বন্ধ হোক কালো হাতের হাতছানি
বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চারিধারে লু হাওয়া বইছে। প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়েই চলছে রাজনীতির মাঠের উত্তাপ। কোনদিকে উত্তাপ বেশি, আর কোনদিকে কম, তা নির্ণয়ে কোন পরিমাপক যন্ত্র নেই বলে নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, তবে তা যে অনুভূত হচ্ছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে একদিকে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এবং শক্তি জোরদারে ব্যস্ত। তবে গোল বেঁধেছে দেশে প্রধান বিরোধীদলের বিএনপি’র এক দফা দাবিকে কেন্দ্র করে।
বিএনপি’র একদফা দাবি সরকারের পদত্যাগ, বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। বিএনপি’র এই একদফা দাবি যেমন সাম্প্রতিক, অন্যদিকে পশ্চিমা দুনিয়ার বৃহৎ শক্তিধরদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ইঙ্গিতবাহী প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে সেতুবন্ধনের প্রভাবে তা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে একই সময়ে।
বিদেশিদের ক্রমাগত দৌড়ঝাঁপ সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রাখি)। আজ যে বিষয়টি নিয়ে আমার এ লেখা তাহলো দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, নির্বাচন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর তা সকলের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির অতীত ও বর্তমান ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
এ ক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলগুলোর যে বিভাজন তা বাংলাদেশে গত ’৫২ বছর ধরে বিরাজমান, বলা চলে গোটা দেশই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভক্ত যা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও শংকার জন্ম দিয়ে চলেছে।
সবচাইতে কঠিন ও দুঃখজনক সত্য হচ্ছে দেশের প্রধান বিরোধীদল হিসেবে পরিচিত বিএনপিই দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান এবং ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদানের ইতিহাসকেই আমলে নেয় না, বিশ্বাস করে না। উল্টো ইতিহাস বিকৃতির এক অপসংস্কৃতিকে সুকৌশলে জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। একথা বলা চলে সরাসরি।
তারই ধারাবাহিকতায়, বিএনপি, স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্যে দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তা, ইতিহাস, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য বাঙালি ২৩ বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াই, সংগ্রাম ও মুক্তির সনদকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলে নতুন এক অসত্য ইতিহাস রচনার লক্ষ্যে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য দায়ী আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করেন।
এই জিয়াউর রহমানই পাক বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন। ৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, গণহত্যার নির্দেশক ও জামায়াতের প্রধান গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে সসম্মানে বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনেন।
যে দলের প্রতিষ্ঠাতা ক্ষমতায় আসেন ক্যু’র মাধ্যমে, যিনি সেনা ছাউনি থেকে দল গঠন করেন, যিনি হ্যাঁ এবং না সূচক ভোট করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যিনি রাজাকারদের পুনর্বাসন করেন, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি বিল পাশ করান- সেই দলের নেতাদের মুখেই গণতন্ত্রের জন্য মায়া কান্না। হায় সেলুকাস এ পৃথিবী।
পরবর্তীতে বিএনপির হাল ধরেন খালেদা জিয়া, তিনিও স্বামীর অনুসৃত পথে হাঁটেন। তবে আরও এক ধাপ এগিয়ে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভোট চুরি, ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে বোমা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে বোমা মেরে হত্যা চেষ্টার ঘৃণ্য নজির সৃষ্টি, ২০০৭ সালে ভূয়া ভোটার তালিকা তৈরি ও বিচারপতিদের বয়সে হেরফের ঘটিয়ে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার নির্বাচন করার প্রস্তুতি, খুনিকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার তালিকা প্রণয়নকারীদের দুই শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধী আল মুজাহিদী ও মতিউর রহমান নিজামীকে মন্ত্রীসভার সদস্য করা, বাংলাদেশের পবিত্র জাতীয় পতাকা তাদের গাড়িতে তুলে দেয়ার মত বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছেন খালেদা জিয়া দেশ ও জাতির সঙ্গে। তিনি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।
অথচ তার দলের নেতারাই আজ গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু করেছে। এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে? আর সেই সঙ্গে নেতারা বিশ্ব দরবারে ঘুরপাক খাচ্ছেন ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার নেশায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়া তাদের ওই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের এই সুযোগে বিএনপিকে নিয়ে শুরু করেছে ষড়যন্ত্রের বিশাল কর্মযজ্ঞ।
ইদানিং অনেক বিশিষ্টজনের লেখা পড়ছি পত্রপত্রিকায় যার শিরোনামগুলোই সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। শিরোনাম পড়লেই মনে হয় বাংলাদেশ রসাতলে যাচ্ছে বা চলে গেছে, সর্বকালের অনিরাপদ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশ কার?, কার হাতে আছে এবং কার হাতে যাওয়া দরকার, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
অন্যদিকে কিছু কিছু পত্রিকা আছে তা পড়লে যে কোন মানুষের মনে হতে বাধ্য, যে এই সরকারের আমলে একটিও ভালো কাজ হয়নি। হওয়া সম্ভবই না।
ভালো তো দূরের কথা, কোন একটি কাজ বা ঘটনা শুরু হতে না হতেই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে নেতিবাচক গবেষণার কাজ তারা সম্পন্ন করে ফেলেন অতি দ্রুত গতিতে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ২০২০ সালে যখন বিশ্ব জুড়ে ভয়াবহ করোনা আঘাত হানে তখন তাদের গবেষণার ফলাফল এমন দাঁড়িয়েছিল যে বাংলাদেশের পথে ঘাটে শুধু লাশ আর লাশ পড়ে থাকবে। এই সরকারের মন্দ যত কিছু আছে তুলে এনে জনসম্মুখে প্রকাশ করা এবং সুকৌশলে শিরোনাম ও সংবাদটি পরিবেশন করাই যেন তাদের সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য। অবশ্য এই বিষয়ে তারা অধিক বুদ্ধিদীপ্ত ও গুণীজন। নির্বাচন এলেই তাই তাদের দৌড়ঝাঁপও বেড়ে যায় অতিমাত্রায়।
এসব দেখে শুনে সহজেই যে প্রশ্ন মনে উদয় হয় তাহলো যে বা যারা মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ও ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদানে বিশ্বাসী নয় তারা কীভাবে বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারে? আর রাজনীতি করার অধিকার লাভ করতে পারে। যে কোন দেশের নাগরিকত্ব লাভ করতে হলে সে দেশের সংবিধানের প্রতি সম্মান রেখেই শপথ গ্রহণ করতে হয়। এটাই তো বিধান।
গত কিছুদিন থেকে চোখে পড়ার মত আরো একটি বিষয় হচ্ছে, এই সেদিন পর্যন্ত বিএনপির সভা, সমাবেশ, মিটিং মিছিলে জনসমাগমের বিষয়টি ছিল হাসি ঠাট্টার পর্যায়ে। এখন তার ব্যতিক্রম বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই জনমানুষ কারা? কী তাদের পরিচয়? তারা কি বিএনপির সমর্থক, কর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী? নাকি জামায়াত শিবিরের ক্যাডার?
সব শেষে বলতে চাই, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ সকল অন্যায় অবিচার বন্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই সময়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে সরকারকে এসব বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করতে।
এই সরকার উৎখাত করে আলবদর রাজাকারদের ক্ষমতার মসনদে বসাবার জন্য নয় (আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের বর্তমান রূপ দেখার জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার কোন মাথা ব্যথা নেই) বরং সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ ও কল্যানমুখী রাষ্ট্র গঠনে চাপ সৃষ্টি করা, প্রয়োজনে বাধ্য করা। এটাই হোক আজকের শপথ।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক