি সকলকে করেছিলেনও স্বাধীন। কিন্তু এটি বড়ই পরিতাপের বিষয়, অনেক জাতি স্বাধীনতার প্রকৃত পতাকাবাহীদের অস্বীকার করে এবং সর্বোত্তম শাসকের (আল্লাহর) শাসনের ওপর জাগতিক শাসকের দাসত্বকে অগ্রাধিকার প্রদান করার ফলে তারা কেবল নিজেরাই প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয় নি বরং বহু জাতি আল্লাহর আজাবগ্রস্থ হয়ে ধ্বংসও হয়েগেছে। একান্তই সত্য যে, বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ার কারণে স্বাধীনতা কেবল তাদের হাতছাড়া হয়নি বরং সে জাতির ইহ ও পরকাল উভয়ই ধ্বংস হয়ে গেছে।

প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহপাক মানুষকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আল্লাহতায়ালা সবাইকে বিবেক ও বিশ্বাসেরও স্বাধীনতা দিয়েছেন। কাউকে পরাধীন করেননি। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘তোমার প্রভুপ্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই অবশ্যই এক সাথে ঈমান নিয়ে আসত। তবে কি তুমি মোমেন হওয়ার জন্য মানুষের ওপর বল প্রয়োগ করবে?’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৯৯)।

এই আয়াত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে যে, আল্লাহ সবার স্বাধীনতা চান। তিনি চাইলে সবাইকে একসাথে মোমেন বানাতে পারেন কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি চেয়েছেন মানুষ যেন স্বাধীনভাবে বুঝেশুনে ঈমান আনে। ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম বা বিশেষ কোনো ধর্মগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দমননীতি অনুমোদন করে না। মাদানী যুগেও আমরা আল কোরআনের এই বিস্ময়কর প্রকাশ দেখতে পাই, ‘ধর্মের ক্ষেত্রে জবরদস্তি নেই’ (সুরা আল বাকারা: ২৫৬)। এই আয়াত থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট যে, ইসলাম স্বাধীনতাকে কতটা পবিত্র করেছে এবং একে কতটা মর্যাদা দিয়েছে।

স্বাধীনতাকে ইসলাম যেমন গুরুত্ব দিয়েছে তেমনি দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকেও অতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং একে ঈমানের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহানবী (সা.)এর হৃদয়ে স্বদেশ প্রেম যেমন ছিল তেমনি তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের মাঝেও বিদ্যমান ছিল। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায়।

প্রিয় নবী (সা.) মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বাধীনতার চেতনাকে জাগ্রত করে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয়, সম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি যেমন অসংখ্য দাসকে নিজ খরচে মুক্ত করেছেন তেমনি সমগ্র বিশ্বকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ।

মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার (২৬ মার্চ) ‘মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পরিদর্শন বইয়ে প্রত্যয়দীপ্ত এ মন্তব্য করে সই করেন তিনি। আমরাও ইনশাআল্লাহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা পুরণে যার যার স্থান থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিব। 

আসুন, নিজ দেশের প্রতি, দেশের সম্পদের প্রতি, সকল ধর্মের অনুসারীদের প্রতি আমাদের হৃদয়ে অনেক বেশি ভালোবাসা সৃষ্টি করি আর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলার আন্দলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করি। 

লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলাম লেখক

;

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে মিল ছিল না। তাই দেশভাগের পর একই ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে।

কিন্তু যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ঘোষিত আন্দোলনে সাহসী বাঙালির নিরন্তর প্রতিরোধ ও প্রতিকার প্রতিফলিত হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীপূর্ব বাংলার নিরীহ প্রতিবাদকারীদের প্রাণের বিনিময়ে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করা হয়।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় হয়েছিল প্রধানত ভাষা আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভের পর, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা এবং ১৯৬৯ এর ১১ দফা দাবি ও গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে সমগ্র বাঙালি জাতি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নিপীড়ন এবং অবজ্ঞায় তাদেরকে একতাবদ্ধ হতে সহায়তা করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয়ে এর প্রতিফলন ঘটে। অবশেষে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অভ্যুদয় ঘটে।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা। শুরু হয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ বিভক্ত হয় এবং উদারপন্থী নেতাদের নিয়ে 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' নামে একটি নতুন দল গঠিত হয়।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পর্ক প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভাষার জন্য রক্তদানের মধ্য দিয়ে দেশের জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের প্রস্তুতি শুরু হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন ধারা শুরু হয়।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয়ের সাথে সরকার গঠন করে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে পতনের ষড়যন্ত্র করে। এভাবেই শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই। এই সংগ্রামের শুরুতে তরুণ শেখ মুজিব এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের অনেক ঘটনার মধ্যে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন তাৎপর্যপূর্ণ। পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন একজন তরুণ নেতা এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যুক্তফ্রন্টের অন্যান্য নেতাদের সাথে তিনি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণ করেন। শেখ মুজিব বাংলার জনগণকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন। তার বাগ্মীতা, নেতৃত্ব, জনসম্পৃক্ততা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা নির্বাচনের ফলাফলকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ৩০৯ টি আসনের মধ্যে ২২৮ টি আসনে জয়লাভ করে। শুধু নির্বাচনী বিজয়ই নয়, তরুণ শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিরাজ করতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকশ্রেণীর শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে তাকে প্রায় ১২ বছর বন্দী থাকতে হয়েছিল।

এদেশের মানুষকে শোষণ, নিপীড়ণ ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার অবস্থান বুঝতে পারে এবং তার অধিকারের বিষয়ে আরও সোচ্চার হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের যাবতীয় রসদ ছিল। ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি থানা, মহকুমা (এখন জেলা), বৃহত্তর জেলা এবং বিভাগ পরিদর্শন করেন। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবী সকলকে তিনি ছয় দফার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেন।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ছয় দফার জন্য ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন। এই ছয় দফা পরবর্তীতে স্বাধীনতার এক দফায় রূপান্তরিত হয়। ছয় দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তার বিচার শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমিকসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। গড়ে ওঠে গণআন্দোলন।

১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন 'সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে। ১৯৬৯ সালের ১৮ জানুয়ারি পরিষদ কর্তৃক ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা একসঙ্গে এই আন্দোলনে অংশ নেয়।

আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে গুলি করে হত্যা করা হলে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ঘোষণা দিতে বাধ্য হন যে তিনি পরবর্তী নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অংশগ্রহণ করবেন না। প্রবল প্রতিরোধের সামনে সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সবকটি আসনে (জাতীয় ও প্রাদেশিক) বিপুল বিজয় অর্জন করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসনে জয়লাভ করে। এবং জাতীয় পরিষদে (পূর্ব পাকিস্তান) ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টিতে বিজয় লাভ করে। এই বিজয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে তার প্রতিফলন ঘটে। শেখ মুজিব হঠাৎ করে 'বঙ্গবন্ধু' হয়ে যাননি। তিনি প্রতিটি প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং আস্থা অর্জন করেছেন।

১৯৭০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি বিপর্যয়কর ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। এই ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় ৫০০,০০০ মানুষ মারা যায়। পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ জনগণকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছে। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন গণমানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কয়েকবার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। বাঙালিরাও ধীরে ধীরে ক্রোধে ফুঁসে উঠতে থাকে।

এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সাবেক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। ভাষণে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। একই সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কার্যকর প্রেরণা ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। এর গুরুত্ব ও প্রভাব বিবেচনা করে ৪৬ বছর পর ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ডকুমেন্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

৭ই মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়ে ওঠে। আলোচনার নামে শাসকগোষ্ঠী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের আগে ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

শুরু হয় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১০ এপ্রিল 'মুজিবনগর সরকার' গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বন্দী থাকা অবস্থায় এই সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয় তার নামে।

দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে তিনি ধাপে ধাপে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্য বাঙালিকে প্রস্তুত করেন। এবার তারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় শেখ মুজিব ছিলেন একজন তরুণ ছাত্রনেতা। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব, ছয় দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি জাতীয় নেতা হয়ে ওঠেন। আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়। শেখ মুজিব বাঙালির ‘বঙ্গবন্ধু’ হন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় বঙ্গবন্ধুকে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা করে তোলে। ৭ই মার্চের ভাষণ, ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পাকিস্তানের কারাগারে থেকেও বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অটল ভালোবাসা ও অঙ্গীকার তাঁকে জাতির পিতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবন উৎসর্গ ছিল বাংলা ও বাঙালি, বাংলার মাটি ও মানুষের জন্য। আর এ কারণেই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হয়।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

;

পাঠক-ঘোষকের পার্থক্য নির্ধারিত স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কর্মসূচিভিত্তিক যোগ নেই। থাকার কথাও নয়। বাংলাদেশ-জন্মের সঙ্গে বিএনপির নাম নিয়ে কোন নেতারও রাজনৈতিক সংযোগ নেই; থাকার কথাও নয়। পরে দলটিতে যোগ দেওয়া কেউ কেউ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বিএনপির নামে কেউ ছিল না স্বাভাবিকভাবেই।

বিএনপির রাজনৈতিক সৌভাগ্য যে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সুযোগ এসেছিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার পাঠের। মেজর জিয়া যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন তাও নয়, এর আগে আবদুল হান্নানসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। এবং জিয়াউর রহমানের সে পাঠ ছিল মার্চের ২৭ তারিখে, এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। অর্থাৎ এরআগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেছে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত স্বাধীনতা দিবসও তাই ২৬ মার্চ।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা স্বভাবই ইতিহাস স্বীকৃত, এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়া ও ইতিহাসবেত্তা কর্তৃক বর্ণিত। তবু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের নাম নিয়ে আসা হয়। তাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করা হয়। বিএনপি জোর গলায় সে দাবি করে। বাংলাদেশ-জন্মের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তুলনাও এ নিয়ে করেন অনেকেই। অথচ তারা ভালো করেই জানেন, বাংলাদেশ কেবল নয় মাসের এক সশস্ত্র যুদ্ধের পরিণতি নয়, এর পেছনে আছে দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা।

বাংলাদেশকে কেবল নয়মাসের এক যুদ্ধের ফল হিসেবে ভাবলে খণ্ডিত ইতিহাস অথবা ইতিহাসের বিকৃতি হয়। অস্বীকার করা হয় বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর, একাত্তরের অসহযোগ থেকে সকল কিছুই। অথচ এগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ের প্রাথমিক সোপান। কেবল হুট করে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেল আর বাংলাদেশ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল—এ ধারণা যৌক্তিক নয়! তবু সমানে চলে এ চর্চা, আর সুশীল সমাজও প্রশ্রয় দিয়ে চলে সেটা, অথবা বলা যায় তাদের মুখ থেকেই আসে সেসব।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইতিহাস স্বীকৃত। ভয়াল কালরাত্রির পর একাত্তরের ২৬ মার্চে গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তের দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্তৃকও প্রচারিত। তবু দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয় আসলেই অনেকেই নিয়ে আসেন জিয়াউর রহমান কর্তৃক কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা পাঠের বিষয়টি। অথচ ঘোষণা আর পাঠ—এ দুইয়ের মধ্যকার যে বিশাল পার্থক্য সেটা ক’জনই বা অনুধাবন করেন। ধারণা করা যায়, রাজনৈতিক রঙ লাগানো এবং রঙ থেকে দূরে থাকার কারণে এসব করে থাকেন তারা। অথচ এটা দেশের প্রকৃত ইতিহাসকে বিতর্কিত করার প্রবণতা।

জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ এবং স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওর মাধ্যমে জানানোর বিষয়টির আগেও আরও অনেক আওয়ামী লীগ নেতা করেছেন, কিন্তু ক’জনই বা আলোচনায় আসেন। বলা যায়, তাদের কেউই আলোচনায় আসেন না। যে আবদুল হান্নান ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পাঠ জিয়াউর রহমানের আগে করেছিলেন, তিনি কেন আলোচনায় আসেন না? তার আলোচনায় না আসার কারণ কি তার নেতৃত্বে পৃথক কোন রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার আগে-পরে গঠন হওয়া? ২৬ মার্চ একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টি মাইকে করে যারা জানাচ্ছিল তারাও কি তবে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে? আবদুল হান্নানসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা, মাইকে ঘোষণা প্রচারকারীগণ যদি ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে আলোচনায় না আসেন তাহলে কেন জিয়া এককভাবে আসবেন? এটা সাদামাটা এবং সাধারণ বোধের বিষয়।

জিয়া জীবদ্দশায় কখনই নিজেকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করেননি। তার মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের দলের নেতাকে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়াতে বিএনপি নেতারাই তাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে দাবি করেন। ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ জিয়া এই বিষয়টি পরে বিএনপির রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের উপকরণ এবং আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একতরফা প্রচারণার বিপরীতে ব্যাপক প্রচার ও জনপ্রিয়তা পায়। আওয়ামী লীগ বিরোধী এক প্রবল মত সমাজে প্রচার থাকার কারণে জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল মুক্তিযুদ্ধের এক নেতা হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ে। এই সুযোগটা লুফেও নেয় বিএনপি ও সে আদর্শের বুদ্ধিজীবীরা।

পঁচাত্তরের পনের আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটা ধারার জন্ম নেয়। মুক্তিযুদ্ধের যতখানি প্রচার ছিল সেখানে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করতে অথবা অবমূল্যায়ন কিংবা তার অবদানকে খাটো করতে একের পর এক প্রচারণা চলতে থাকে। আর এসব প্রচারণার ভিড়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে প্রচারের আলোয় চলে আসেন জিয়া। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল সরকার ও বিরোধীদলের ভূমিকায় নানা সময়ে থাকার কারণে অনেকেই আবার নিজেদেরকে ‘নিরপেক্ষ’ প্রমাণের অভিপ্রায়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে জিয়াকেও উচ্চারণ করতে থাকেন। আর বর্তমানে সেই প্রচারণার ফল পাচ্ছে বিএনপি। এখন কেউ জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে অস্বীকার করলে একশ্রেণির লোক অস্বীকারকারীকেই সন্দেহ করে, আওয়ামী লীগের আদর্শের অনুসারী বলে মনে করে।

জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে এই যে প্রচারণা সে প্রচারকারীদের কেউই দাবি করতে পারে না ২৬ মার্চে জিয়া কোন ঘোষণা দিয়েছেন কিনা। একাত্তরের ২৬ মার্চে জিয়া কোথায় ছিলেন সেটাও জানে না কেউ। এই না জানাদের সকলেই জানে উত্তাল মার্চের সকল ঘটনা, পতাকা উত্তোলন, সোহরাওয়ার্দীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনাসহ সকল কিছু। তারা জানে ২৬ মার্চে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু, তার আগে দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা।

দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের পর একাত্তরের মার্চের ২৭ তারিখ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধিকার ও মুক্তির সংগ্রামের কোন পর্যায়েই ছিলেন না। ছিলেন কেবল একবারই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ার সময়ে। এরপর মুক্তিযুদ্ধকালীন এগার সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে একজন ছিলেন জিয়াউর রহমান। তবু জিয়ার নাম বারবার নিয়ে আসা হয়। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান অসম সাহসী কোন ভূমিকা রেখেছেন, এমন নজির কিংবা প্রমাণ নাই। তবু তিনি আলোচনায়। কারণ একটাই জিয়াউর রহমানের নামের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের যোগ আছে, যা অন্য সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে ততটা নাই। ততটা আলোচনায় নাই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানী। এটা যে স্রেফ রাজনৈতিক চক্র সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

বিএনপি জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করে, অনেকেই আবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত না করার অজুহাতে সেটা মেনে নেওয়ার নসিহতও দেন। কিন্তু তাদের কি এটা মনে হয় না বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস যদি হয় ২৬ মার্চ তাহলে ২৭ মার্চ ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ কীভাবে হয়? দিবস পালন তো সেদিনই হয় যেদিন ঘটনা ঘটে। ছোট্ট সাদামাটা এক উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আমরা কি ১৫ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করতে পারব? এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। ধরেন, আপনার জন্মতারিখ ৩০ ডিসেম্বর, আপনি কি ২৯ ডিসেম্বরকে আপনার জন্মদিন হিসেবে পালন করতে পারবেন? সেটা কী হাস্যকর হয় না! আপনি যদি জিয়াউর রহমান কর্তৃক কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পড়াকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মূল ভাবেন তাহলেতো আপনারা সেই দলের পর্যায়ে পড়েন যারা নিজের জন্মদিনের আগের দিনকেই প্রকৃত জন্মদিন ভাবেন!

একাত্তরের ২৫, ২৬ ও ২৭ মার্চকে আলাদাভাবে যদি চিহ্নিত করেন তবে দেখুন পঁচিশ তারিখের রাত সাড়ে ১১টার দিকে অপারেশন সার্চ লাইট নাম নিয়ে পাকিস্তানিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ২৬ তারিখের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ সোয়া বারটার পর বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তারের আগে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ওই দিনই আবদুল হান্নান সহ আরও কয়েকজন সে ঘোষণা ফের পাঠ করেন; ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান বেতারকেন্দ্র থেকে একইভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বলতে পারেন, জিয়া ঘোষণা করেছেনতো। হ্যাঁ, সেটা করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এবং সেসময় তার মত পদস্থ এক সামরিক কর্মকর্তার মুখ থেকে সেসব প্রচারের দরকারও ছিল। কৃতিত্ব যে তার ছিল না সেটা কেউ বলছে না, বলছে কেবল এই ঘোষণা পাঠের একক কৃতিত্ব না নেওয়ার বিষয়ে।

২৭ মার্চের বেতার ঘোষণা পাঠের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করলেও দেশবাসীর মত বিএনপিও ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। এবারও করেছে। জিয়াউর রহমান একাত্তরের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার পুনর্পাঠ করেছিলেন, এটা অসত্য নয়। অসত্য হলো তার ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে যে দাবি করা হয় সেটা। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিএনপির কৃতিত্ব দখলের যে দাবি সেটা নড়বড়ে হয়ে যায় তাদের নিজেদের কর্তৃক ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস পালনের আয়োজনেই।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন ইতিহাস বিকৃতিই। জিয়াউর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ নন, তিনি অন্য অনেকের মত একজন পাঠক—এটাই প্রকৃত ইতিহাস। আর প্রকৃত ইতিহাস পাঠে কারও সম্মান কমে না, বরং বাড়ে। বিএনপিও সেটা একদিন বুঝতে পারবে, সে বিশ্বাস রাখতে চাই।

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

;