ইয়েমেনে জাতিসংঘ কর্মকর্তা অপহরণ: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের তৎপরতা ও আপোষ আলোচনার সাফল্য
আরব বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেন। বহু বছর ধরে চলমান গৃহযুদ্ধে দেশটি পুরোপুরি বিপর্যস্ত। জাতিসংঘের মতে ইয়েমেনের পরিস্থিতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব-সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়। বর্তমানে ইয়েমেনের ৭৫ শতাংশ মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। অন্তত সোয়া কোটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি খাদ্য সহায়তা দরকার। প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষখাদ্য নিরাপত্তায় ভুগছে।
পাঁচ বছরের নিচের ৪ লাখ শিশু চরম অপুষ্টির শিকার, যা তাদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে। ইয়েমেন আল কায়েদার ঘাঁটিও রয়েছে। প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাকার কারণে ইয়েমেনের আলকায়েদাকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন বলছে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।ভূকৌশলগত কারণে ইয়েমেনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি লোহিত সাগর আর গালফ অব এডেনের সংযোগস্থলবাব আল- মান্দাব প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে। এই জলপথে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের সরবরাহ হয়ে থাকে। তেল বহনকারী জাহাজগুলো বাব-এল-মান্দাব প্রণালী দিয়ে সুয়েজ খালে প্রবেশ করে।অস্থিতিশীল ইয়েমেন বিশ্বব্যাপী তেলের বাণিজ্যে হুমকি সৃষ্টি করতে পারে যা কাম্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে চলমান গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আল কায়েদা ইন দি আরব পেনিনসুলা আর ইসলামিক স্টেট গ্রুপ তাদের কার্যক্রম জোরদার করে ও ইয়েমেনের দক্ষিণের বেশ কিছু স্থান দখল করে নেয়। ইয়েমেনে অপহরণের ঘটনা প্রায়শই ঘটে, সাধারণত মুক্তিপণ আদায় করে অনেককে ছেড়ে দেয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো।
২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, ইয়েমেনের আবইয়ান প্রদেশের মুদিয়াহ শহরের কাছে একটা অস্থায়ী চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সুফিউল আনামসহ জাতিসংঘের আরও পাঁচ কর্মীকে অপহরণ করে অপহরণকারীরা অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। দক্ষিণ ইয়েমেনে জাতিসংঘের একটি ফিল্ড ট্রিপের দায়িত্ব শেষে তারা যখন রাজধানী এডেনের দিকে ফিরছিলেন তখন মাঝপথে এই অপহরণের ঘটনা ঘটে। পরে জানা যায় যে এই অপহরণের সঙ্গে ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়েদা জড়িত।
লে. কর্নেল (অব.) সুফিউল আনাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১৯৭৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। অবসর গ্রহনের পর থেকে তিনি জাতিসংঘে দায়িত্ব পালন করছিলেন। অপহরণের সময় তিনি ইয়েমেনের এডেনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিভাগের ফিল্ড সিকিউরিটি কো-অর্ডিনেশন অফিসার (প্রধান) হিসেবে কর্মরত ছিলেন ।১২ ফেব্রুয়ারি, অপহরণকারী গোষ্ঠী জাতিসংঘের ইয়েমেন দফতরে যোগাযোগ করে ৩০ লাখ ডলার মুক্তিপণ এবং একই সঙ্গে সরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে আটক আল কায়দা জঙ্গির মুক্তিদাবি করে। জাতিসংঘের ইয়েমেন অফিস সেখানকার স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের মাধ্যমে আলোচনা করে পাঁচ কর্মকর্তাকে উদ্ধারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সম্পর্কিত বিভাগ কাজ করছে বলে জানায়। বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন থেকে জানানো হয় যে,বাংলাদেশি কর্মকর্তাকে উদ্ধারে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। বিশ্বব্যাপী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আল-কায়েদার ইয়েমেন শাখার একটা ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে। এই ভিডিও বার্তায় লে. কর্নেল (অব.) আনাম জানান যে, জঙ্গি সংগঠন আল–কায়েদা তাকে অপহরণ করেছে।অপহরণকারীদের হাত থেকে তাঁকে মুক্ত করতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন পক্ষের কাছেতিনিঅনুরোধ করেন। তিনি জানান যে তিনি খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন এবং অপহরণকারীদের দাবি মেনে না নিলে তাকে তারা মেরে ফেলতে পারে।
লে. কর্নেল (অব.)আনামকে মুক্ত করতে তার পরিবার প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর চিঠি পাঠায়। শুরু থেকেই বাংলাদেশ ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছিল। এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হয়।তবে মুক্তিপণ দিয়ে কোনো কর্মকর্তাকে ছাড়িয়ে আনার বিষয়ে জাতিসংঘের নীতিগত বাধা আছে বলে তিনি জানান। তাকে উদ্ধারে ঢাকায় নিযুক্ত ইয়েমেনসহ পাশের দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়মিত চাপ দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ।জাতিসংঘ বাংলাদেশকে বারবার আশ্বস্ত করেছেযে তারা যোগাযোগ করছে ও অগ্রগতি হচ্ছে। বিষয়টির স্পর্শকাতরতা বিচার করে এবং তার জন্য কোন কিছু যেন প্রাণনাশের কারণ হয়ে না দাড়ায়, বাংলাদেশ যেন নিজেরা কিছু না করে জাতিসংঘ থেকে এমন পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের অনুরোধ রেখে কাজ করে আসছিল। বাংলাদেশ জাতিসংঘের বৈঠকে বিষয়টি একাধিকবার তুলেছে এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে ও সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছে।জাতিসংঘের একক প্রচেষ্টায় এই উদ্যোগে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশ উদ্যোগী হয়ে ভিন্ন কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইয়েমেনের সংঘাতে বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব রাষ্ট্র যুক্ত ছিল এবং চলমান যুদ্ধবিরতিতে যেসব দেশ সহায়তা করেছে বাংলাদেশ সেইসব দেশের সাথে যোগাযোগ করে তারা কিভাবে সহায়তা করতে পারে, তা নিয়ে তৎপরতা শুরু করে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর লে. কর্নেল (অব.) আনামের খোঁজ করতে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে ইয়েমেনে যেতে অনুমোদন দেয়। তার খোঁজে বাংলাদেশের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ইয়েমেন যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সরকারের দিক নির্দেশনায় ও সক্রিয় তৎপরতার প্রেক্ষিতে ইয়েমেনে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল–কায়েদার হাতে অপহৃত জাতিসংঘের কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) আনামকে ৮ আগস্ট উদ্ধার করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ৯ আগস্ট তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ইয়েমেনে অপহৃত হওয়া সুফিউল আনামকে উদ্ধার করে। আল–কায়েদার জঙ্গিদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর সুফিউল আনাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। ইয়েমেনে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার জিম্মিদশা থেকে বাংলাদেশি লে. কর্নেল (অব.) আনামসহ জাতিসংঘের পাঁচ কর্মকর্তার মুক্ত হওয়ার ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ। ১১ আগস্ট ইয়েমেনে জাতিসংঘের আবাসিক ও মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়ক ডেভিড গ্রাসলি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘটনায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি ইয়েমেন সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।
সন্ত্রাসীরা গত দেড় বছরে ১৮ বার স্থান পরিবর্তন করেও তাকে দশটি জায়গায় রেখেছিল, সারাক্ষণ তার চোখ বেঁধে রাখত বলে জায়গাগুলো সম্পর্কে তার ধারণা নাই। তবে ভাগ্য ভালো ছিল তারা তাকে নির্যাতন করে নাই। অপহরণকারীদের টাকা শেষ হয়ে গেলে ভালোভাবে খাবার দিত না বলে জানান তিনি। জাতিসংঘের কর্মী হিসেবে তাকে টার্গেট করা হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন।এনএসআইয়ের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার মনে হয়েছিল যে দেশ তাকে ভোলেনি।এনএসআইয়ের পরিচালক জানায় যে তাকে উদ্ধার করার বিষয়টি ছিল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, দেড় বছরের চেষ্টায় এই সফলতা এসেছে। অপহরণকারীরা ৩০ লাখ মার্কিন ডলার চেয়েছিল, কিন্তু তাদেরকে কোনো টাকাপয়সা না দিয়ে লে. কর্নেল (অব.) আনামকে মুক্ত করা হয়। এই তৎপরতায় সহায়তার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে ১৪ আগস্ট ফোনালাপে বাংলাদেশি জনগণ, সরকার, লে. কর্নেল (অব.)আনামের পরিবারের সদস্যদের এবং তার নিজের পক্ষে ইয়েমেনে অপহরণকারীদের কাছ থেকে আনামের মুক্তির ব্যাপারে তাদের অসাধারণ প্রচেষ্টা এবং সফল আলোচনার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপতি ও গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী সফল মুক্তির আলোচনার প্রশংসা করে বলেন, আল-কায়েদার বন্দিদশা থেকে লে. কর্নেল (অব.) আনামের মুক্তিলাভ এটাই প্রমাণ করে যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত সফল শান্তিস্থাপন এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে দায়িত্বশীল জাতি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি আশা করেন যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত আগামী দিনে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এই ধরনের দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখবে। তিনি দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ও ধন্যবাদ জানান।জটিল এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এই ঘটনার শান্তিপূর্ণ সমাধান এটাই প্রমাণ করে যে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে দায়িত্ব পালনরত বাংলাদেশি নাগরিকদের বিপদে আপদে বাংলাদেশ সরকার তাদের পাশে আছে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তৎপর। প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় নেওয়া এই উদ্ধার কার্যক্রম বাংলাদেশের পরিকল্পনা ও তার সফল বাস্তবায়নের সক্ষমতার প্রমান।এই সাফল্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য একটা মাইলফলক। ভবিষ্যতে এই ধরনের তৎপরতা বাংলাদেশের জন্য আরও সুনাম বয়ে আনবে এটাই প্রত্যাশা।