যুদ্ধ-মহামারির সঙ্কুল পরিস্থিতি ও দারিদ্র্যের বিপদ

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

যুদ্ধ-মহামারির সঙ্কুল পরিস্থিতি ও দারিদ্র্যের বিপদ

যুদ্ধ-মহামারির সঙ্কুল পরিস্থিতি ও দারিদ্র্যের বিপদ

হাজারো ঘটনাময় বৈশ্বিক পরিক্রমায় সর্বশেষ উদ্বেগজনক খবর হলো এই যে, এক ধাক্কায় ১৬ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে কোভিড মহামারি আর যুদ্ধে মানুষগুলো দরিদ্র হয়েছে। এমনই আশঙ্কাজনক তথ্য নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের তরফে এই তথ্য পাওয়া গেছে ইউএনডিপি-র রিপোর্টের ভিত্তিতে।

এতে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্তত ৭.৫ কোটি মানুষ এখন দিনে গড়ে মাত্র ২.১৫ ডলারে (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৩০ টাকা) দিন গুজরান করেন, যা বাস্তব জীবনধারণ খরচের বিবেচনায় অসম্ভব, অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়।

বিজ্ঞাপন

মানুষের আর্থিক জীবনে এহেন চরম বিপর্যয়ের কারণ মহামারি ও যুদ্ধ। অতীতেও যুদ্ধ, মহাযুদ্ধের সময় ভয়ঙ্কর আর্থিক বিপদ নেমে এসেছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় লক্ষ কোটি মানুষ আশ্রয়হীন ও হতদরিদ্র হয়ে পড়েছিল। ইতিহাসের পাতায়, কালজয়ী উপন্যাসে, মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে মানবিক বিপর্যয়ের সেইসব করুণ আখ্যান।

মহামারিতেও বিশ্বের মানুষ ত্রস্ত ও বিপন্ন হয়েছে। প্লেগ বা ম্যালেরিয়ায় নির্বংশ হয়েছে মানবজাতির বহু সদস্য। যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে মঙ্গা ও হাহাকার। এই বাংলাতেই ছিয়াত্তরে মন্বন্তর এক কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান বিশ্বকে একই সঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে দুইটি ভয়াবহ বিপদ: যুদ্ধ এবং মহামারি। এমনিতেই কোভিডের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারিতে মানুষের লবেজান অবস্থা। সর্বত্র যখন ত্রাহিত্রাহি ধ্বনি, তখন শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। এই দুইয়ের যৌথ প্রভাব ২০২০ সাল থেকে গোটা বিশ্বের অন্তত ১৬.৫ কোটি মানুষকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ কথা জানিয়েছে খোদ জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের সংস্থা ‘ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ (ইউএনডিপি)-এর ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, অবিলম্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঘাড় থেকে বিপুল পরিমাণের ঋণের বোঝা না কমালে আরও বেশি করে মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করতে বাধ্য হবেন। এই ১৬.৫ কোটি মানুষ হয় মহামারিতে কোনও না কোনও ভাবে চাকরি বা কাজ হারিয়েছেন। অথবা রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে এঁদের উপরে।

ইউএনডিপি-র ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্তত ৭.৫ কোটি মানুষ এখন দিনে গড়ে মাত্র ২.১৫ ডলারে দিন গুজরান করতে বাধ্য। এঁদের ‘অতি দরিদ্রের’ তালিকায় ফেলেছে জাতিসংঘ। এ ছাড়া, আরও অন্তত ৯ কোটি মানুষ এখন দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন। যারা সংসার চালাতে দিনে গড়ে ৩.৬৫ ডলার খরচ করতে পারেন।

ওই রিপোর্টেই জানানো হয়েছে, বিশ্বের অন্তত ৩০০.৩ কোটি মানুষ এখন এমন সব দেশে বসবাস করছেন, যেখানকার সরকার নাগরিকদের স্বাস্থ্য বা শিক্ষা খাতের তুলনায় ঋণ পরিশোধে বেশি অর্থ খরচ করে থাকে। অবিলম্বে তাই ওই সব দেশের ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে আর্জি জানিয়েছে জাতিসংঘ। রিপোর্টে আশঙ্কা করা হয়েছে যে, ২০২৩ সালেও এই পরিস্থিতি শোধরানো যাবে না। এমনকি, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গৃহীত না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

চলতি সপ্তাহেই জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস আন্তর্জাতিক আর্থনৈতিক সংগঠনগুলোর পরিকাঠামো ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার দাবি ছিল, এই সব সংগঠন এখনও ঔপনিবেশিক পরিকাঠামো দ্বারা পরিচালিত। এগুলোতে বদল না আনলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের জীবনে বদল আনাও সম্ভব হবে না।

বৈশ্বিক দুরবস্থার এই চিত্র যে শুধুমাত্র খাতাকলমে ও পরিসংখ্যানের পাতায় নেই, বাস্তবেও দৃশ্যমান, তা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়। কারণ, এসব দেশে বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের সঙ্কোচন, মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠছে। দৈনন্দিন ব্যয় মিটাতে নাভিশ্বাস উঠছে মানুষের।

এমতাবস্থায় বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। মধ্যবিত্ত চলে যাচ্ছে দারিদ্র্যরেখার নিচে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। সামাজিক অসাম্য ও আর্থিক বৈষম্য খুবলে খাচ্ছে মানুষকে।

দুঃখজনক বিষয় হলো, মুদ্রার অন্য পিঠে চলছে সম্পদের বাড়বাড়ন্ত। কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কালো টাকার দৌরাত্ম্যে আর্থিক সঞ্চালন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। যার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না অসহায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী।

একদিকে দারিদ্র্যের বৃদ্ধি আর অন্যদিকে সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাব নড়বড়ে করছে সামাজিক কাঠামো। আর রাজনৈতিক কাঠামো ক্রমশ সহিংস ও উত্তেজিত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় সবচেয়ে বিপদে আপতিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। মানুষ হারাচ্ছে পায়ের নিচের মাটি। তলিয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের অতল গহ্বরে। বিশ্বের এই বিপদজনক পরিস্থিতির কুপ্রভাব পড়ছে নানা দেশে। যুদ্ধ ও মহামারি সৃষ্ট এই সঙ্কুল পরিস্থিতি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে এবং কার্যকরী আর্থিক নীতি ও কৌশল প্রণয়নের দ্বারা সামাল দিতে না পারলে বিশ্ববাসীকে দারিদ্র্যের আগুয়ান বিপদ থেকে রক্ষা করা দুরূহ হয়ে পড়বে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ (সিসিআরএস)।