সিসিআরএসবিডি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সম্ভাবনা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সিসিআরএসবিডি'র সূচনা

বুধবার (৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের খুলশীস্থ বিজিএমইএর মাহবুব আলী মিলনায়তনে চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি) নামক থিঙ্কট্যাঙ্কের উদ্বোধন হয়। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে এবং চট্টগ্রামে বসবাসরত বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত করে এই সংস্থা কাজ করবে। উদ্যোগটি চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে প্রথম, যাতে চট্টগ্রামের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা নিবিড় গবেষণার সুযোগ পাবেন এবং চট্টগ্রামের ভূকৌশলগত গুরুত্ব ও সম্ভাবনাকে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরীক্ষা করার চেষ্টা করবেন।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব

দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মিলনস্থল চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সুদূর অতীত থেকে বিরাজমান থাকলেও সাম্প্রতিককালে তা ব্যাপকতর হয়েছে। বঙ্গোপসাগর হয়ে ইন্দোপ্যাসিফিক, উত্তরপূর্ব ভারত ছুঁয়ে নিম্ন হিমালয় আর মিয়ানমারের সীমান্ত স্পর্শ করে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে চট্টগ্রাম নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের পূর্বমুখী কূটনীতি এবং ব্লু ইকোনমির নার্ভ সেন্টারও চট্টগ্রাম। পরিবর্তমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের গুরুত্ব এবং এর সমস্যা ও সম্ভাবনা সমীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করা জরুরি আর এসব গবেষণা চট্টগ্রাম থেকেই পরিচালিত হয়ে নীতিপ্রণেতা ও সংশ্লিষ্টদের সবচেয়ে বেশি ও কার্যকরভাবে সাহায্য করতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই শান্তি

চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক ইস্যুসমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই শান্তি, সম্প্রীতি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের রূপরেখা প্রণয়ন অতীব জরুরি। সংঘাত শেষে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে নানামুখী সুপ্ত সমস্যা বিরাজমান। এ কারণে উদ্বোধনের সময়ই সিসিআরবিডি পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সংকটের গতি, প্রকৃতি ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক আঞ্চলিক সেমিনারেও আয়োজন করে। কারণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সেখানে বসবাসরত বাঙালিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের অভাব ও আন্তঃসম্পর্ক ও যোগাযোগের স্বল্পতা। এসব সমস্যা কাটিয়ে জাতিগত সম্প্রীতি স্থাপন করার কাজটি সিসিআরবিডি অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার বলে মনে করে। বিশেষত, সেখানকার বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আইডেনটিটি ক্রাইসিস ও দূরত্ব দূরীকরণে বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজনের মাধ্যমেই তাদের মধ্যকার এই দূরত্ব কমানো সম্ভব। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর স্বতন্ত্র এবং নিজ নিজ সংস্কৃতিগুলোকেও এক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু এই অঞ্চলে বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সমান, তাই দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনার মাধ্যমে এই অঞ্চলের সমস্যা নিরসন করা এবং শান্তি, সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের পথসন্ধান করা জরুরি।

সংঘাতহীন শান্তির জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি হওয়ার পর ওই অঞ্চলে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা হয়। কিন্তু এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত। এ নিয়ে পার্বত্য জেলাগুলোর মধ্যে বান্দরবান বেশি অস্থির। আর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কুকি-চিনের নাম বেশ শোনা যায়। মূলত ভূ-রাজনৈতিক কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় কিছু গোষ্ঠী এখানকার সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা দিয়ে এ অঞ্চলকে বাফার স্টেটে পরিণত করতে চাচ্ছে। এ কারণে সেখানে সন্ত্রাসবাদী পন্থায় কাজ করা হচ্ছে কিছু গোষ্ঠীর দ্বারা। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি রাজনৈতিক বিষয়। সশস্ত্র পদ্ধতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কখনোই সম্ভব নয়। এজন্য কার্যকর পলিটিক্যাল অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করা দরকার। সরকার ও বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ, সামাজিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজকে এক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বাড়বাড়ন্ত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও জননিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে, যা মোটেও কাম্য নয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা

পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গতি আরও বাড়বে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হবে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের আজকে অনেক বছর পার হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের ইকোনমিতে অবদান রাখার। সেখানে বিভিন্ন পর্যটন এলাকা রয়েছে যেখানে প্রচুর মানুষ যায় এবং প্রকৃতি উপভোগ করে। সুতরাং অশান্তি সৃষ্টির কাজে সময় নষ্ট না করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের প্রতি নজর দিতে পারলে দেশ ও জনগণের অনেক উপকার হবে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী। অর্থনৈতিকভাবেও এ নগর অনেক এগিয়ে। অদূর ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে এবং জাতীয় স্তর পেরিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রকেও প্রভাবিত করবে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়ন, শান্তি ও সম্প্রীতর বিকাশ ঘটানো দরকার। একই সঙ্গে, সীমান্তবর্তী ও ভূকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে মাদক, মানব ও অস্ত্র পাচার এবং শরণার্থীদের সমস্যার নিরসন আর সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।

তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা

চট্টগ্রামের তরুণ প্রজন্মকে চট্টগ্রামের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় নষ্ট না করে দেশের উন্নয়নে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার জন্য তাদেরকে উপযুক্ত হতে হবে। আজকে অনেক ধরনের সুযোগ রয়েছে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেমন স্টার্টাপ প্রোগ্রাম, ফ্রিল্যান্সিং, অনেক ইন্ডাস্ট্রিও রয়েছে। এসব জায়গায় নিজেদের চিন্তা ভাবনা গুলোকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে জীবনকে সুন্দর করে তৈরি করা যায় সে চেষ্টা করতে হবে। সংঘাত ও উত্তেজনা পরিহার করে তরুণ প্রজন্মকে আত্মবিকাশের পথে নিয়ে যাওয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় সিসিআরবিডি। যে কারণে সংস্থার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান স্টেকহোল্ডার হিসাবে বিভিন্ন জাতিসত্তার দেড়শতাধিক তরুণ-তরুণী সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সিসিআরবিডি'র কার্যক্রমে তরুণ প্রজন্মকে মূল ফোকাসে রেখে গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।